বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক: জাতীয় নির্বাচনের পরপরই ইতিবাচক হতে শুরু করেছে শেয়ারবাজার। গত এক সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লেনদেন ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। মূল্যসূচক বেড়েছে ৫৭ পয়েন্ট। এর প্রভাবে ডিএসইর বাজারমূলধন ৫ হাজার কোটি টাকা। এদিকে বাজারে বহু সমালোচিত ফ্লোর প্রাইসের (শেয়ার মূল্যের নিুসীমা) ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। অর্থাৎ চলতি মাসেই ফ্লোর প্রাইস উঠে যাচ্ছে। তবে তিন ধাপে উঠবে ফ্লোর প্রাইস।
বর্তমানে যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম ফ্লোর প্রাইসের ওপরে রয়েছে এবং মার্জিন ঋণ সুবিধা পায় না, প্রথম ধাপে ওই কোম্পানির সীমা তুলে দেওয়া হবে। দ্বিতীয়ত যেসব কোম্পানি ফ্লোরে আছে; কিন্তু তাদের শেয়ারের দাম ওঠানামায় মূল্যসূচকে খুব বেশি প্রভাব পড়ে না, তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সর্বশেষ ধাপে যেসব কোম্পানি সূচকে প্রভাব রাখে, এ ধরনের বড় মূলধনের কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হবে। তবে বাজারে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তুলে নেওয়ার পর আবারও ফ্লোর প্রাইস দেওয়া হতে পারে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন ভিন্নকথা। তাদের মতে, চাহিদার চেয়ে বাজারে সরবরাহ বাড়ানো বেশি জরুরি।
জানতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, জরুরি পরিস্থিতির কারণেই ফ্লোর প্রাইস দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। শিগগিরই এটি তুলে নেওয়া হচ্ছে। বাজারের স্বার্থেই এ সিদ্ধান্ত জরুরি। তবে বাজারে অনেক পক্ষ রয়েছে। আমি তাদের পরিষ্কার বার্তা দিচ্ছি। ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে নেওয়ার পর কেউ পরিকল্পিতভাবে ফেলে দিয়ে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করলে পরের দিনই আবার ফ্লোর প্রাইস দেওয়া হবে। এরপর কারা অযৌক্তিকভাবে বিক্রির আদেশ দিল, সরকারকে বিব্রত করতে চায় কি না, তা খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই। তিনি বলেন, বাজার ইতিবাচক হবে। আমি সম্ভাবনা দেখছি। কারণ, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে গেছে। অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে শুরু করছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। এতে ডলার সংকট কেটে যাবে। এছাড়াও কিছু কোম্পানি ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক বছর শেষ হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা অনেক ভালো। তারা ভালো মুনাফা করেছে। অন্যদিকে ব্যাংকের কাছেও বাড়তি তারল্য রয়েছে। সুশাসনসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সুশাসন কার্যক্রম চলমান। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী আমাকে পরিষ্কার বার্তা দিয়েছেন, বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎ করে এবার কেউ পার পাবে না। সবকিছু মিলে আমি শেয়ারবাজারের সম্ভাবনা দেখছি। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শেয়ারবাজারের চাহিদার চেয়ে সরবরাহের সমস্যা বেশি। অর্থাৎ এই বাজারে ভালো কোম্পানির সংখ্যা হাতে গোনা। ফলে সরবরাহ বাড়াতে হবে। বিএসইসি, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং স্টক এক্সচেঞ্জসহ যে সংস্থা থেকে উদ্যোগ নিয়ে হোক, বাজারে সরকারি-বেসরকারি ভালো কোম্পানির সংখ্যা বাড়াতে হবে। এটি করতে পারলে নতুন বিনিয়োগকারী আসবে এবং বাজারে বাড়বে তারল্য প্রবাহ। না হলে মূল্যসূচক সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে থেকেই সামান্য কিছু ওঠানামা করবে।
প্রসঙ্গত, ফ্লোর প্রাইস হলো শেয়ার দাম কমার নিুসীমা। করোনার সময় অস্থিরতা ঠেকাতে নতুন নিয়ম চালু করেছে বিএসইসি। এর নাম শেয়ারের ‘ফ্লোর প্রাইস’। এক্ষেত্রে কোনো শেয়ারের দামের ভিত্তি হবে আগের ৫ দিনের সর্বশেষ লেনদেনের (ক্লোজিং প্রাইস) গড় দর। কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম ফ্লোর প্রাইসের নিচে নামতে পারবে না। কিন্তু দাম ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারবে। এরপর ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হলেও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দরপতন ঠেকাতে গত বছরের ২৮ জুলাই পুঁজিবাজারে দ্বিতীয়বারের মতো ফ্লোর প্রাইস দেয় বিএসইসি। এখনো সেটি বহাল আছে। এর ফলে বর্তমানে দেড়শর মতো কোম্পানির লেনদেন আটকে আছে। এতে যারা ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন, তারা সবচেয়ে বেশি বিপদে। শেয়ারবাজারের নিয়মিত ন্যূনতম খবর রাখেন, এরকম কারও যদি প্রশ্ন করা হয় এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা কী। তাদের সবাই বলবেন ফ্লোর প্রাইস দিয়ে কৃত্রিমভাবে লেনদেন আটকে রাখা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
এদিকে নির্বাচনের পরপরই ফ্লোর প্রাইসের বিষয়টি সামনে এসেছে। বাজারে গুরুত্বপূর্ণ দুটি অংশীজন ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ)। এ দুটি সংগঠনই ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার পক্ষে। কিন্তু পদ্ধতি নিয়ে দুই পক্ষের মতবিরোধ রয়েছে। সবাই কমিশনের সঙ্গে কথা বলেছে। ডিবিএ চাচ্ছে একসঙ্গে সব কোম্পানির ফ্লোর তুলে দেওয়া হোক। কিন্তু বিএমবিএ-এর বক্তব্য ধাপে ধাপে তুলে দেওয়া উচিত। এ কারণে আপাতত তিন ধাপে ফ্লোর প্রাইস তোলার কথা ভাবছে কমিশন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ৩৭০টির মতো কোম্পানি বাজারে লেনদেন হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে ফ্লোর প্রাইসে আছে এ ধরনের কোম্পানি ১৪০ থেকে ১৫০টি। বাকি দুই শতাধিক কোম্পানি বর্তমানে ফ্লোরের ওপরে রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এসব কোম্পানির ফ্লোর তুলে দেওয়ার কথা ভাবছে কমিশন। তবে বড় মূলধনের কোম্পানির ব্যাপারে সবার শেষে সিদ্ধান্ত নেবে। অন্যদিকে ফ্রি ফ্লোড বা লেনদেনযোগ্য শেয়ারের মধ্যে সূচকে অবদান ভিন্ন ভিন্ন। যে কোম্পানিটি সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে, ওই কোম্পানির সূচকে অবদান ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম অবদান শূন্য দশমিক ০২ শতাংশ। ফলে যেসব কোম্পানির সূচকে অবদান কম, সেসব কোম্পানির ব্যাপারে দ্বিতীয় ধাপে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। আর তৃতীয় ধাপে বড় মূলধনের কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস উঠবে। সূত্র বলছে, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সহায়তা ছাড়া ফ্লোর প্রাইস তুলে নিলে বাজারে বিপর্যয় হতে পারে। এমনকি ৭শ থেকে ৮শ পয়েন্ট কমতে পারে সূচক। কারণ, অনেকদিন হলো বিশালসংখ্যক বিনিয়োগকারী আটকে আছেন। ফলে বিষয়টি নিয়ে বাজারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আতঙ্ক আছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আরও একটু সময় নেবে কমিশন।
এদিকে নির্বাচনের পরপরই ইতিবাচক হতে শুরু করেছে সূচক। গত সপ্তাহে ৪ দিনে ডিএসইতে ২ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৫৪৯ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। আগের সপ্তাহে ৪ দিনে ১ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল। প্রতিদিন গড়ে ৩৯৯ কোটি টাকা হয়েছিল। এ হিসাবে গত সপ্তাহে লেনদেন বেড়েছে ৬০০ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে যা ৩৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ডিএসই ব্রড সূচক ৫৭ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার ৩০১ পয়েন্টে উন্নীত হয়েছে।
এ সময়ে বাজারমূলধন ৫ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ৭ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। গত সপ্তাহে ৪০৬টি কোম্পানি লেনদেনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ১৪৭টি কোম্পানির শেয়ারের, কমেছে ৩৩টি এবং অপরিবর্তিত ২০০টি কোম্পানির শেয়ারের দাম। তবে ২৬টি কোম্পানির কোনো শেয়ার লেনদেন হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে চাহিদার দিক থেকে সমস্যা হলো এ খাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। আর সরবরাহের দিক থেকে সমস্যা হলো ভালো কোম্পানির সংখ্যা খুবই কম। তাদের মতে, শেয়ারবাজারের উন্নয়নের জন্য সামগ্রিকভাবে আর্থিক খাতের সংস্কার দরকার। কারণ, একটি কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসে মূলত দুই কারণে। প্রথমত, কোম্পানির সম্প্রসারণে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির জন্য, দ্বিতীয়ত, অন্যদের তুলনায় তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু যে দেশে ব্যাংক থেকে টাকা নিলে ফেরত না দিয়ে পার পাওয়া যায়, সেখানে শেয়ারবাজারে পুঁজির জন্য কোম্পানিগুলো আসতে আগ্রহী হবে না।
অন্যদিকে যেসব কোম্পানিকে কর ছাড়ের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, বর্তমানে ওই কোম্পানি করই দেয় না। আর কর দিলেও দিলে বিভিন্নভাবে ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে শেয়ারবাজার টেকসই করার জন্য সবার আগে ব্যাংকিং খাত ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংস্কার দরকার। এরপর বাজারে নির্মোহভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বিজনেস আওয়ার/এএইচএ