বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক: ঢাকাসহ সারাদেশে শীতে বাড়ছে ঠান্ডাজনিত নানা ধরনের রোগ। বিশেষ করে, শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে সর্দি, হাঁচি-কাশি ও নিউমোনিয়াসহ নানা রোগে। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে চাপ। এই সময়ে অভিভাবকদের সতর্কতার ওপর গুরুত্বারোপ করছেন চিকিৎসকরা।
রাজধানীর আগারগাঁও শিশু হাসপাতালের গত ২৪ ঘণ্টার রেকর্ড বলছে, বহির্বিভাগে ১০১৮ শিশু চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে জরুরি বিভাগের ২১০, মেডিসিন বিভাগে ৬৪৬ এবং সার্জারি বিভাগে ১৬২ জন।
এর মধ্যে সাধারণ ঠান্ডাজনিত ১৩৫ জন, নিউমোনিয়া আক্রান্ত ২৬ জন, অ্যাজমা ১৮, স্ক্যাবিজ/স্কিন ১৪৪/২১২ এবং ডায়রিয়া আক্রান্ত ৬৪ রোগীও আছে।
হাসপাতালটির নিউমোনিয়া বিভাগেই ৪৭ জন ভর্তি আছে। এর মধ্যে গেল ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে ৭ জন। চলতি মাসের ১২ দিনে ৮৩ জন নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে।
আবাসিক চিকিৎসক মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, শৈত্যপ্রবাহের কারণে এখন প্রচুর ঠান্ডাজনিত রোগী আসছে। আমাদের বেড আছে মোট ৬৮০টা। প্রতিদিন আমরা ১০০ থেকে ১৫০ জন রোগী ফেরত দেই। ভর্তি নিতে পারি না। ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে এ মাসেই আমরা আরও ২০টি বেড পাবো। কাজও চলমান। পরের মাস থেকে মোট ৭০০ বেড হবে আমাদের।
শিশু হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই সময়ে ভাইরাসজনিত ঠান্ডা, নিউমোনিয়াসহ নানা ধরনের রোগ বাড়ছে। অ্যাজমাটিক সমস্যাও বেড়ে যায়। কোল্ড জনিত ডায়রিয়া বা রোটা ভাইরাস জানিত ডায়রিয়াও বাড়ে। ঠান্ডা কাশি থেকে বাঁচতে সচেতনতার জন্য বলা হয়, ৬ মাস বা তার নিচের বাচ্চাদের বুকের দুধ সময় মতো খাওয়াতে হবে। নাক পরিষ্কার রাখতে হবে। বাচ্চাদের নিয়ে অযথা বাইরে ঘুরাফেরা করা যাবে না। ক্লাউড প্লেসে যাওয়া যাবে না। ৬ মাস থেকে ৫ বছরের নিচের বাচ্চাদের নিউট্রিশাস ফুড খাওয়াতে হবে। স্কুল গোয়িং বাচ্চাদের শীতের ভালো কাপড় পরাতে হবে। কানটুপি বা মাফলার দিতে হবে। যাতে ঠান্ডা ও গলাব্যথা না হয়। বাইরে গেলে সবাই মাস্ক পরতে হবে। কারণ ঢাকা এখন বর্তমানে দ্বিতীয় বৃহৎ দূষিত শহর। ধুলাবালি যাতে না ঢুকে, খেয়াল রাখতে হবে।
তিনি বলেন, বাচ্চাদের পারসোনাল হাইজেনিক মেইনটেইন করা শেখাতে হবে। খাওয়ার আগে হাত ধুতে হবে। বাইরে থেকে এসে হাত ধুতে হবে। এখন ঠান্ডা কাশি ভাইরাস জনিত হওয়ার কারণে একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায়। এজন্য যার ঠান্ডা কাশি লাগছে, তাদের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। এই সময়ে যেন স্কুলে না পাঠায়।
‘বাবা-মায়েদের কমন চিন্তা, ঠান্ডা কাশি লাগছে। ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে এসে খাওয়ায়। এটা করা যাবে না। ফার্মেসিগুলোতে গেলেই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিচ্ছে। এখন ঠান্ডা কাশি বেশিরভাগই ভাইরাস জনিত কারণে। এর জন্য সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দরকার হয় না। বাচ্চাদের মধ্যে কোনো প্রকার নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে; হৃদব্রেথ রেট বেড়ে গেলে, শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বুকে উঠানামা করলে, বুকের ভেতর শব্দ আসলে এবং যা খাচ্ছে বমি করে বের করে দেওয়াসহ এমন কিছু মনে হলে নিকটবর্তী হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। চিকিৎসক পরীক্ষা করে চিকিৎসা দেবে। প্রয়োজন হলে ভর্তি দেবে।’ যোগ করেন শিশু চিকিৎসক কামরুল।
তিনি বলেন, বাবা-মায়ের প্রতি উপদেশ থাকবে, ইপিআই কর্তৃক সরকারি টিকাগুলো যাতে প্রতিটি বাচ্চা পায়। প্রতিবছরের সিজনাল ভ্যাকসিন, ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন দিয়ে নিতে হবে। শীতকালে বাচ্চারা পানি কম খায়। এজন্য তরল জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। না হয়, ইউরিনাল ইনফেকশন হতে পারে।
সন্তোষ সেবাপ্রার্থীদের
হাসপাতালের করিডোরে দেখা হয় এক মাস বয়সী মোহাম্মদের অভিভাবকদের। হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে ঢুকছেন তারা। কথা বলে জানা গেলো, তাদের সন্তানের ঠান্ডার সমস্যা। একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নেওয়ার পর তারা বলেছে, নিউমোনিয়া হয়েছে। ভর্তি করতে হবে। তাই তারা শিশু হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। এই রোগীর কার্যক্রম ফলো করে দেখা গেলো, পরিচিত একজনের সহায়তায় টিকিট নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে স্বাভাবিকভাবেই ভর্তি হয়েছেন। এতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তারা।
চাঁদপুরের মতলবের জামাল হোসেন আসছেন তার ১১ বছর বয়সী নাসিম প্রধানকে নিয়ে। তার প্রস্রাবের নালি সরু। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে একবার অপারেশন করেছে, কয়দিন ভালো ছিল, এখন আবার একই সমস্যা। সার্জারি বহির বিভাগ থেকে বলছে, ৫ হাজার টাকা জমা দিতে, তারপর একটা সিরিয়াল দিয়ে দেবে, এক মাস পর এসে সার্জারি করিয়ে নিয়ে যাবেন।
সার্জারি বহির বিভাগ থেকে জানিয়েছে, এসব সার্জারি দৈনিক ২টা হয়। আজ টাকা জমা দিলে সিরিয়াল অনুযায়ী এই মাসের শেষে, বা আগামী মাসের প্রথম দিকে হবে।
এদিকে ৬০ ফিট থেকে ২০ দিনের বাচ্চা নিয়ে এসেছেন আবৃতা। তার বাচ্চা মারিয়ার হাতের স্কিনের একটু লাল হয়ে গিয়েছিল। পরে সেটাতে ডাক্তারের পরামর্শে মলম দেওয়ায় সেটা কালো হয়ে গেছে। কিন্তু চাকা ধরেই ছিল। পরে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছে সমাধান হয়নি। তিনি বলেন, আজ নিয়ে আসছি। এখন আবার আল্ট্রা দিয়েছে, করেছি। সিরিয়ালে আছি। রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো, তিনি চিকিৎসা দেবেন। আবৃতা জানান, সবকিছু সহজেই হচ্ছে। তিনি এই সেবায় সন্তুষ্ট।
কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া থেকে এসেছেন মন্তুজ আলী, তিনি তার ছেলে মুস্তাকিমকে (৪) নিয়ে এসেছেন। সে থ্যালাসামিয়া আক্রান্ত। প্রতিমাসে এসে হিমোগ্লোবিন টেস্ট করে রক্ত দেন। আজও হিমোগ্লোবিন টেস্ট করেছেন, ডোনারের জন্য অপেক্ষা করছেন। আজ ডোনার এসে রক্ত দিলে কাল পুশ করবেন। এটা তার মাসিক রুটিন।
মন্তুষ আলীরও হাসপাতালের সেবা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। বলছেন, লোক বেশি সিরিয়াল থাকে, এছাড়া কোনো সমস্যা নেই।
সাধারণত হাসপাতালের আনসারদের আচরণ নিয়ে নানা সময় প্রশ্ন উঠলেও সকাল ৯টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত তাদের কোনো নেতিবাচক আচরণ পরিলক্ষিত হয়নি। বরং হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের সামনে দেখা মিলে একজন আনসারের। দেখা গেল আচরণে বেশ নমনীয়।
বিজনেস আওয়ার/ ১৩ জানুয়ারি / ইয়ামিন