বিজনেস আওয়ার ডেস্ক: বিস্ময়কর সৃষ্টি জগতের স্পন্দনে মুখর প্রকৃতি অকপটে জানান দেয় জ্ঞানীয় ক্ষমতার দিক থেকে মানুষের সমকক্ষতার কথা। প্রাণের আশ্রয় এই নীল গ্রহের কিছু প্রাণীকুলের অদ্ভুত বুদ্ধিদ্বীপ্ততা পাল্লা দিয়ে চলে তাদের সহজাত প্রবৃত্তির সঙ্গে। সেখানে বিজ্ঞানের প্রখর বিশ্লেষণ অবাক বনে যায় তাদের জ্ঞানীয় ক্ষমতার কাছে। আজ মানুষ ব্যতীত পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান ১০ প্রাণীর কথা বলব। আপনার চিরচেনা প্রাণীটিকেও হয়ত এই তালিকায় পেয়ে যেতে পারেন। চলুন, বুদ্ধিমত্তার এক ভিন্ন জগৎ থেকে ঘুরে আসা যাক।
ডলফিন
অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা এবং উচ্চতর জ্ঞানীয় ক্ষমতার জন্য মানুষের পরেই সর্বাধিক পরিচিত প্রাণীটি হলো ডলফিন। বিশেষ করে বোটলনোজ ডলফিন সামাজিক কাঠামো গঠন, পারস্পরিক যোগাযোগ এবং সমস্যা সমাধান করতে পারে। এদের মস্তিষ্ক শরীরের তুলনায় বড় এবং এদের মস্তিষ্কের বিকশিত নিওকর্টেক্স অঞ্চলটি উঁচু স্তরের জ্ঞানীয় কার্য সম্পাদনে সহায়তা করে।
ডলফিনের বুদ্ধিমত্তার একটি আকর্ষণীয় দিক হলো তাদের হাতিয়ার ব্যবহার। এই দক্ষতাটি যে তারা শুধু আত্মরক্ষায় ব্যবহার করে তা নয়; শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে তারা এটি ছড়িয়ে দিতে পারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
ডলফিনরা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে তাদের নানা ধরনের কণ্ঠস্বর এবং শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করে যোগাযোগের দক্ষতা দিয়ে। প্রতিটি ডলফিনের স্বতন্ত্র স্বাক্ষর হুইসেল রয়েছে, যা অনেকটা নাম বা সম্বোধনের মতো কাজ করে।
বনমানুষ
শিম্পাঞ্জি, বোনোবোস, গরিলা এবং ওরাংওটাঙের মত গ্রেট এপসরা মানুষের নিকটতম আত্মীয়। এরা মানুষের মতোই সহানুভূতি, মনস্তত্ত্ব, হাতিয়ার ব্যবহার, যোগাযোগ এবং সূক্ষ্ম সমস্যা সমাধান করতে পারে। যে বিষয়টি তাদের বিশেষত্ব দিয়েছে সেটি হলো, হাতিয়ার ব্যবহারের ক্ষমতা এবং তা দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা।
এই বনমানুষরা পরস্পরের আবেগ চিনতে ও বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী প্রাসঙ্গিক সাড়াও দিতে পারে। নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন তথ্য জানাতে তারা কণ্ঠস্বর, মুখের অভিব্যক্তি এবং শরীরের ভঙ্গিমা ব্যবহার করে। তারা অন্যান্য প্রাণী বিশেষ করে মানুষের সঙ্গে এই যোগাযোগটি রক্ষা করতে পারে।
বনমানুষের যুগান্তকারী বিকাশ হলো, তারা নতুন প্রতীক বা সাংকেতিক ভাষা শিখে নিতে পারে।
হাতি
স্থলজ প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মস্তিষ্ক হলো হাতির। তাদের প্রায় ২৫৭ বিলিয়ন নিউরন রয়েছে, যা মানুষের মস্তিষ্কের প্রায় তিনগুণ। হাতির বুদ্ধিমত্তার একটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো মৃত সঙ্গীদের জন্য শোক প্রকাশের ক্ষমতা। তারা মৃত পালের সদস্যের শরীর আলতো করে স্পর্শ বা আদর করে সান্ত্বনা দেয়।
তারা হাতিয়ার ব্যবহার করে দূরের কোনো জিনিস নাগালের মধ্যে নিয়ে আসতে পারে। প্রতিকূল পরিবেশে নতুন কিছু শিখে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
হাতিরা বয়স্ক সদস্যের নেতৃত্বে একক পরিবার গঠন করে নির্দিষ্ট জায়গায় বসবাস করে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য অনেক দূর থেকে কম-ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ ব্যবহার করে।
তিমি
অরকাস তিমি সামুদ্রিক প্রাণীদের মধ্যে সব থেকে বুদ্ধিমান এবং ভয়ঙ্কর শিকারি। ঘাতক তিমি নামে পরিচিত এই দৈত্যাকার প্রাণী সামাজিক কাঠামো গঠন করতে পারে। প্রতিটি একক পরিবার আলাদা ভাবে আঁটসাঁট হয়ে একত্রে থাকে।
অরকাসের আছে সমস্যা সমাধান, উন্নত যোগাযোগ এবং বৈচিত্র্যময় শিকারের কৌশল প্রদর্শনের ক্ষমতা। তাদের বৃহৎ মস্তিষ্ক এবং বিভিন্ন কণ্ঠস্বর তাদের উচ্চস্তরের জ্ঞানীয় ক্ষমতার পরিচয় দেয়। তাদের স্বতন্ত্র আওয়াজ বা ডাকের জন্য তাদের রয়েছে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা। তারা দলবদ্ধ হয়ে শিকার করে এবং বিভিন্ন সময়ে জায়গা বদলের জন্য তারা দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়।
এই অতিকায় প্রাণীগুলো সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অক্টোপাস
বহু উপাঙ্গবিশিষ্ট অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে অধিক বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করে অক্টোপাস। অক্টোপাসের একটি সূক্ষ্ম স্নায়ুতন্ত্র রয়েছে এবং প্রতি উপাঙ্গতে রয়েছে নিউরনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, যেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মস্তিষ্কের জটিল কাজগুলো সম্পাদন করে।
অক্টোপাস বুদ্ধিমত্তার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো- তাদের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা। অক্টোপাস সুনিপুণভাবে হাতিয়ার ব্যবহার দেখে অনুকরণ করে শিখে নিতে পারে। এই ক্ষমতাটি তাদের বিভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে সাহায্য করে।
গবেষণায় দেখা যায় যে, অক্টোপাস যেকোনো বন্দি দশা থেকে মুক্তি লাভের জন্য অদ্ভুত সব কৌশল অবলম্বন করে থাকে। মূলত তাদের অভূতপূর্ব অভিযোজন ক্ষমতাই এমন নৈপুণ্য প্রকাশের কারণ।
কাক
পরিবেশের সবচেয়ে পরিচিত এই প্রাণীটিরও আছে সমস্যা সমাধান এবং উন্নত সামাজিক আচরণের দক্ষতা। তারা নিজেদের কাজে সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারে। মানুষের চেহারা মনে রাখা এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এদের বেশ খ্যাতি আছে।
কাকের উন্নত স্মৃতিশক্তি তাদের খাদ্য উৎসের নির্দিষ্ট অবস্থানগুলো মনে রাখতে সাহায্য করে। এমনকি তারা সংগৃহীত খাবার পরবর্তীতে খাওয়ার জন্য মজুত করে রাখতে পারে। কতটুকু খাবার বাকি আছে তা যাচাই করে সেই অংশটুকু যোগান দেওয়ার প্রবণতা আছে এদের মধ্যে।
এছাড়া নির্দিষ্ট ব্যক্তির চেহারা মনে রেখে অন্যান্য কাকের কাছে সেই তথ্যগুলো পাঠানো কাকের এক নজিরবিহীন ক্ষমতা।
তদুপরি, খাদ্য প্রাপ্তির জন্য সরঞ্জাম ব্যবহারের বেলায় কাকেরা বেশ সৃজনশীল হয়। বিশেষ করে সংকীর্ণ স্থানে লুকিয়ে থাকা খাবার সংগ্রহ করতে তারা বেশ পারদর্শী।
টিয়া পাখি
টিয়া পাখিদের মধ্যে বিশেষ করে আফ্রিকান ধূসর প্রজাতি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। এরা মূলত বিভিন্ন ধরনের কণ্ঠের অনুকরণের জন্য ব্যাপকভাবে পরিচিত।
টিয়ার মানুষের ভাষা শেখার এবং বোঝার ক্ষমতা রয়েছে। কণ্ঠস্বর এবং শারীরিক ভাষার মাধ্যমে তারা মানুষ এবং অন্যান্য টিয়া পাখিদের সঙ্গে কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে পারে।
এই কণ্ঠ প্রতিভা ছাড়াও টিয়া পাখিদের সরঞ্জাম ব্যবহার এবং সমস্যা সমাধানেরও দক্ষতা রয়েছে। এরা খাদ্য সংগ্রহের সময় সংগ্রহের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বস্তুগুলোর রদবদল ঘটাতে পারে। প্রতিবন্ধকতা অনেক জটিল হলে তারা প্রথমে পর্যবেক্ষণে সময় দেয়। অতঃপর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মাধ্যমে জটিলতার প্যাটার্নটি বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে। সবশেষে কীভাবে বস্তুগুলো সরালে খাবার সংগ্রহের পথটি সহজ হবে তা আগে থেকে পরিকল্পনা করে সামনে অগ্রসর হয়।
শূকর
আশ্চর্যজনক হলেও এই গৃহপালিত প্রাণীটির রয়েছে উন্নত জ্ঞানীয় ক্ষমতা। অন্যান্য প্রাণীরা যেখানে আয়নার সামনে বোকা বনে যায়, সেখানে তারা বেশ ভালোভাবেই আয়নাতে নিজেদের চিনতে পারে। তারা সমস্যা সমাধান এবং পুরনো স্মৃতিশক্তি ব্যবহারে বেশ দক্ষ।
এদের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ব্যাপারটি হচ্ছে- এরা নিজেদের ভুল থেকে শিখতে পারে। অতঃপর সেই অনুযায়ী তাদের কৌশল বদলাতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে খাবার সংগ্রহের বেলায় শূকরদের এমন বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেখা যায়।
স্মৃতিশক্তি ও সমস্যা সমাধানের চর্চা থাকার ফলে স্বভাবতই এরা নতুন পরিস্থিতি এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারে।
নেকড়ে
কৌশল করে শিকার করা এবং অভিযোজনের ক্ষেত্রে নেকড়েদের জুড়ি মেলা ভার। এরা মূলত দলবদ্ধভাবে শিকার করে, যেখানে দলের প্রতিটি সদস্য একে অন্যকে বুঝতে পারে। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নেকড়ে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
শিকারকে অনুসরণ এবং ধরার জন্য এদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার কারণে তুলনামূলকভাবে বড় এবং শক্তিশালী প্রাণীদেরও তারা ধরাশায়ী করতে সক্ষম হয়। পূর্ব পরিকল্পনা এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো দক্ষতার কারণে এরা যেকোনো অভিযানের জন্য আত্মবিশ্বাসীও হয়।
নেকড়েদের প্রখর গন্ধ এবং শ্রবণের অনুভূতি তাদের বুদ্ধিমত্তা এবং অভিযোজন ক্ষমতায় অবদান রাখে। গন্ধ শুঁকে শিকার শনাক্ত করা এবং সম্ভাব্য হুমকি এড়ানোতে এরা অন্য যেকোনো প্রাণীয় তুলনায় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দক্ষতা প্রদর্শন করে।
ইঁদুর
আকারে খুব নগণ্য হলেও ইঁদুরের বুদ্ধিমত্তা এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা তাজ্জব করে দেওয়ার মতো। তারা খুব দ্রুত শিখে নিতে পারে এবং এ দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারে।
অধিকাংশ গবেষণায় ইঁদুর দিয়ে গোলকধাঁধা সমাধান করা হয় এবং এ থেকে ইতোমধ্যে বেশ ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেছে।
এই গবেষণাগুলোর মাধ্যমে তাদের স্মৃতিশক্তির দক্ষতার ব্যাপারে বিশদ তথ্য উন্মোচন হয়েছে। এই মনে রাখার ক্ষমতাটি তারা নিজেদের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অভাবনীয়ভাবে প্রয়োগ করে। নিজেদের খাদ্যের যোগান দেওয়ার জন্য তারা সরঞ্জাম ব্যবহার করতেও পারদর্শী। পরিবেশ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাটি সমগোত্রীয় যেকোনো প্রাণীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তাদের এগিয়ে রাখবে।
শেষাংশ
মানবজাতির পরে পৃথিবীর সর্বাধিক বুদ্ধিমান ১০টি প্রাণী প্রকৃতির বিচিত্র কার্যপ্রণালীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেইসঙ্গে উন্মুক্তভাবে প্রচার করে প্রকৃতির রহস্যময়তার কথা। এই পরিপ্রেক্ষিতে, পৃথিবী নিছক প্রাণের বিচরণক্ষেত্র নয়। বরং বুদ্ধিমান প্রাণে পরিপূর্ণ এক সমৃদ্ধ আশ্রয়।
এই প্রাণীদের জ্ঞানীয় ক্ষমতা প্রাকৃতিক ভারসাম্যের এক বিরাট প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে। এই প্রকৃতি যেহেতু তাদেরও আশ্রয়, তাই ঝুঁকিতে থাকা প্রকৃতিকে বাঁচাতে মানুষের সংগ্রামে তাদের চেয়ে উপযোগী সঙ্গী আর কেউই হতে পারে না।
বিজনেস আওয়ার/২০ আগস্ট, ২০২৩/এএইচএ