বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক: প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনে পরিচালক হারুনুর রশীদ কাজলের (জ্যাম্বস কাজল) বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন চিত্রনায়ক রিয়াজ আহমেদ। তবে মামলার পর নায়ক রিয়াজ ও বিবাদী হারুনুর রশীদ কাজলের মধ্যে আপস-মীমাংসা হয়। এতে নায়ক রিয়াজ আদালতে আর সাক্ষ্য না দেওয়ার বিষয়ে জানান। পরে পিবিআই আদালতে এই মামলার প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। এরপর ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক জুলফিকার হায়াত পিবিআইয়ের দেওয়া প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা খারিজ করে দেন।
গত বছরের ১৬ এপ্রিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ২৫ ও ২৯ ধারায় ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন চিত্রনায়ক রিয়াজ আহমেদ। এতে পরিচালক হারুনুর রশীদ কাজলের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনা হয়। মামলার তদন্ত করে পিবিআই পরিদর্শক মুহাম্মদ মাসুদ রানা চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হারুনুর রশিদ কাজল ওরফে জ্যাম্বস কাজলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ২৫ ও ২৯ ধারায় বাদীর আনা অভিযোগ অপর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়নি। এরপর চলতি বছরের ১৪ মার্চ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক জুলফিকার হায়াত মামলাটি খারিজ করে আদেশ দেন।
আদেশে বিচারক বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনসহ নথি পর্যালোচনা করলাম। তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করা হলো। তদন্ত প্রতিবেদনে পর্যাপ্ত পরিমাণ উপাদান বিদ্যমান না থাকায় পিটিশন মামলা খারিজ করা হলো।’
নির্ধারিত সময়ে বিজ্ঞাপনের কাজ শেষ করতে পারেননি হারুন
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর রংপুর কেমিক্যাল লিমিটেড ‘ইউসেরা হ্যান্ডওয়াশ’ এবং ‘আন্দালুস ডিশওয়াশ’ নামের পণ্যের ৩টি বিজ্ঞাপনের জন্য হারুনুর রশিদ কাজলের সঙ্গে চুক্তি করে। এরপর ২০২৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রংপুর কেমিক্যাল লিমিটেড এ লক্ষ্যে আসামি কাজলকে ওয়ার্ক অর্ডার (কার্যাদেশ) দেয়। তবে কাজল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিজ্ঞাপনের কাজ শেষ করতে পারেননি। ফলে রংপুর কেমিক্যাল লিমিটেড চুক্তি বাতিল করে এবং চেরি ফিল্মস নামে অন্য একটি ফার্মের সঙ্গে তারা চুক্তি করে। একই বছরের ১ মার্চ বাদী রিয়াজ রংপুর কেমিক্যাল লিমিটেডের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। এতে ‘ইউসেরা হ্যান্ডওয়াশ’ এবং ‘আন্দালুস ডিশওয়াশ’ নামের পণ্যের তিন বিজ্ঞাপনে তাকে মডেল হিসেবে দেখানো হয়।
বিজ্ঞাপনগুলো করতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে রংপুর কেমিক্যাল লিমিটেডের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হন আসামি হারুন। তিনি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে বাদীর নামে অশ্লীল এবং অকথ্য শব্দ ব্যবহার করে পোস্ট করেন। যদিও বাদী নায়ক রিয়াজের চুক্তি বাতিলের বিষয়ে কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
রিয়াজের নামে ফেসবুকে অশ্লীল পোস্ট করেন হারুন
মামলার অভিযোগ আরও বলা হয়, বিজ্ঞাপনগুলো করতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে রংপুর কেমিক্যাল লিমিটেডের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হন আসামি হারুন। তিনি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে বাদীর নামে অশ্লীল এবং অকথ্য শব্দ ব্যবহার করে পোস্ট করেন। যদিও বাদী নায়ক রিয়াজ শুধুমাত্র রংপুর কেমিক্যাল লিমিটেডের একজন মডেল এবং আসামির সঙ্গে চুক্তি বাতিলের বিষয়ে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
চুক্তি বাতিলের জন্য রিয়াজকে দায়ী করেন হারুন
মামলার সূত্রে জানা যায়, অভিযোগকারী ২০২৩ সালের ২৮ মার্চ জানতে পারেন, আসামি কাজল রংপুর কেমিক্যাল লিমিটেডের অফিসে ঢুকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেছেন। তিনি কোম্পানির কর্মীদের হুমকিও দেন। এরপর তার আগ্রাসী আচরণে ভীত হয়ে ২০২৩ সালের ২ এপ্রিল রংপুর কেমিক্যালস লিমিটেডের এইচআর (অ্যাডমিন) রেদওয়ানুল হক ঢাকার পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
তবে অভিযুক্ত কাজল চুক্তি বাতিলের জন্য বাদী রিয়াজকে দোষারোপ করতে শুরু করেন। পাশাপাশি চিত্রনায়ক রিয়াজকে নিয়ে অবমাননাকর এবং মানহানিকর শব্দ ব্যবহার করে ফেসবুক বিভিন্ন পোস্ট করেন।
মামলার অভিযোগে আরও বলা হয়, ২০২৩ সালেল ৩১ মার্চ অভিযুক্ত কাজল বাদী রিয়াজের কয়েকটি ছবিসহ আরেক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘পল্টিবাজ, মহাগাদ্দার, জাতীয় বেঈমান চিত্রনায়ক রিয়াজ ওয়াদা ও বিশ্বাসভঙ্গ করে গোপনে কোম্পানির সঙ্গে আঁতাত করেন। তিনি সাজানো মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও কুপ্ররোচনা দাঁড় করিয়ে শুটিংয়ের আগমুহূর্তে চলচ্চিত্র পরিচালক জ্যাম্বস কাজলের ৫ মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল ১৮ লাখ টাকা মূল্যের ৩টা বিজ্ঞাপন চোরের মতো ছিনিয়ে নেন। এরপর পরিচালককে বাদ দিয়ে গোপনে শুটিং করেন ধামরাই ফিল্ম ভ্যালিতে। বিশ্ব বাটপারের মুখোশ উন্মোচন করতে আমার প্রিয় দেশবাসীসহ সব চলচ্চিত্র পরিচালক ভাই ও বন্ধুসহ টিভি, পত্রিকার সাংবাদিক বন্ধুরা ও সব ইউটিউবার ভাইদের সহযোগিতা চাই।’
অভিযোগে বলা হয়, অভিযুক্তরা এসব অবমাননাকর শব্দ সম্পূর্ণরূপে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ব্যবহার করেছেন। বাদী রিয়াজের সম্পর্কে আসামির এসব কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা, অপমানজনক এবং মানহানিকর। চেরি ফিল্মসের সঙ্গে চিত্রনায়ক রিয়াজের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা জানা সত্ত্বেও অভিযুক্ত ব্যক্তি শুধুমাত্র রিয়াজকে অপমান করার জন্য এই পোস্ট করেন।
রিয়াজের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছিলেন হারুন
মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত বছরের ১ এপ্রিল ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মানহানিকর বিবৃতি দেন হারুন। বাদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও মানহানিকর অভিযোগের বিষয়ে আসামির ফেসবুক পোস্ট এবং প্রেস মিটের পরে বিষয়টি টেলিভিশন, সংবাদপত্র, ফেসবুক, ইউটিউব এবং অন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ভাইরাল হলে বাদীর সুনাম নষ্ট হয়। সে সময় আসামি মিডিয়াতে বলেন, ‘আমার রিজিক হরণকারী, ওয়াদা ভঙ্গকারী, সম্মান ধ্বংসকারী, জাতীয় বেঈমান, চিত্রনায়ক রিয়াজ কর্তৃক আমার ওয়ার্ক অর্ডারপ্রাপ্ত তিনটি বিজ্ঞাপনের নির্মাণকাজ দ্রুত বন্ধ করার যাবতীয় ব্যবস্থা করার জন্য সমিতির কাছে বিনীত আবেদন করছি। একই সঙ্গে জানাচ্ছি এমন কর্মকাণ্ড করে আমার মান-সম্মান নষ্ট করার দায়ে রিয়াজের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
বাদী ও বিবাদী পক্ষ নিজেদের মধ্যে মামলার বিষয়ে আপস-মীমাংসায় উপনীত হয়েছেন। বাদী জানান যে, মামলার ঘটনা প্রমাণের বিষয়ে তিনি আর কোনো সাক্ষ্য দেবেন না। ফলে বিবাদী হারুনুর রশিদ কাজলের বিরুদ্ধে বাদীর আনা অভিযোগ পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায় অপ্রমাণিত বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়।
কী বলা হয়েছে আপসনামায়
আপসনামায় রিয়াজ বলেন, বিভিন্ন কুৎসা ও মানহানিকর লেখা দিয়ে একটি পোস্ট করায় ও এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করায় কাজলের বিরুদ্ধে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতে মামলা করি। বর্তমানে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। এরই মধ্যে ওই মামলার বিষয়বস্তু নিয়ে উভয়পক্ষের পরিচিত গণ্যমান্য ব্যক্তি, হিতৈষী লোকজনদের মধ্যস্থতায় আপস-মীমাংসা করা হয়েছে। এ বিষয়ে বিবাদী তার ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। ভবিষ্যতে আর এ জাতীয় কোনো কার্যক্রম করবেন না বলে অঙ্গীকার করেন।
এতে আরও বলা হয়, আমরা ১ম ও ২য় পক্ষ উভয়ই সিনেমা তথা মিডিয়া জগতে কাজ করে আসছি। যেহেতু আমরা একই বিষয়ে কাজ করি সেহেতু আমরা আমাদের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য, ঝগড়া বিবাদ, নিজেদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হোক তা চাই না। এসব বিষয় চিন্তা করে ভবিষ্যতে উভয়ই একসঙ্গে একই জগতে চলার তথা কাজ করার মানসে মামলার ঘটনার বিষয়ে আপসনামায় উপনীত হলাম। এ আপসের ভিত্তিতে বর্তমানে উভয় পক্ষের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। আপসনামা সম্পাদনের সময় সাক্ষী ছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ আক্তার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি কাজী হায়াত।
আর কোনো সাক্ষ্য দেবেন না রিয়াজ
মামলাটি তদন্ত করে পিবিআই পরিদর্শক মুহাম্মদ মাসুদ রানা চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, বাদী ও বিবাদী পক্ষ নিজেদের মধ্যে মামলার বিষয়ে আপস-মীমাংসায় উপনীত হয়েছেন। বাদী জানান যে, মামলার ঘটনা প্রমাণের বিষয়ে তিনি আর কোনো সাক্ষ্য দেবেন না। ফলে বিবাদী হারুনুর রশিদ কাজল ওরফে জ্যাম্বস কাজলের বিরুদ্ধে বাদীর আনা অভিযোগ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ২৫ ও ২৯ ধারার অপরাধ পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায় অপ্রমাণিত বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়।
এ বিষয়ে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের পেশকার জুয়েল আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, পরিচালক হারুনুর রশীদের বিরুদ্ধে চিত্রনায়ক রিয়াজের মামলায় প্রতিবেদন দাখিল করেছে পুলিশ। আদালত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা খারিজ করে দেন।
বিজনেস আওয়ার/২৭ মার্চ/ এ এইচ