বিজনেস আওয়ার ডেস্ক: ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরু হওয়া বিক্ষোভ দ্বিতীয় সপ্তাহে গড়িয়েছে। এরই মধ্যে আমেরিকার কমপক্ষে ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়েছে এই বিক্ষোভ। পরিস্থিতি সামাল নয় শতাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে স্থানীয় প্রশাসন। তারপরও দমাতে পারেনি ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলন।
এদিকে, চরম অন্যায়ের বিরুদ্ধে মার্কিন শিক্ষার্থীদের এ বিক্ষোভ এখন ছড়িয়ে পড়ছে ব্রিটেন, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও।
বিক্ষোভের জেরে আমেরিকার বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। কোথাও কোথাও বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা পুরো ভবন দখল করে রেখেছে।
নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে গত সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভে এ পর্যন্ত শতাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে সশস্ত্র পুলিশ। শনিবার সকালে বোস্টনে দাঙ্গা পুলিশ নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে একটি তাঁবু তুলে দিয়েছে। এ সময় শিক্ষার্থীরা অবজ্ঞাসূচক ‘বু’ শব্দ করার পাশাপাশি জোরে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের বিক্ষোভে সর্বশেষ যোগ দিয়েছেন দ্য সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের (সিইউএনওয়াই) শিক্ষার্থীরা। সেখানকার শত শত শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। এসব তাঁবুতে তারা বর্ণবাদীদের জন্য কোনও বিনিয়োগ নয় লেখা ব্যানারও প্রদর্শন করছে।
সিইউএনওয়াই বিক্ষোভের ছাত্র সংগঠক গ্যাবি অ্যাওসে বলেছেন, ফিলিস্তিনের পক্ষে তরুণ-তরুণীদের এ সমাবেশ দেখতে বেশ লাগছে। তিনি আরও বলেন, অবশেষে তরুণ প্রজন্ম জেগে উঠতে শুরু করেছে। তারা এখন ইসরায়েলের দখলদারিত্বের অবসানের দাবি করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সর্বত্রই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের দমাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অনেক স্থানে পুলিশকে বেশ আগ্রাসী ভূমিকা নিতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ফ্যাকাল্টি সদস্যদেরও পুলিশ আটক করেছে। এরই মধ্যে এই বিক্ষোভ কানাডের এক বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়েছে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ। মার্কিন ক্যাম্পাসের আন্দোলনের মিল রেখে ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও তাঁবু টানিয়ে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আন্দোলনে বসেছেন শিক্ষার্থীরা।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীরা ম্যাকগিল এবং কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র এবং ইহুদিবাদী একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে তহবিল প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর এভাবে তাঁবু টানানো অনুমোদিত নয়। এই ধরনের কার্যকলাপ যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো মুখোমুখি পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ফিলিস্তিনি যুব আন্দোলন মন্ট্রিয়েল শাখা অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থান (তাঁবুতে) কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। গ্রুপটি বলছে, তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে গণহত্যায় অংশীদার হতে দিতে চায় না। ফিলিস্তিনপন্থী একাধিক গ্রুপ এই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে আসছে।
ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা শিক্ষার্থীদের অন্দোলন সম্পর্কে অবগত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন যে পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে অনুমোদন করে সেই সীমা পর্যন্ত তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে তারা সম্মান করবে।
মার্কিন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভের পর এখন আন্দোলন গতি পাচ্ছে ফ্রান্সেও। বিগত প্রায় সাত মাস ধরে চলতে থাকা গাজা যুদ্ধের প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। বার্লিনে পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে তাঁবু স্থাপন করেছেন যুদ্ধবিরোধী কর্মীরা। তারা জার্মান সরকারের কাছে ইসরায়েলে অস্ত্র রফতানি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
প্যারিসের নামকরা সায়েন্সেস পো ইউনিভার্সিটিতে মূল ভবনের বাইরে শুক্রবার শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের কারণে কেন্দ্রীয় ক্যাম্পাসে কোনও ক্লাস হয়নি। তাই, কর্তৃপক্ষ অনলাইনে ক্লাস নিতে বাধ্য হয়েছে।
সুইডেনেও শনিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে গাজার যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ। বিক্ষোভে জনতা ফিলিস্তিন স্বাধীন কর এবং ইসরায়েলকে বয়কট কর স্লোগান দিয়েছেন। এছাড়া শনিবার বিকালে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে শত শত লোক সমাবেশে জড়ো হন। লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে যুদ্ধবিরোধী সমাবেশের অংশ হিসাবে পার্লার্মেন্ট হাউজের ঠিক বাইরে যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে সবাই অংশ নেন। এ সমাবেশের আয়োজক প্যালেস্টাইন সলিডারিটি ক্যাম্পেইনের পরিচালক বেন জামাল বলেন, সারা যুক্তরাজ্য থেকে হাজার হাজার মানুষ এতে যোগ দেবেন বলেই তিনি আশা করেছিলেন। তিনি বলেন, আবারও আমরা দুটি বার্তা দিতে চাই। একটি হচ্ছে ফিলিস্তিনের জনগণকে আমরা আমাদের একাত্মতার বার্তা দিতে চাই। তাদের আমরা বলছি, আমরা আপনাদের দেখছি, আপনাদের শুনতে পাচ্ছি এবং আপনাদের সঙ্গে আমরা রয়েছি।
জামাল বলেন, দ্বিতীয় বার্তাটি হচ্ছে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের উদ্দেশে। তারা যেন ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের গণহত্যার প্রশ্নে নিজেদের জটিল অবস্থানের সমাপ্তি ঘটান।
এর আগে শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের (ইউজিসি) শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন। যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের মতো তারাও ইউজিসির কক্ষ দখল করে ৩৪ দিনের কর্মসূচি শুরু করেছেন। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা এ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের পক্ষে অনেক অনেক সমর্থন রয়েছেন। যেভাবে আমাদের আন্দোলন দানা বাঁধছে তাতে আমরা সবাই খুব উৎফুল্ল। এ আন্দোলনের আয়োজকদের একজন বলেন, আমরা ম্যানজমেন্টের সঙ্গে আলোচনার জন্য সঠিক চ্যানেল ধরেই এগিয়ে যাব। আমরা আনুষ্ঠানিক ভাবেই সব কাজ করার চেষ্টা করব। সেই সঙ্গে প্রয়োজনে ক্ষেত্র বিশেষে আমরা নিজেরাও যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করব। যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে ইউজিসির জটিলতা দূর করতে আমরা সম্ভাব্য সব রাস্তাই অবলম্বন করব।
গাজা যুদ্ধে ইসরাইলি হামলায় ৩৪ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহতের প্রতিবাদে এবং ইসরাইলি বাহিনী ও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের মধ্যে একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসব বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিক্ষোভ থেকে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলা প্রতিবাদে অংশ নেওয়া বিক্ষোভকারীরা ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির দাবি জানাচ্ছে। পাশাপাশি তারা যেসব কোম্পানি ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক ত্যাগ করার দাবি জানাচ্ছে। ইসরাইলকে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা বন্ধেরও দাবি জানাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যেসব শিক্ষার্থী ও ফ্যাকাল্টি সদস্যদের প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার জন্য বহিষ্কার বা শাস্তি দেওয়া হয়েছে তাদের সাধারণ ক্ষমার দাবি। সূত্র: সিজিটিএন, ন্যানশাল নিউজ
বিজনেস আওয়ার/২৯ এপ্রিল/ রহমান