বিজনেস আওয়ার ডেস্ক: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পর কে? তার দলের ‘সাকসেসন প্ল্যান’টা কী? লখনৌ থেকে দিল্লি পর্যন্ত বিজেপির নেতৃত্ব এই বিষয়টি নিয়েই কথা বলতে নারাজ। প্রসঙ্গ উঠলেই যেন বিব্রতবোধ করেন তারা। কিন্তু এবারের নির্বাচনী মৌসুমে ইস্যুটি প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন আম আদমি পার্টির নেতা ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে কদিন আগে তার প্রথম সাংবাদিক বৈঠকেই কেজরিওয়াল মনে করিয়ে দিয়েছেন, আগামী বছরই নরেন্দ্র মোদী ৭৫ বছরে পা রাখবেন, যেটা অলিখিতভাবে তার নিজেরই বেঁধে দেওয়া রাজনৈতিক অবসরের বয়স।
কেজরিওয়াল প্রশ্ন তুলেছেন, আগামী বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর তো মোদীজিকেও (তার নিজের করা নিয়ম অনুযায়ী) অবসরে যেতে হবে। তাহলে তারপর কে?
মোদী সামনের বছর অবসরে গেলে মন্ত্রিসভায় অলিখিত দু’নম্বর অমিত শাহই দায়িত্বে আসবেন, এমনও ইঙ্গিত করেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। এমনকি তৃতীয়বার মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দুই মাসের মধ্যে উত্তর প্রদেশের দায়িত্ব থেকে যোগী আদিত্যনাথকে সরানো হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিজেপির অভ্যন্তরে ‘মোদীর উত্তরাধিকারী বিতর্ক’ উসকে দেওয়াই যে তার উদ্দেশ্য ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেটি যে বেশ সফলও হয়েছে, তা বোঝা গেছে অমিত শাহ বা রাজনাথ সিংয়ের মতো দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা এর উত্তর দিতে বাধ্য হওয়ায়।
তারা দুজনই প্রকাশ্যে জানিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদী অবশ্যই প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ পূর্ণ করবেন। তার মাঝপথে অবসরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
কিন্তু এর ফাঁকে বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক চর্চা শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে- বিজেপির ভেতরে যেমন, তেমনি বাইরেও।
৭৫ পূর্ণ হলে নরেন্দ্র মোদী অবসর নেন বা না নেন, দলে তার পরে কে সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্বে আসবেন সেই প্রশ্নটা এর মাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে।
আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’গত সপ্তাহে একটি নিবন্ধে সোজাসুজি লিখেছে, ভারতের ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে একটি নেতৃত্বের লড়াই দানা বাঁধছে।
যোগী আদিত্যনাথ (বয়স ৫১)
২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশ বিধানসভায় বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জেতার পর দল যখন মুখ্যমন্ত্রী পদে যোগী আদিত্যনাথকে বেছে নেয়, কেউ ধারণাও করতে পারেনি, রাজ্যে তাকেই সরকার চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হবে। বস্তুত আদিত্যনাথ ওই নির্বাচনে নিজে লড়েনওনি।
পরের সাত বছরে বিতর্কিত এই গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী নেতা এবং হিন্দুদের গোরক্ষনাথ মঠের মহন্ত (প্রধান) উত্তর প্রদেশে বিজেপির এক নম্বর মুখ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ২০২২ সালের নির্বাচনে তিনি বিজেপিকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতাও এনে দিয়েছেন, যা ওই রাজ্যের রাজনীতিতে খুবই বিরল।
‘দিল্লি মে মোদী, লখনৌ মে যোগী’ বিজেপির খুব জনপ্রিয় একটি স্লোগানে পরিণত হয়েছে। বিজেপির কথিত ‘ডাবল ইঞ্জিনে’র (অর্থাৎ কেন্দ্রে ও রাজ্যে যখন একই দলের সরকার) আদর্শ মডেল হিসেবেও তুলে ধরা হচ্ছে উত্তর প্রদেশকে।
বলা হয়, মোদী-যোগীর এই ‘অসাধারণ জুটি’ই বিজেপির সাফল্যের সেরা রেসিপি। এবারের ভোটেও রাজ্যে সব ব্যানার-ফেস্টুন-পোস্টারে মোদীর ঠিক পরেই দেখা যাচ্ছে যোগীর ছবি, যদিও আকারে একটু ছোট।
গত দু-তিন বছরে যোগীর সমর্থকরা এ কথাও বলতে শুরু করেছেন, মোদীজির পর দলের হাল ধরার জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি অবশ্যই যোগীজি!
বস্তুত প্রশাসনে এক ধরনের উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও একই সঙ্গে তীব্র মুসলিমবিরোধী পথ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ বিজেপির ‘কোর ভোটব্যাংকের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই বাড়াতে পেরেছেন, তাতে সন্দেহ নেই।
নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের বাড়িঘর বা দোকান ভেঙেছে যোগীর বুলডোজার, রাজ্যের প্রায় সব কসাইখানাও তিনি বন্ধ করে ছেড়েছেন। আর এসব পদক্ষেপের প্রায় সবই নেওয়া হয়েছে বেছে বেছে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে।
কিন্তু তা-ই বলে মোদীর উত্তরসূরী হিসেবে তিনি নিজের নাম পাকা করে ফেলেছেন, এটি বিজেপিতেই অনেকে মানেন না।
লখনৌতে দলের এক প্রথম সারির নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছিলেন, আসলে দুটো জিনিস যোগীর বিপক্ষে যাবে। এক, তিনি কখনোই পুরোপুরি বিজেপির লোক নন। তার নিজস্ব হিন্দুত্ববাদী নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণ আলাদা, যার সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই।
‘আর দু’নম্বর হলো- যোগীজি আজ পর্যন্ত কোনোদিন আরএসএসের কোনো শাখায় যাননি, খাকি হাফপ্যান্টও পরেননি (একদা যা ছিল সঙ্ঘের ইউনিফর্ম)। সঙ্ঘের হাত মাথায় না-থাকলে বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বে যাওয়া বোধহয় আজও অসম্ভব।’
অমিত শাহ (বয়স ৫৯)
গত ১৬ মে ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘তিনি লোকজনকে ভয় দেখাতে ভালোবাসেন : যেভাবে মোদীর ডান হাত, অমিত শাহ, ভারতকে চালান!’
ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, গত ৪০ বছর ধরে অমিত শাহ নরেন্দ্র মোদীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুচর, উপদেষ্টা এবং এক কথায় সব কাজের কাজী! আর এই মুহূর্তে তিনি ভারতবর্ষের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তিও।
নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই বিজেপির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন অমিত শাহ। দ্বিতীয় মেয়াদে মোদী তাকে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ক্যাবিনেটে অঘোষিত দু’নম্বর ব্যক্তি করে নিয়ে আসেন।
অমিত শাহকে অনেকেই নরেন্দ্র মোদীর ‘অল্টার ইগো’ বা বিকল্প সত্ত্বা বলেও বর্ণনা করেছেন।
নরেন্দ্র মোদীর সম্পর্কে একটি কথা চালু রয়েছে, তার ডান হাত কী করছে সেটা বাম হাতও না কি জানতে পারে না। বিজেপির একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী একবার বলেছিলেন, বাম হাত না-জানতে পারে, কিন্তু অমিত শাহ অবশ্যই জানবেন!
উত্তরসূরী বাছাই করার প্রশ্ন এলে নরেন্দ্র মোদীর মতামতই যদি প্রাধান্য পায়, তাহলে তিনি শেষ পর্যন্ত অমিত শাহকেই বেছে নেবেন এমন একটা ধারণাও বিজেপির অন্দরে বেশ চালু।
অমিত শাহ নিজে আরএসএসেরও বেশ ঘনিষ্ঠ। খুব ছোটবেলা থেকে গুজরাটে বাড়ির কাছে আরএসএস শাখায় তার যাতায়াত, সঙ্ঘের প্রচারক হিসেবেও তিনি বহুদিন কাজ করেছেন।
‘দ্য প্রিন্টে’র রাজনৈতিক সম্পাদক ডি কে সিং বলেন, যেভাবে এবার বিজেপি লাখ লাখ ভোটে জেতা বহু জনপ্রিয় এমপি’কেও কিট দেয়নি, কিংবা মাসকয়েক আগে শিবরাজ সিং চৌহানের মতো সিনিয়র নেতাকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে ছেঁটে ফেলেছে, তাতে মনে করা যেতেই পারে, সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সামান্যতম দাবিদার হতে পারেন এমন সবাইকেই ধীরে ধীরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
‘এখন আমাকে দয়া করে বলতে যাবেন না, এগুলো সব হচ্ছে বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডার নির্দেশে, যোগ করেন তিনি। তার ইশারা কার দিকে, তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না।
রাজনাথ সিং (৭২)
উত্তর প্রদেশের প্রবীণ বিশ্লেষক ও ‘নিউজট্র্যাকে’র মুখ্য সম্পাদক যোগেশ মিশ্র কিন্তু মোদীর সম্ভাব্য উত্তরসূরী হিসেবে তৃতীয় একজনের নামও দেখছেন– সেটি রাজনাথ সিংয়ের।
রাজনাথ এই মুহূর্তে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। মোদীর প্রথম মেয়াদে ছিলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকারেও তিনি ক্যাবিনেটের সদস্য ছিলেন, যে অভিজ্ঞতা আজকের বিজেপিতে প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে আর কারোরই নেই। রাজনাথ সিং লখনৌ আসন থেকে নির্বাচিত বহু বছরের এমপি, বিজেপির সাবেক সভাপতিও বটে।
যোগেশ মিশ্রের কথায়, নরেন্দ্র মোদী সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করেন ফিসফিসানিকে। তিনি চমক দিতে খুব পছন্দ করেন। আর যেটা নিয়ে আগে থেকেই জল্পনা চলছে সেটাই করা তার ঘোরতর অপছন্দ! আর যেহেতু যোগী বা অমিত শাহর নাম নিয়ে এখন থেকেই এত চর্চা, তাই হয়তো দেখা যাবে তিনি এদের বাইরে সম্পূর্ণ অন্য একজনকে বেছে নিলেন!
আর ঠিক এখানেই রাজনাথ সিংয়ের ‘সম্ভাবনা’ দেখছেন পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ।
মনে রাখতে হবে, বিজেপির সভাপতি থাকাকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর নাম প্রস্তাব করেছিলেন রাজনাথই। নরেন্দ্র মোদী তখন গুজরাটের ১২ বছরের মুখ্যমন্ত্রী ঠিকই, কিন্তু সর্বভারতীয় স্তরের কোনও নেতা নন।
যদিও বাস্তবের রাজনীতিতে প্রতিদান বলে কিছু হয় না, তবে কৃতজ্ঞতার বশে মোদী হয়তো সে কথা মনে রাখতে পারেন। কিন্তু বয়সটা অবশ্যই রাজনাথ সিংয়ের বিপক্ষে যাবে, কারণ মোদীর চেয়ে তিনি মাত্রই বছরখানেকের ছোট।
রাজনাথ সিংয়ের অনুকূলে আরও দুটো ফ্যাক্টর কাজ করতে পারে – এক, তিনি সঙ্ঘের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং দুই, বিরোধী শিবিরের বহু নেতা-নেত্রীর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব হৃদ্যতার।
বিজেপি যখন ক্ষমতায়, তখন প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রীর মতো শীর্ষ পদগুলোতে আরএসএস সব সময় নিজেদের বিশ্বস্ত লোকজনকেই বসাতে চেয়েছে। ফলে এখানেও যোগী আদিত্যনাথের তুলনায় রাজনাথ এগিয়ে থাকবেন।
তার আর একটা বড় সুবিধা হল, কলকাতায় মমতা ব্যানার্জীই হোন বা মুম্বাইতে উদ্ধব ঠাকরে – বিরোধী শিবিরের এই নেতাদের সঙ্গে রাজনাথ সিং যেকোনো সময় যেকোনো বিষয়ে ফোন ঘুরিয়ে কথা বলতে পারেন। রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকলেও বিরোধী দলীয় নেতানেত্রীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে রাজনাথ সিং কখনও তার প্রভাব পড়তে দেননি।
বিদায়ী লোকসভায় বহুজন সমাজ পার্টির এমপি দানিশ আলির কথায়, বিজেপিতে এক সময় সুষমা স্বরাজ বা অরুণ জেটলির মতো নেতারা যে কাজটা করতেন, অর্থাৎ সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে মানিয়ে-গুছিয়ে চলতে পারতেন– এখন সেটি করার মতো লোক আছেন কেবল রাজনাথ সিং।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
বিজনেস আওয়ার/২৫ মে/ হাসান