ঢাকা , রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফেনীতে এখনো কমেনি দুর্ভোগ

  • পোস্ট হয়েছে : ০১:২৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৪
  • 109

বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক: ফেনীতে ভয়াবহ বন্যায় ভেঙে গেছে রাস্তা-ঘাট। ভেসে গেছে ঘরবাড়ি, গবাদিপশু ও পুকুরের মাছ। জেলার পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও সদরের বেশিরভাগ সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। রেললাইন থেকে পাথর সরে গেছে। এখনো ডুবে আছে দাগনভূঞা ও সোনাগাজীর বেশিরভাগ এলাকা। সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও লাখ লাখ মানুষ স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মাদরাসা বা উঁচু ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন।

সবচেয় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সীমান্তবর্তী পরশুরামের বাউরপাথর, সলিয়া, অনন্তপুর, চিথলিয়া, অলকা, নোয়াপুর, ধনিকুন্ডা, দুর্গাপুর, কাউতলী, চম্পকনগর ও সাতকুচিয়া গ্রাম। একইভাবে ফেনী সদর উপজেলার মোটবী লক্ষ্মীপুর, বাঘাইয়া, সাতসতি, ইজ্জতপুর, শিবপুর, বটতলি এলাকাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তবে জেলায় কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এখনো সেই তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি সরকারি বিভিন্ন দপ্তর। জেলা প্রশাসন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর এবং সড়ক ও জনপদ বিভাগ বলছে, তথ্য সংগ্রহ চলছে। অল্প সময়ের মধ্যে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।

ত্রাণের জন্য হাহাকার
ত্রাণের জন্য হাহাকার জেলার সর্বত্র। জেলার পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া থেকে পানি সরে গেলেও ত্রাণ পৌঁছানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। সড়কের বেশিরভাগ অংশ পানিতে ভেসে গেছে। সড়ক বা হাট-বাজারে ত্রাণ পৌঁছালেও দুর্গম এলাকায় এখনো পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছায়নি। একই অবস্থা ফেনী সদর উপজেলায়। এখানকার মোটবী, ফাজিলপুর, ছনুয়া ও ধলিয়া ইউনিয়নের দুর্গম এলাকার অসংখ্য মানুষ ত্রাণ পাননি বলে অভিযোগ করেন।

এদিকে জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা সূত্র জানায়, সোমবার পর্যন্ত নগদ ৪০ লাখ টাকা এবং দুই হাজার টন চাল ত্রাণকার্যের জন্য বরাদ্দ এসেছে। আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে খিচুড়ি ও শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার জানান, এ পর্যন্ত ৬০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিভিন্নভাবে বিতরণ করা হয়েছে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও র্যাব হেলিকপ্টারের সহায়তায় আরও ৩৮ হাজার প্যাকেট খাদ্যদ্রব্য মানুষের হাতে পৌঁছে দিয়েছে। এর বাইরেও ব্যক্তিগতভাবে বন্যাকবলিতদের কাছে খাদ্যপণ্য পৌঁছে দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবকরা।

প্রাণহানির তথ্য নেই জেলা প্রশাসনে
গত মঙ্গলবার থেকে জেলায় ১০ জনের মতো মারা গেছেন বলে নানাভাবে বলা হলেও জেলা প্রশাসকের কাছে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। নিখোঁজের বিষয়ে তথ্যও দিতে পারেনি জেলা প্রশাসন।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার জানান, বন্যার পানি সরে গেলে সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে। সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড, র্যাব, ফায়ার সার্ভিস এবং ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে উদ্ধারকাজ চলমান রয়েছে।

বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও বাড়ছে ভোগান্তি
এখনো অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ রয়েছে। গ্রামে চরম খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রামের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ও মালামাল না থাকায় বানভাসি মানুষরা কিনেও খেতে পারছেন না। অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রয়েছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে খুবই ধীরগতিতে গাড়ি চলছে। বন্যার স্রোতে সড়কে বড় বড় খানাখন্দ সৃষ্টি হওয়ায় যান চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন হচ্ছে। প্লাবিত ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া উপজেলায় কোথাও কোথাও এখনো পানি রয়েছে। যেখানে পানি নেমেছে সেখানে ক্ষতচিহ্ন দৃশ্যমান হচ্ছে। ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়া, মোটবী ও ফাজিলপুরের বিভিন্ন গ্রামে এখনো বুক সমান পানি। সেখানে এখনো মানুষ পানিতে আটকে আছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক জানান, পানিবন্দি দেড়লাখ মানুষকে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। বানভাসি মানুষের খাবার পৌঁছানো হচ্ছে। দুর্গম এলাকায় হেলিকপ্টারে করে খাবার পাঠানো হচ্ছে।

ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা
বন্যায় ফেনী জেনারেল হাসপাতালসহ বেশিরভাগ হাসপাতালের নিচতলা পানিতে তলিয়ে যায়। এতে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। তবে শহরসহ জেলার ছয় উপজেলায় বিশেষ মেডিকেল টিম কাজ করছে। সরকারি মূল্যে চিকিৎসা দিতে শহরের সাতটি হাসপাতালকে ডেডিকেটেড ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ।

এছাড়াও কনসেপ্ট হাসপাতাল, মেডিনোভা হাসপাতাল মেডিল্যাব, আল আকসা হাসপাতাল, জেড ইউ মডেল হাসপাতাল, মিশন হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মেডিকেল ক্যাম্প চালু রয়েছে।

ফেনী সদর হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগী ও স্বজনরা জানান, বুধবার থেকে হাসপাতালে বিদ্যুৎ নেই। বাথরুমে পানি নেই। ছিল না কোনো চিকিৎসকও। পাওয়া যায়নি সরকারি খাবার ও ওষুধ। তবে মাঝেমধ্যে স্বেচ্ছাসেবকদের থেকে পাওয়া শুকনো খাবারে দিন পার করতে হচ্ছে।

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা আসিফ ইকবাল বলেন, দুর্যোগকালীন সময়ে চিকিৎসার জন্য ফেনীর ৭ হাসপাতালকে ডেডিকেটেড ঘোষণা করা হয়েছে। এসব হাসপাতালে সরকারি ৩০ চিকিৎসককে রোস্টার দায়িত্ব দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ভর্তি হওয়া রোগীদের সরকারি মূল্যে সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক ডা. ইফতেখার আহমদ বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে চিকিৎসক এনে ফেনীতে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। আমরা দ্রুত ফেনী জেনারেল হাসপাতালসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাভাবিক কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছি।

অচল মোবাইল ফোনের টাওয়ার
এখনো অচল ফেনীর ৭৫ শতাংশের বেশি মোবাইল ফোনের টাওয়ার। তবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে ক্ষতিগ্রস্ত মোবাইল টাওয়ারগুলোর কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার চেষ্টা করছে বিটিআরসি।

বিটিআরসি সূত্র জানায়, নেটওয়ার্ক সচল করতে মোবাইল অপারেটর রবি এবং টাওয়ার অপারেটর সামিট ও ইডটকোর সঙ্গে সমন্বয় করে ফেনীর ফুলগাজী, সোনাগাজী, ছাগলনাইয়ায় দুটি স্পিডবোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ায় মোবাইল অপারেটর বাংলালিংককে গাড়ি দেওয়া হয়েছে।

এদিকে সোমবার রাত থেকে ফেনীর বিভিন্ন এলাকায় নেটওয়ার্ক সচল হয়েছে। ফেনী সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নেটওয়ার্ক সচল হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছে।

দেশে ১৪ হাজার ৫৫১টি মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার রয়েছে। এরমধ্যে এক হাজার আটটি বর্তমানে অচল। এগুলোর বেশিরভাগ ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট ও কক্সবাজারে বলে জানা গেছে।

স্বজনদের খুঁজছেন অনেকে
ফেনীতে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও স্বজনদের খুঁজছেন অনেকে। বাড়ির পাশের আশ্রয়কেন্দ্র, হাসপাতালে গিয়ে না পেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে পরিবারের সদস্যদের খুঁজছে মানুষ।

ফেনী সদর হাসপাতালে নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে আসা আবু রায়হান বলেন, আকস্মিক বন্যার আঘাতের সময় পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বাড়ির বাইরে ছিলেন। পরে তাদের অনেকেই আর বাড়ি ফিরতে পারেননি। শনিবার থেকে আমাদের এলাকায় পানি বাড়তে থাকে। এরপর থেকে আমার সন্তানকে খুঁজে পাচ্ছি না। আমি বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছি।

বন্যাকবলিত এলাকায় উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া একাধিক স্বেচ্ছাসেবী জানান, নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে অনেক সময় পুরো পরিবারকে একসঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া সম্ভব হয় না। শিশু, বৃদ্ধ ও নারীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। পুনরায় এসে সম্ভব হলে পরিবারের বাকি সদস্যদের উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়। ফলে এক পরিবারের সদস্যরা বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন।

গত ২০ আগস্ট থেকে টানা বৃষ্টি ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ফেনীতে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। এ অঞ্চলের মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়ে জেলার ১০৮ গ্রাম তুলিয়ে যায়। পানিবন্দি হয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষ।

বিজনেস আওয়ার/২৭ আগস্ট/ রহমান

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান:
ট্যাগ :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার মেইলে তথ্য জমা করুন

ফেনীতে এখনো কমেনি দুর্ভোগ

পোস্ট হয়েছে : ০১:২৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৪

বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক: ফেনীতে ভয়াবহ বন্যায় ভেঙে গেছে রাস্তা-ঘাট। ভেসে গেছে ঘরবাড়ি, গবাদিপশু ও পুকুরের মাছ। জেলার পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও সদরের বেশিরভাগ সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। রেললাইন থেকে পাথর সরে গেছে। এখনো ডুবে আছে দাগনভূঞা ও সোনাগাজীর বেশিরভাগ এলাকা। সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও লাখ লাখ মানুষ স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মাদরাসা বা উঁচু ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন।

সবচেয় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সীমান্তবর্তী পরশুরামের বাউরপাথর, সলিয়া, অনন্তপুর, চিথলিয়া, অলকা, নোয়াপুর, ধনিকুন্ডা, দুর্গাপুর, কাউতলী, চম্পকনগর ও সাতকুচিয়া গ্রাম। একইভাবে ফেনী সদর উপজেলার মোটবী লক্ষ্মীপুর, বাঘাইয়া, সাতসতি, ইজ্জতপুর, শিবপুর, বটতলি এলাকাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তবে জেলায় কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এখনো সেই তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি সরকারি বিভিন্ন দপ্তর। জেলা প্রশাসন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর এবং সড়ক ও জনপদ বিভাগ বলছে, তথ্য সংগ্রহ চলছে। অল্প সময়ের মধ্যে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।

ত্রাণের জন্য হাহাকার
ত্রাণের জন্য হাহাকার জেলার সর্বত্র। জেলার পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া থেকে পানি সরে গেলেও ত্রাণ পৌঁছানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। সড়কের বেশিরভাগ অংশ পানিতে ভেসে গেছে। সড়ক বা হাট-বাজারে ত্রাণ পৌঁছালেও দুর্গম এলাকায় এখনো পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছায়নি। একই অবস্থা ফেনী সদর উপজেলায়। এখানকার মোটবী, ফাজিলপুর, ছনুয়া ও ধলিয়া ইউনিয়নের দুর্গম এলাকার অসংখ্য মানুষ ত্রাণ পাননি বলে অভিযোগ করেন।

এদিকে জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা সূত্র জানায়, সোমবার পর্যন্ত নগদ ৪০ লাখ টাকা এবং দুই হাজার টন চাল ত্রাণকার্যের জন্য বরাদ্দ এসেছে। আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে খিচুড়ি ও শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার জানান, এ পর্যন্ত ৬০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিভিন্নভাবে বিতরণ করা হয়েছে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও র্যাব হেলিকপ্টারের সহায়তায় আরও ৩৮ হাজার প্যাকেট খাদ্যদ্রব্য মানুষের হাতে পৌঁছে দিয়েছে। এর বাইরেও ব্যক্তিগতভাবে বন্যাকবলিতদের কাছে খাদ্যপণ্য পৌঁছে দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবকরা।

প্রাণহানির তথ্য নেই জেলা প্রশাসনে
গত মঙ্গলবার থেকে জেলায় ১০ জনের মতো মারা গেছেন বলে নানাভাবে বলা হলেও জেলা প্রশাসকের কাছে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। নিখোঁজের বিষয়ে তথ্যও দিতে পারেনি জেলা প্রশাসন।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার জানান, বন্যার পানি সরে গেলে সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে। সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড, র্যাব, ফায়ার সার্ভিস এবং ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে উদ্ধারকাজ চলমান রয়েছে।

বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও বাড়ছে ভোগান্তি
এখনো অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ রয়েছে। গ্রামে চরম খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রামের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ও মালামাল না থাকায় বানভাসি মানুষরা কিনেও খেতে পারছেন না। অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রয়েছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে খুবই ধীরগতিতে গাড়ি চলছে। বন্যার স্রোতে সড়কে বড় বড় খানাখন্দ সৃষ্টি হওয়ায় যান চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন হচ্ছে। প্লাবিত ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া উপজেলায় কোথাও কোথাও এখনো পানি রয়েছে। যেখানে পানি নেমেছে সেখানে ক্ষতচিহ্ন দৃশ্যমান হচ্ছে। ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়া, মোটবী ও ফাজিলপুরের বিভিন্ন গ্রামে এখনো বুক সমান পানি। সেখানে এখনো মানুষ পানিতে আটকে আছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক জানান, পানিবন্দি দেড়লাখ মানুষকে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। বানভাসি মানুষের খাবার পৌঁছানো হচ্ছে। দুর্গম এলাকায় হেলিকপ্টারে করে খাবার পাঠানো হচ্ছে।

ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা
বন্যায় ফেনী জেনারেল হাসপাতালসহ বেশিরভাগ হাসপাতালের নিচতলা পানিতে তলিয়ে যায়। এতে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। তবে শহরসহ জেলার ছয় উপজেলায় বিশেষ মেডিকেল টিম কাজ করছে। সরকারি মূল্যে চিকিৎসা দিতে শহরের সাতটি হাসপাতালকে ডেডিকেটেড ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ।

এছাড়াও কনসেপ্ট হাসপাতাল, মেডিনোভা হাসপাতাল মেডিল্যাব, আল আকসা হাসপাতাল, জেড ইউ মডেল হাসপাতাল, মিশন হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মেডিকেল ক্যাম্প চালু রয়েছে।

ফেনী সদর হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগী ও স্বজনরা জানান, বুধবার থেকে হাসপাতালে বিদ্যুৎ নেই। বাথরুমে পানি নেই। ছিল না কোনো চিকিৎসকও। পাওয়া যায়নি সরকারি খাবার ও ওষুধ। তবে মাঝেমধ্যে স্বেচ্ছাসেবকদের থেকে পাওয়া শুকনো খাবারে দিন পার করতে হচ্ছে।

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা আসিফ ইকবাল বলেন, দুর্যোগকালীন সময়ে চিকিৎসার জন্য ফেনীর ৭ হাসপাতালকে ডেডিকেটেড ঘোষণা করা হয়েছে। এসব হাসপাতালে সরকারি ৩০ চিকিৎসককে রোস্টার দায়িত্ব দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ভর্তি হওয়া রোগীদের সরকারি মূল্যে সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক ডা. ইফতেখার আহমদ বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে চিকিৎসক এনে ফেনীতে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। আমরা দ্রুত ফেনী জেনারেল হাসপাতালসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাভাবিক কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছি।

অচল মোবাইল ফোনের টাওয়ার
এখনো অচল ফেনীর ৭৫ শতাংশের বেশি মোবাইল ফোনের টাওয়ার। তবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে ক্ষতিগ্রস্ত মোবাইল টাওয়ারগুলোর কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার চেষ্টা করছে বিটিআরসি।

বিটিআরসি সূত্র জানায়, নেটওয়ার্ক সচল করতে মোবাইল অপারেটর রবি এবং টাওয়ার অপারেটর সামিট ও ইডটকোর সঙ্গে সমন্বয় করে ফেনীর ফুলগাজী, সোনাগাজী, ছাগলনাইয়ায় দুটি স্পিডবোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ায় মোবাইল অপারেটর বাংলালিংককে গাড়ি দেওয়া হয়েছে।

এদিকে সোমবার রাত থেকে ফেনীর বিভিন্ন এলাকায় নেটওয়ার্ক সচল হয়েছে। ফেনী সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নেটওয়ার্ক সচল হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছে।

দেশে ১৪ হাজার ৫৫১টি মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার রয়েছে। এরমধ্যে এক হাজার আটটি বর্তমানে অচল। এগুলোর বেশিরভাগ ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট ও কক্সবাজারে বলে জানা গেছে।

স্বজনদের খুঁজছেন অনেকে
ফেনীতে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও স্বজনদের খুঁজছেন অনেকে। বাড়ির পাশের আশ্রয়কেন্দ্র, হাসপাতালে গিয়ে না পেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে পরিবারের সদস্যদের খুঁজছে মানুষ।

ফেনী সদর হাসপাতালে নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে আসা আবু রায়হান বলেন, আকস্মিক বন্যার আঘাতের সময় পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বাড়ির বাইরে ছিলেন। পরে তাদের অনেকেই আর বাড়ি ফিরতে পারেননি। শনিবার থেকে আমাদের এলাকায় পানি বাড়তে থাকে। এরপর থেকে আমার সন্তানকে খুঁজে পাচ্ছি না। আমি বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছি।

বন্যাকবলিত এলাকায় উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া একাধিক স্বেচ্ছাসেবী জানান, নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে অনেক সময় পুরো পরিবারকে একসঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া সম্ভব হয় না। শিশু, বৃদ্ধ ও নারীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। পুনরায় এসে সম্ভব হলে পরিবারের বাকি সদস্যদের উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়। ফলে এক পরিবারের সদস্যরা বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন।

গত ২০ আগস্ট থেকে টানা বৃষ্টি ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ফেনীতে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। এ অঞ্চলের মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়ে জেলার ১০৮ গ্রাম তুলিয়ে যায়। পানিবন্দি হয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষ।

বিজনেস আওয়ার/২৭ আগস্ট/ রহমান

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান: