বিজনেস আওয়ার ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট। বিখ্যাত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিসহ গত অর্ধ শতকে অসংখ্য অনুসন্ধানী খবর প্রকাশ করে পুলিৎজার পুরস্কারের ভাণ্ডার বানিয়েছে পত্রিকাটি। অর্জন করেছে কোটি কোটি পাঠকের আস্থা। কিন্তু তারপরও গত কয়েক বছর আর্থিকভাবে সময়টা ভালো যায়নি না তাদের। গুণতে হয়েছে বিশাল অংকের লোকসান। এ কারণে ওয়াশিংটন পোস্টকে লাভের খাতায় ফিরিয়ে আনতে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছেন মালিক জেফ বেজোস। তার মধ্যেই একের পর এক বিতর্কে নাম জড়িয়েছে পত্রিকাটির শীর্ষ কর্তাদের। আর তাতে রীতিমতো টালমাটাল হয়ে পড়েছে ওয়াশিংটন পোস্টে।
বিতর্কের মুখে সিইও
সম্প্রতি আচমকা পদত্যাগ করেছেন ওয়াশিংটন পোস্টের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। বিতর্কের মুখে তার একজন নির্বাচিত উত্তরসূরিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের প্রধান নিজেই বিভিন্ন সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন।
এসব কাণ্ডের কেন্দ্রে রয়েছেন পত্রিকাটির নতুন সিইও ব্রিটন উইলিয়াম লুইস। গত শরতে তাকে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন অ্যামাজন প্রতিষ্ঠাতা বেজোস। ২০১৩ সালে ২৫ কোটি ডলারে পত্রিকাটি কিনে নিয়েছিলেন এ ধনকুবের।
লুইসকে ওয়াশিংটন পোস্টের সিইও নিয়োগের পাশাপাশি একটি বিশেষ দায়িত্বও দিয়েছিলেন বেজোস- পত্রিকাটিকে লাভের খাতায় ফিরিয়ে আনা। বিপুল সংখ্যক কর্মী ছাঁটাই এবং রোববারের ক্রোড়পত্র বাতিল করা সত্ত্বেও ২০২৩ সালে ৭ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার লোকসান গুনেছিল প্রতিষ্ঠানটি।
কিন্তু নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে ক্রমেই নড়বড়ে হয়ে উঠছিল লুইসের আসন। ১২ বছর আগে তিনি যখন মারডক পরিবারের মিডিয়া গ্রুপে কাজ করতেন, তখন ট্যাবলয়েড পত্রিকা দ্য নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধে অবৈধ ফোনকল ট্যাপিংয়ের অভিযোগ ওঠে। সেই কেলেঙ্কারির সঙ্গে লুইসের জড়িত থাকার খবর গত কয়েক সপ্তাহ ধরে মিডিয়া জগতে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। গত শুক্রবার তিনি নিজেদের সাংবাদিকদের কাছেই তদন্তের মুখে পড়েছিলেন।
ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্যমতে, লুইস ২০১১ সালে কয়েক হাজার ই-মেইল মুছে ফেলার অনুমতি দিয়েছিলেন। এর ফলে সন্দেহ তৈরি হয়, তিনি প্রমাণ ধ্বংস করছিলেন। যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন লুইস।
‘ট্রাম্প বাম্প’ গায়েব
হোয়াইট হাউজে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের মেয়াদকালে সবচেয়ে বেশি লাভবান হওয়া আস্থাভাজন সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে ওয়াশিংটন পোস্ট ছিল অন্যতম।
নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতার অধ্যাপক ড্যান কেনেডির কথায়, পত্রিকাটিকে এমন একটি জায়গা হিসেবে দেখা হচ্ছিল, যারা প্রকৃতপক্ষেই কঠিন ও সত্য কভারেজ দিতো।
কিন্তু ট্রাম্প বিদায় নেওয়ার পর থেকেই পাঠক আকৃষ্ট করার মতো প্রতিবেদনের ঘাটতিতে পড়ে ওয়াশিংটন পোস্ট।
অধ্যাপক কেনেডি বলেন, ‘ট্রাম্প বাম্প’ (ট্রাম্পের ধাক্কা) যেসব সংবাদপত্রকে সাহায্য করেছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে সেটিও অদৃশ্য হয়ে যায়। বিশেষভাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওয়াশিংটন পোস্ট।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের তথ্যমতে, ট্রাম্পের বিদায়লগ্নে পোস্টের সাবস্ক্রাইবার ছিল ৩০ লাখের বেশি। কিন্তু এক বছর পরেই, ২০২২ সালে তা ২৫ লাখে নেমে আসে।
একই সময়, প্রতিদ্বন্দ্বী নিউইয়র্ক টাইমসের সাবস্ক্রাইবার বেড়ে কোটিতে পৌঁছায়। কঠিন সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি গেম, খাবার-দাবার এবং লাইফস্টাইলের মতো মজাদার বিষয়গুলোতে বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে পত্রিকাটি বেশ লাভবান হয়।
চলতি মাসের শুরুর দিকে মার্কিন মিডিয়ায় খবর বেরোয়, ওয়াশিংটন পোস্টের সিইও তার সম্পাদকীয় বিভাগের কর্মীদের বলেছেন, পত্রিকাটি অনেক অর্থ হারিয়েছে এবং এর নিবন্ধগুলোর প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেছে, সেটি আর ঢেকে রাখা যাবে না।
তৃতীয় নিউজ টিম
উল্লেখিত এডিটোরিয়াল বৈঠকের আগের দিন ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিকরা জানতে পারেন, তাদের এডিটর-ইন-চিফ স্যালি বুজবি পদত্যাগ করেছেন।
শোনা যায়, পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগকে তিনভাগে ভাগ করার বিষয়ে সিইওর কৌশলের সঙ্গে একমত ছিলেন না বুজবি।
লুইসের পরিকল্পনা অনুসারে, পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগকে সংবাদ, মতামত এবং সোশ্যাল মিডিয়া ও সার্ভিস জার্নালিজম- এই তিনটি ইউনিটে ভাগ করা হবে। এই ‘তৃতীয় ইউনিট’ গঠনের বিষয়টি এখনো অস্পষ্টই রয়ে গেছে। তবে এটি সংবাদপত্রের পাঠক বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বলে মনে করা হচ্ছে।
বুজবির জায়গায় নিজের সাবেক সহকর্মী রবার্ট উইনেটকে বসাতে চেয়েছিলেন সিইও লুইস। কিন্তু সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াশিংটন পোস্টের অনুসন্ধানে উঠে আসে, লুইস এবং উইনেটের অধীনে কিছু ‘সন্দেহজনক পদ্ধতি’ অনুসরণ করা হয়েছিল।
তথ্যদাতাদের অর্থ প্রদান, হ্যাক হওয়া ফোন থেকে ডেটা ব্যবহার করা এবং তথ্য পাওয়ার জন্য মিথ্যা পরিচয়ের ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে।
এসব তথ্য সামনে আসার পর উইনেটকে ওয়াশিংটন পোস্টে নিয়োগের পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে।
অধ্যাপক কেনেডির বিশ্বাস, এখন লুইসেরও পদত্যাগ করা ছাড়া উপায় নেই। কারণ তিনি সেখানকার সহকর্মীদের আস্থা হারিয়েছেন।
ফেসবুকে কেনেডি লিখেছেন, তিনি (সিইও) যদি কর্মীদের অনুপ্রাণিত করতে না পারেন… পত্রিকাটি দিকনির্দেশনা ছাড়াই চলবে এবং এর সেরা লোকগুলো চলে যাবে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, লুইসের ভাগ্য এখন মূলত জেফ বেজোসের হাতে। যদিও এখন পর্যন্ত সিইও’কে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন এ মার্কিন ধনকুবের।
সূত্র: এএফপি
বিজনেস আওয়ার/২৯ জুন/ হাসান