বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক:দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়ম-কানুন বেশ কঠোর। আইনশৃঙ্খলার বেড়াজালে শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো দাবি-দাওয়া তোলারও সাহস করেন না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বাইরে কথা বললেই বহিষ্কারসহ কঠোর শাস্তির মুখে পড়তে হয় তাদের। সেখানে ভর্তি খরচ-টিউশন ফি সবই বেশি। অনেকের বাবা-মা কষ্টার্জিত অর্থে সন্তানকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। ফলে সহসাই আন্দোলন করে কেউ বহিষ্কার বা শাস্তির মুখে পড়তে চান না।
এটিই ছিল চিরাচরিত চিত্র। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সেই পরিস্থিতি একেবারে বদলে গেছে। এখন কথায় কথায় আন্দোলনে নামছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ হয়ে তারা কখনো ছুটছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি), আবার কেউ কেউ সচিবালয়ের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ করছেন।
৫ আগস্টের পর একের পর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান-সদস্য, উপাচার্যের অপসারণ দাবিতে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। স্থায়ী ক্যাম্পাস, শ্রেণিকক্ষ সংকট, নিজস্ব পরিবহন সুবিধাসহ দাবি-দাওয়া নিয়ে অনশনেও বসেছেন শিক্ষার্থীরা।
তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের যে ঢেউ দেখা যাচ্ছে, তা নিয়ে অভিভাবক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষাপ্রশাসনের কর্মকর্তারা উদ্বেগ জানিয়েছেন। অভিভাবকরা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাব্যয় বেশি। সন্তান যদি এক সেমিস্টারও বহিষ্কার হয়, তাতেও লাখের ওপরে গচ্চা যাবে। পাশাপাশি সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বাবা-মায়েরা।
শিক্ষাবিদরা অবশ্য এমন পরিস্থিতির জন্য শিক্ষার্থীদের নয়, বরং সরকার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) দায়ী করছেন। তাদের অভিমত, গণঅভ্যুত্থানের পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দখলদারমুক্ত করতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষার নামে বাণিজ্য চলছে, তাতে লাগাম টানতে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপও নেই। অযাচিত নিয়ন্ত্রণে সেখানে শিক্ষার্থীদের ‘দমবন্ধ’ হওয়ার দশা। অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীরা সাহসী হয়ে উঠেছেন। এখন তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে দখল-নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলনের পথে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছেন।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা
ইউজিসির তথ্যমতে, দেশে এখন অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৬টি। অবশ্য এরমধ্যে কয়েকটিতে এখনো শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়নি। আরও কয়েকটিতে স্থগিত রয়েছে। দেশে সবশেষ অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয় ‘গ্রামীণ ইউনিভার্সিটি’।
৫ আগস্টের পর থেকে দেশের অন্তত দুই ডজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দাবি-দাওয়া আদায়ে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। চলতি বছরের শুরুর দিক থেকে এ আন্দোলনের প্রবণতা বেড়েছে। ক্রমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। সামনে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিক্ষোভের মুখে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ইউআইইউ
সবশেষ ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (ইউআইইউ) গত ২৬ এপ্রিল শিক্ষার্থীরা তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য, সব ডিন, বিভাগীয় প্রধান ও ইনস্টিটিউটের পরিচালকরা পদত্যাগ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ইউআইইউ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে। শিক্ষার্থীরা তাদের স্বজনের মৃত্যু, অসুস্থতা, দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারলে তাদের ‘ইমপ্রুভমেন্ট’ পরীক্ষা দিতে অনুমতি পেতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে জরিমানাসহ বড় অঙ্কের ফি আদায় করা হয়। কর্তৃপক্ষ সব সময় তাদের ওপর নানা অযাচিত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়।
৭ দফা দাবিতে বিইউএফটি শিক্ষার্থীদের আলটিমেটাম
ছাত্রীদের হোস্টেলের সমস্যার সমাধানসহ সাত দফা দাবি নিয়ে গত সপ্তাহে আন্দোলনে নেমেছেন বেসরকারি বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউএফটি) শিক্ষার্থীরা। গত ২৬ এপ্রিল থেকে তারা কয়েক দফা বিক্ষোভ করেছেন। এরপর দাবি-দাওয়া আদায়ে এক সপ্তাহের আলটিমেটাম দিয়েছেন। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে দাবি না মানলে কঠোর কর্মসূচিতে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
বিইউএফটি শিক্ষার্থীরা জানান, ৫ আগস্টের পরও তাদের বিশ্ববিদ্যালয় একটি গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি। তারা শিক্ষার্থীদের ওপর অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে ব্যস্ত। শিক্ষার্থীদের কল্যাণে তারা কাজ করছেন না। এজন্য সাত দফা দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন। তারা শুধু মৌখিক আশ্বাসে ক্লাসে ফিরবেন না। দাবি বাস্তবায়নের রূপরেখা লিখিতভাবে ঘোষণা করতে হবে। খোলা মাঠে আলোচনার মাধ্যমে সেই রূপরেখা ঠিক করতে হবে।
প্রাইমএশিয়ার শিক্ষার্থীদের টানা বিক্ষোভ, পূরণ হয়নি দাবি
স্থায়ী ক্যাম্পাস, ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যানের পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে টানা এক সপ্তাহ আন্দোলন করেন প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, ইউজিসি অভিমুখে লং মার্চসহ বিভিন্ন কর্মসূচির পর ৭ জানুয়ারি সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। সেসময় পুলিশ তাদের ওপর লাঠিপেটা করে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। তাদের সেই দাবি-দাওয়া পূরণ হয়নি। ফলে এখনো ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। যেকোনো সময় আবার তারা আন্দোলনে নামতে পারেন বলে জানিয়েছেন।
এর আগে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. শুভময় দত্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পদত্যাগপত্রে উপাচার্য উল্লেখ করেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি নিলাম।’
অস্থিরতা কাটেনি স্টামফোর্ডেও
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ সব সদস্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। ট্রাস্টিদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি ও নানান অজুহাতে চাকরিচ্যুত করার অসংখ্য অভিযোগ তোলেন তারা।
আন্দোলনের মুখে গত বছরের ২৩ আগস্ট বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ফাতিনাজ ফিরোজ পদত্যাগ করেন। এ কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। যদিও পরে স্বপদে বহাল হন ফাতিনাজ ফিরোজ। দ্রুত খুলে দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ও।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পদত্যাগের নাটক এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে আন্দোলন দমিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বিষয়টির স্থায়ী সমাধান হয়নি। এ নিয়ে তারা আবারও কর্মসূচি দেবেন।
আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থী অসন্তোষ
শ্রেণিকক্ষ সংকট, পরিবহন ও ক্যাফেটেরিয়ার সমস্যা সমাধান এবং জুলাই আন্দোলন চলাকালীন হামলায় অংশ নেওয়া ছাত্রদের বিচারসহ ১৩ দফা দাবিতে গত ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ করেন আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) শিক্ষার্থীরা।
তখন তারা জানান, জুলাই অভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট ক্যাম্পাস খোলার প্রথম দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নতুন প্রশাসনের কাছে ১৩ দফা দাবি তুলে ধরেন। কিন্তু তাদের একটি দাবিও পূরণ করা হয়নি। এ নিয়ে কয়েক দফা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। দাবি-দাওয়া পূরণে অগ্রগতি না হলে আবার আন্দোলনের নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। প্রয়োজনে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করবেন শিক্ষার্থীরা।
ইউল্যাবে আশ্বাসের ফাঁদে শিক্ষার্থীরা, বাড়ছে ক্ষোভ
উপাচার্য অধ্যাপক ইমরান রহমানের পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবিতে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি আন্দোলনে নামেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) শিক্ষার্থীরা। টানা তিনদিন আন্দোলনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আব্দুল হান্নান মাসউদের মধ্যস্থতায় ছয়টি শর্তে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত করেন। তার মধ্যে অন্যতম তদন্ত কমিটি গঠন ও উপাচার্যকে অপসারণ। কিন্তু এখনো বিশ্ববিদ্যালয়টিতে উপাচার্য হিসেবে ইমরান রহমানই দায়িত্ব পালন করছেন। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
তারা জানান, সেসময় তাদের আশ্বাস দিয়ে আন্দোলন নস্যাৎ করা হয়েছে। প্রশাসন, ট্রাস্টি বোর্ড কোথাও কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। যারা জুলাই আন্দোলনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন, তারাও চেয়ারে বহাল। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। যেকোনো সময় তারা ফের কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনে নামবেন।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্দোলনের ঢেউ
শিক্ষার্থীদের টানা তিনদিনের আন্দোলনের মুখে গত ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন চট্টগ্রামের বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ। প্রায় চার মাস উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যশূন্য থাকার পর গত ১৬ এপ্রিল নতুন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে সেখানে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় নানামুখী সমস্যা বিদ্যমান। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।
আশ্বাস দিলেও সব দাবি পূরণ করেনি নর্থ সাউথ
অভ্যুত্থানের পরপরই টানা কয়েকদিন বিক্ষোভ-সমাবেশ করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। সেসময় তারা উপাচার্যকে অপসারণ, রাজনৈতিক কারণে চাকরি হারানো শিক্ষকদের স্বপদে বহাল, প্রক্টরিয়াল বডি পুনর্গঠনসহ ১৪ দফা দাবি জানান। পরে উপাচার্য পদত্যাগ করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। তবে নিজস্ব পরিবহন চালুসহ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অনেক দাবি উপেক্ষিত। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন সেসময় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা।
পারভেজ হত্যা: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা
তুচ্ছ ঘটনার জেরে গত ১৯ এপ্রিল প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। পারভেজকে নিজেদের কর্মী এবং হত্যকাণ্ডে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই নেতা জড়িত দাবি করে আন্দোলনে নামে ছাত্রদল।
এ নিয়ে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। ঢাকাসহ দেশের সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও এ নিয়ে কর্মসূচি পালিত হয়। এতে অনেকটা রাজনীতিবিমুখ বেসরকারি বিশ্ববিদালয় ক্যাম্পাস সরগম হয়ে ওঠে। এ ইস্যুতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা মুখোমুখি হয়ে পড়েন।
পারভেজ হত্যার প্রভাব পড়েছে বেসরকারি স্কলার্স বিশ্ববিদ্যালয়েও। যে দুই ছাত্রী তাদের বন্ধুদের ডেকে পারভেজের ওপর হামলা করান, তারা দুজনই এ বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী। এরই মধ্যে দুই ছাত্রীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে পুলিশ।
অভিভাবকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ
ইউআইইউ’র ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়েন খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা আব্দুল বাতেনের ছেলে। বাতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী। তার স্ত্রী একটি প্রি-ক্যাডেটের শিক্ষক।
আব্দুল বাতেন বলেন, ‘ছোট থেকেই ও (ছেলে) আমাদের পরিবারে অতি আদরের। আমার ভাই এবং বোন কারও ছেলে সন্তান না থাকায়, সবাই আমার ছেলেটাকে নিজের সন্তান মনে করে; আদর করে। সেজন্য মারামারি-হানাহানি হয়, এমন কোথাও ভর্তি করিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে দেইনি। সবাই বলছিল প্রাইভেটে দেন, ওখানে মারামারি নেই; রাজনীতি নেই। সেজন্য কষ্ট হলেও প্রাইভেটে ভর্তি করিয়েছি।’
আব্দুল বাতেন বলেন, ‘কিন্তু এখন তো দেখছি প্রাইভেটেও মারামারি লেগে থাকে। নিষেধ করি, তবু আন্দোলনে চলে যায়। তিনটা সেমিস্টার শেষ। এখন যদি বহিষ্কার বা কোনো ঝামেলা হয়, তাহলে তো সব টাকা-পয়সা; ওর কষ্ট জলে যাবে। আমরা অভিভাবকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি, ঝামেলা এগুলো চাই না। শিক্ষকরা ওদের সন্তানের মতো করে পড়িয়ে ডিগ্রি দেবে; এটাই প্রত্যাশা করি।’
উদ্বিগ্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি
সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্থির হয়ে ওঠায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির নেতারাও। তারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের যেকোনো সমস্যা ও যৌক্তিক দাবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আকারে উপস্থাপনের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইশতিয়াক আবেদীন বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যয় অভিভাবকদের কষ্টার্জিত অর্থের ওপর নির্ভরশীল। এখানে সময়ের মূল্য অপরিসীম। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে নিয়মিত অধ্যবসায়ের মাধ্যমে যোগ্যতা অর্জন অপরিহার্য। তা না হলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হয়। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনায় শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট ও শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হওয়া কখনোই কাম্য নয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতি-বাণিজ্য ও দখলমুক্ত করতে হবে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের অসন্তোষ ও অস্থিরতার নেপথ্যে অতি-বাণিজ্যিকীকরণ এবং ট্রাস্টি বোর্ডের নামে দখলদারত্ব রয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বেসরকারি খাতে উচ্চশিক্ষা সব দেশে ব্যয়বহুল। কিন্তু আমাদের এখানে যেটা চলছে, সেটা তো ডাকাতি। এরা অতি-বাণিজ্যিকীকরণ করেছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা সরকারের। অবাক করা বিষয় হলো- আমাদের সব সরকার সব সময় এ ডাকাতদের সহযোগিতা করে আসছে। এই যে ব্যবসায়ী ও সরকার অতি-বাণিজ্য করতে একে-অপরের সঙ্গে মিলে গেলো, এতে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া হয়।’
‘সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা ইউজিসি যখন তাদের লাগাম টানতে পারে না, তখন শিক্ষার্থীদের কাছে অসহনীয় হয়ে যায়। এ বিক্ষোভ সেটারই প্রতিফলন বলে আমি মনে করি। সরকারকে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকতে হবে। তাহলে ছাত্রদের আর রাস্তায় বা আন্দোলনে নামতে হবে না। মালিকপক্ষের রক্তচোষা এবং শিক্ষার্থীদের নিগৃহীত করা ঠেকাতে সরকার ব্যর্থ বলেই শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছে।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়ে আছে বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘ট্রাস্টি বোর্ডের নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিবারতন্ত্র চলছে, আগে সেগুলো ভাঙতে হবে। দখলদারত্ব কায়েম করেছে। সেটা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্ত করা জরুরি। আইনের সংশোধনও দরকার। তারপরও যে আইন আছে, সেটাই বাস্তবায়ন করা হোক; দেখবেন আর কোনো ঝামেলা নেই।
দখল-নিয়ন্ত্রণ রুখতে তৎপরতা বাড়াচ্ছে ইউজিসি
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা ও অচলাবস্থা সৃষ্টির নেপথ্যের কারণ চিহ্নিত। সেগুলো সমাধানে তদারককারী সংস্থা ইউজিসি তৎপরতা বাড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ।
তিনি বলেন, আইনের নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে ট্রাস্টি বোর্ড নিজেদের দখলে রাখেন অনেকে। বাবা অথবা মা চেয়ারম্যান; তো মেয়ে কিংবা ছেলে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। তাদের অবর্তমানে অলিখিত চেয়ারম্যান হয়ে ওঠেন ওই সন্তানরা। জিম্মিদশা যে আছে, এটা অস্বীকার করার সুযোগ তো নেই। অতিরিক্ত ফি আদায় নিয়েও অনেক অভিযোগ আসে আমাদের কাছে। কিন্তু আমরা আইনের বাইরে গিয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করতেও চাই না। আইনের মধ্যে থেকে কী কী করা যায়, সেটা অবশ্যই করবো। আর যেগুলো আমাদের এখতিয়ার-বর্হিভূত, সেগুলো করতে সরকারকে পরামর্শ দেবো।’
বিজনেস আওয়ার/ ০৪ মে / রহমান