বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ব্যাংক তার স্বাধীন সত্তা হারিয়ে ফেলেছে বলে মন্তব্য করেছেন সেন্ট্রার ফর পালিসি ডায়লগ-সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক মেরুদণ্ড সোজা রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে না। বাইরে থেকে আরোপিত সিদ্ধান্ত কার্যকর করার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
শনিবার (১৮ মে) ডিবেট ফর ডেমোক্রোসি’র আয়োজনে ব্যাংক একীভূতকরণের সুফল নিয়ে আয়োজিত ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তিনি এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) আয়োজিত ‘ব্যাংক একীভূতকরণ অর্থনীতিতে সুফল বয়ে আনবে’ শীর্ষক ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় পক্ষে অবস্থান নেয় বেগম নেয় বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ। বিপক্ষে তেজগাঁও কলেজের বিতার্কিকরা অংশগ্রহণ করেন।
এ সময় ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে নৈরাজ্য এমন পার্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, আইএমএফের পরামর্শক্রমে ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হচ্ছে। তবে যথেষ্ট পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় একীভূতকরণ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
তিনি বলেন, জোর করে ব্যাংক একীভূতকরণ টেকসই হতে পারে না। সুশাসনের অভাবে সামগ্রিক অর্থনীতিকে সাপোর্ট দেওয়ার সক্ষমতা ব্যাংকিং সেক্টর হারিয়েছে। জনগণ ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা হারিয়েছে। ব্যাংকে গচ্ছিত আমানত নিরাপদ রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারছে না। ফলে আমানতকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। যাদের কারণে ব্যাংকিং খাতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। ব্যাংকের খেলাপি ঋণের সঠিক তথ্য জনগণ জানতে পারছে না।
সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, আইএমএফ ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের কারণে অনেক শর্ত জুড়ে দিয়েছে। তাদের শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা। খেলাপি ঋণ এক অঙ্কে নিয়ে আসা (যদিও রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ২৫ থেকে ২৭ শতাংশ), আর্থিকখাতের দুর্বলতা কাটানো। এ কারণেই দুর্বলের সঙ্গে সবলের একীভূতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
‘তবে এখানে একীভূত নিয়ে খুব বেশি তাড়াহুড়ো করা হয়েছে। কিন্তু একীভূত করতে দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়া নিতে হয়। দ্রুত মার্জারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, একটা ব্যাংক তো ঘোষণাই দিয়ে দিলো। সেই ব্যাংকটির (এক্সিম) অবস্থা কি খুব বেশি ভালো? দ্রুত একীভূতের কারণে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক পিছু হটছে।’ যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, এখন ব্যাংকে আমানকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তারা কোথায় টাকা রাখবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। একীভূত করার পরপরই আমানতকারীদের আস্থা উঠে যায়নি, এটা অনেক আগেই হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আস্থা ফেরাতে বা আমানতকারীদের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। এখন আর্থিক খাতের সুশাসন ফেরাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন।
সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ঋণ জালিয়াতি, ঋণখেলাপি, অর্থপাচার বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় কালো দাগ। ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে ব্যক্তি বিশেষের আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস দেশের অর্থনীতিতে ক্যানসারের আকার ধারণ করেছে। আর্থিক খাতের এই ক্যানসারের চিকিৎসা না করে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল বা ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণ কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর সুফল পাওয়া যাবে কি না তা বুঝতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
‘তবে দেশের আর্থিক খাতের অস্থিরতার দায় বাংলাদেশ ব্যাংক এড়াতে পারে না। নানান আইনি সুবিধা দিয়ে ব্যাংকগুলোকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। সুশাসন ও জবাবদিহির ঘাটতি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে খাদের কিনারায় নিয়ে গেছে। তাই ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চলমান সংকট উত্তরণের যে প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে তার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা খুবই জরুরি। ঋণ জালিয়াতকারী ও অর্থপাচারকারীদের সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের নাগরিক সুবিধা সীমিত করা উচিত। আমরা দেখি ঋণখেলাপি ও অর্থপাচারকারীরা এয়ারপোর্টে ভিআইপি হিসেবে যাতায়াত করছে। ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা কোনো না কোনোভাবে চিহ্নিত আর্থিক দুষ্কৃতকারী।’ বলেন তিনি।
হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ব্যাংক খাত আজ তছনছ হয়ে গেছে। বেসিক ব্যাংক লুট হয়েছে, পদ্মা ব্যাংক লুট হয়েছে, ইউনিয়ন ব্যাংকে ভল্ট কেলেঙ্কারির কথা সবার জানা আছে। আর ন্যাশনাল তো জন্ম থেকেই জ্বলছে। ফলে দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায় যে কয়টি ব্যাংক দেওয়া হয়েছিল তার সব কয়টিই খুবই দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। এসব ব্যাংকের মালিকদের শুরু থেকেই উদ্দেশ্য ছিল লুটপাট করা। এখন এক্সিমের মঙ্গে পদ্মা ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। এতে এক্সিম পদ্মায় ডুবে যায় কি না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। আবার এক্সিম ব্যাংকেরই বা কী অবস্থা তা নিয়েও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ করতে না দেওয়া নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। যার ব্যাখ্যা বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া উচিত। আমাদের মনে রাখতে হবে সরকারের উন্নয়নে সহায়ক হিসেবে কাজ করে গণমাধ্যম। দেশের আর্থিক খাতের বড় বড় অনিয়মের সংবাদ প্রকাশ করে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছেন সাংবাদিকরা। বাজেটকে সামনে রেখে আর্থিক খাতের নানান তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে গণমাধ্যমে প্রকাশ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নিয়ে যে বাধা রয়েছে তা অচিরেই দূর করা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, ভল্টের সোনা খোয়া যাওয়া, ঋণখেলাপি, ঋণ জালিয়াতি, অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অনিয়ম গণমাধ্যমে তুলে ধরা তো সাংবাদিকদের অপরাধ নয়, বরং পেশাগত দায়িত্ব।
আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা বজায় রেখে ব্যাংক একীভূতকরণের মাধ্যমে গ্রহকদের আস্থা ধরে রাখতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির পক্ষ থেকে১০ দফা সুপারিশ করা হয়। প্রতিযোগিতায় বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের বিতার্কিকদের পরাজিত করে তেজগাঁও কলেজের বিতার্কিকরা বিজয়ী হন।
প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, ড. এস এম মোর্শেদ, আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞ মাহাবুব এইচ মজুমদার, সাংবাদিক দৌলত আক্তার মালা, সাংবাদিক মো. আলমগীর হোসেন। প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ীদলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।
বিজনেস আওয়ার/১৮ মে/ রহমান