বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক: আওয়ামী লীগ সরকার তথা শেখ হাসিনা সরকারের আমলে চালু হওয়া সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যতদিন বিকল্প নতুন কোনো পদ্ধতি চালু না হচ্ছে ততদিন এই পেনশন স্কিম চালু রাখা হবে। সোমবার (৯ সেপ্টম্বর) অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সোমবার বৈঠকে বসেন। বৈঠকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে এখনো পর্যন্ত কী কী করা হয়েছে, সে বিষয়সহ সার্বিক বিষয় অর্থ উপদেষ্টার কাছে উপস্থান করা হয়। অর্থ উপদেষ্টার সম্মতিতে সর্বজনীন পেনশন স্কিম যেভাবে চলছে, সেভাবেই চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের গতি কিছুটা কমে গেছে। তবে এরই মধ্যে তা ৩ লাখ ৭২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আর চাঁদা জমা পড়েছে ১২৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকার ওপরে। এর মধ্যে ১১৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
সর্বস্তরের জনগণকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে গত বছর সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করে সরকার। গত বছরের ১৭ আগস্ট তৎকালীন প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন স্কিম উদ্বোধন করেন। এর পরপরই আবেদন শুরু হয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা— এই চার স্কিম নিয়ে সর্বজনীন পেনশন চালু করে সরকার।
পরবর্তীকালে সব স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীনস্থ অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ‘প্রত্যয় স্কিম’ নামে নতুন স্কিম চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। গত ১ জুলাই থেকে এই স্কিম কর্যকর হয়। তবে শিক্ষকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে প্রত্যয় স্কিম বাতিল করা হয়। সে হিসেবে বর্তমানে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা এই চারটি স্কিম চালু রয়েছে।
শুরুতে সর্বজনীন পেনশনে মানুষের ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেলেও মাঝে নিবন্ধনে কিছুটা ধীরগতি আসে। তবে চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে হু হু করে বাড়তে থাকে সর্বজনীন পেনশনে নিবন্ধন করে চাঁদা জমা দেওয়া মানুষের সংখ্যা। এপ্রিলে ৬০ হাজার মানুষ নিবন্ধন সম্পন্ন করেন। এতে ওই মাসে সর্বজনীন পেনশনে নিবন্ধনের সংখ্যা এক লাখের মাইলফলক স্পর্শ করে।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে চাঁদা পরিশোধ করে নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন ৩ লাখ ৭২ হাজার ৯৪ জন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২৩ কোটি ৫৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১১৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে
অর্থাৎ, সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর আট মাস পরে নিবন্ধন সম্পন্নকারীর সংখ্যা এক লাখ স্পর্শ করে। এরপর মে ও জুন মাসেও বিপুল পরিমাণ মানুষ নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা জমা দেন। এতে জুলাই মাস শুরু হতেই নিবন্ধন সম্পন্নকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ লাখ হয়ে যায়। আর জমা পড়া চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
তবে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের গতি বেশ কমে গেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান। এরপর এরই মধ্যে এক মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। অবশ্য শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের জোর আন্দোলন শুরু হয় জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই। ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের গতি কমতে থাকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জনা গেছে, ২ জুলাই দুপুর পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে চাঁদা পরিশোধ করে নিবন্ধন সম্পন্ন করেন ৩ লাখ ৪০ হাজার ২৪২ জন। আর তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ছিল ৯৯ কোটি ৮০ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে ৯২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়।
দুই মাস পর ৯ সেপ্টেম্বর বিকেল পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে চাঁদা পরিশোধ করে নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন ৩ লাখ ৭২ হাজার ৯৪ জন। আর তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২৩ কোটি ৫৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১১৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে। অর্থাৎ, গত দুই মাসে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে চাঁদা পরিশোধ করে নতুন নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন ৩১ হাজার ৮৫২ জন।
নিবন্ধনের গতি কমাটা স্বাভাবিক। কোন সেক্টরে এটার (আন্দোলন ও সরকার পতন) প্রভাব পড়েনি বলেন? সব ক্ষেত্রেই প্রভাব পড়েছে। এটা একটু সময় নেবে। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসবে। আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরু করবো, প্রচার বাড়বে। তখন আবার এটার (নিবন্ধন) গতি বাড়বে।- গোলাম মোস্তফা
নতুন নিবন্ধনকারীর সংখ্যা কমলেও পেনশন স্কিমে আগের মতোই নিবন্ধনের ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন দ্ররিদ্র মানুষ, যাদের বার্ষিক আয় সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা। এই আয়ের মানুষদের জন্য চালু করা হয়েছে সমতা স্কিম। এই স্কিমের মাসিক চাঁদার পরিমাণ ১ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৫০০ টাকা স্কিম গ্রহণকারী দেবেন এবং বাকি ৫০০ টাকা সরকার থেকে দেওয়া হবে। সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত এই স্কিমে নিবন্ধনকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৫ হাজার জন। আর জমা পড়া চাঁদার পরিমাণ ৪০ কোটি ৪৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ, পেনশন স্কিমে নিবন্ধন সম্পন্নকারীদের ৭৭ শতাংশই দরিদ্র মানুষ।
পেনশন স্কিম নিয়ে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে সোমবারের বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, আমাদের যে চারটি স্কিম রয়েছে সে সম্পর্কে এবং সার্বিক কার্যক্রম সম্পর্কে অর্থ উপদেষ্টাকে জানিয়েছি। একই সঙ্গে এ যাবত আমরা কী করেছি সেগুলো সম্পর্কেও অবহিত করেছি।
তিনি বলেন, আমরা সামনের দিনে কী করবো সে বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। আমরা কার্যক্রম অব্যাহত রাখবো। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা নতুন কোনো স্কিম ঘোষণা না করি, এই স্কিমগুলো যেভাবে আছে, সেভাবেই চলবে।
সরকার পতনের পর পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের গতি কমে আসার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, নিবন্ধনের গতি কমাটা স্বাভাবিক। কোন সেক্টরে এটার (আন্দোলন ও সরকার পতন) প্রভাব পড়েনি বলেন? সব ক্ষেত্রেই প্রভাব পড়েছে। এটা একটু সময় নেবে। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসবে। আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরু করবো, প্রচার বাড়বে। তখন আবার এটার (নিবন্ধন) গতি বাড়বে।
পেনশন স্কিমের চাঁদা বিনিয়োগের বিষয়ে জানতে চইলে গোলাম মোস্তফা বলেন, আমরা এখনো পর্যন্ত ১১৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। এর সম্পূর্ণটাই সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
বিজনেস আওয়ার/ ০৯ সেপ্টেম্বর / রহমান