বিজনেস আওয়ার ডেস্ক: বছর বিশেক আগে স্টার প্লাস নামের টেলিভিশন চ্যানেলে একটা হিন্দি সিরিয়াল হতো- ‘কিউকি সাস ভি কাভি বাহু থি’, যার অর্থ শাশুড়িও একসময় পুত্রবধূ ছিল। ভারতের যৌথ পরিবারে প্রজন্মের পর প্রজন্মে বাড়ির বউদের জীবনযাপন নিয়ে টানা আট বছর চলেছিল এই ধারাবাহিক নাটকটি। সেই সময়ে ও তার পরেও বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সিরিয়ালে মূল বিষয়বস্তু ছিল ‘বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব’।
এদিকে আমাদের দেশের বাড়ির বউ-শাশুড়িরা সারাদিনের মনোমালিন্য ভুলে সন্ধ্যাবেলায় এক হয়ে বসে যেত এসব কাল্পনিক চরিত্রের ঝগড়া-বিবাদ দেখতে। আদর্শ বউয়ের চরিত্রে থাকা সেসব পুত্রবধূদের পক্ষ নিয়ে চোখের চল ফেলতো অনেকে। পরিবার ভেদে একেকটি সম্পর্কের চেহারা, দায়িত্ব আলাদা হলেও বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক কেন সবসময় তিক্ততার উদাহরণ? আলাদা কী এমন আছে এই সম্পর্কে?
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বউ-শাশুড়ির সম্পর্কের এই টানাপোড়েনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে চায় না। একে ‘মেয়েলি সমস্যা’ হিসেবে লেবেল দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে চায়; যদিও এর পুরোদস্তুর প্রভাব পড়ে পুরো পরিবারের ওপর, এমনকি পুরুষ সদস্যদের ওপরও।
সম্প্রতি বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক সদস্যের অকাল মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়া তার মা ও স্ত্রীকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় গরম হয়ে উঠেছে। অল্প কয়েকটি তথ্যের ভিত্তিতে মানুষ নিজ নিজ কিবোর্ডের সামনে তদন্তে বসে গেছেন। তারা গবেষণা করছেন এ মৃত্যুর জন্য কে দায়ী – মা না কি বউ। তবে এই গবেষণায় অংশগ্রহণ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বরং এই একটি দুর্ঘটনা আমাদের এমন একটি সামাজিক সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, যা প্রায় প্রতিটি পরিবার যুগ যুগ ধরে নীরবে বয়ে নিয়ে চলেছে – ‘বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব’।
শাশুড়ির অতীত: আসলে আমাদের এই কৃষিপ্রধান পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সম্প্রতি মেয়ে শিশুকে সন্তান হিসেবে দেখার চল শুরু হয়েছে। শহরায়নের পরে নারীরা ‘সম্মানজনক’ উপার্জন করতে শুরু করার পরই এই পরিবর্তনটা হয়েছে। তবু এখনো অনেকে ছেলে সন্তান না থাকাকে একটি অপূর্ণতা মনে করেন। প্রসঙ্গটি হঠাৎ করে অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে? হতে পারে। কিন্তু ভেবে দেখুন। আমাদের মা-খালা, দাদি-নানিদের প্রজন্মে একজন নারীর পরিচয় কেমন ছিল- অমুকের মেয়ে, তমুকের নতুন বউ, তারপর অমুকের মা। অর্থাৎ ওই নারীর স্থায়ী পরিচয় গিয়ে ঠেকতো ‘অমুকের মা’ তে। সেই নারীকে ট্রেনিং দেওয়া হতো কীভাবে নিজের সর্বস্ব বিলীন করে সন্তান পালন করার মধ্যেই তার সফলতা আছে। সন্তানও সারাজীবন মায়ের আঁচলের নিচেই বড় হয়েছে নিশ্চিন্তে।
এই মায়ের পুত্রসন্তান যখন বড় হয়েছে, নিজে বিয়ে করেছেন (নিজের অথবা পরিবারের পছন্দে), তত দিনে কাল পাল্টে গেছে। পুত্র এখন তার সঙ্গীকে প্রাধান্য দিতে চায়, তার সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে চায়। তারও আলাদা একটা পরিবার তৈরি হয়েছে। আর এসময় মায়ের সব পরিচয়ের ওপর হুমকি হয়ে আসে ঘটা করে বিয়ে দিয়ে নিয়ে আসা পুত্রবধূ! নিজের অজান্তেই প্রতিযোগিতা শুরু হয় মায়ের মনে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, ওই নারী তখন আইডেন্টিটি ক্রাইসিস ও রিলেশনশিপ ইনসিকিউরিটিতে ভোগেন।
বউয়ের মনস্তত্ত্ব: অন্যদিকে নিজ মাকে সারাজীবন পরিবারের জন্য আত্মত্যাগ করতে দেখে একটি কন্যা ভাবে– আমি আমার জীবনটা নিজের মতো করে যাপন করতে চাই। আমি আমার সঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটাতে চাই, নিজেদের সম্পর্কটা শক্তিশালী করতে চাই। ঘুরতে যেতে চাই। সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার আগেকার সময়টা উপভোগ করতে চাই। নিজের ছোট্ট একটা সংসারে নিজের মতো বাঁচতে চাই। মায়ের মতো অন্যের পিছে খেটে খেটে শেষ জীবনে আফসোস করতে চাই না।
এই মেয়েটি বিয়ের পর সঙ্গীর সঙ্গে জীবন উপভোগ করার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে দেখেন সঙ্গীর জীবনে তার জন্য বরাদ্দ জায়গাটা বড্ড ছোট। একটা মেয়ে যখন তার চিরচেনা জীবনটা পিছে ফেলে সঙ্গীর হাত ধরে নতুন জীবনে আসে, তার কিছু সময় প্রয়োজন হয়। নতুন জীবনটা কীভাবে সাজাবে, তা বুঝতে সময় লাগে, সঙ্গীকে বুঝতে সময় লাগে। এসময় আরেকটি পরিবারের যুগ যুগ ধরে চলে আসা অভ্যাস ও নিয়ম-কানুনের বোঝা তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে ফলাফল ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কি?
আচ্ছা বুঝলাম, দুই পক্ষেরই কিছু পাওয়া-না পাওয়ার গল্প আছে। তাহলে এর সমাধান কী? এভাবেই এই দ্বন্দ্বগুলো মসলা মাখিয়ে বিক্রি করে ব্যবসা হতে থাকবে? নাকি এখানে কিছু সমাধান করা সম্ভব?
সমাধানের কথা বলার আগে একটা প্রশ্ন, ভেবে দেখুন তো এই যে দুই প্রজন্মের গল্প বললাম, তাতে পুরুষ মানুষগুলো সব কোথায় গেলো! বাবা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামী। এত সব দ্বন্দ্ব, চাওয়া না পাওয়ার গল্পে তাদের উপস্থিতি থাকার কথা ছিল না? অবশ্যই ছিল। তাই সমাধানটাও আসবে তাদের সঙ্গে নিয়েই।
মার্থা স্টুয়ার্ট নামক একটি লাইফস্টাইলভিত্তিক সাইটে ‘হাউ টু বি আ গ্রেট মাদার ইন ল’ বলে একটি প্রতিবেদন রয়েছে। এর অর্থ- কীভাবে আপনি একজন চমৎকার শাশুড়ি হতে পারেন। এতে বলা হয়েছে যে, ভালো শাশুড়ি হওয়ার দায় কেবল শাশুড়ির ওপর নয়, বরং ছেলে, ছেলের বউ এবং শ্বশুরের ওপরও পড়ে। সাধারণত কোনো সম্পর্কই একা একা ভালো বা খারাপ হয়ে যায় না। সেখানে দুই পক্ষেরই কিছু না কিছু ভূমিকা থাকে। আবার পরিবারের অন্য সদস্য আর পরিস্থিতিও এতে প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে মা ও বউয়ের সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষায় ছেলের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে চলুন জেনে নেই কীভাবে সবাই মিলে একটি স্বাস্থ্যকর পারিবারিক পরিবেশ পাওয়া সম্ভব-
১. প্রথমেই বলা দরকার বাবা ও শ্বশুরের কথা। বাবা একজন পুত্রের রোল মডেল। বাবাকে দেখেই সাধারণত পুত্র শেখে তার মায়ের গুরুত্ব এবং তার ভবিষ্যৎ স্ত্রীর গুরুত্ব। একই সঙ্গে বাবা তার কন্যার জন্যও রোল মডেল হতে পারেন। একজন কন্যার বাবা তার স্ত্রীর (কন্যার মায়ের) সঙ্গে যেমন আচরণ করেন, কন্যা সেসব দেখে জানতে পারে ভবিষ্যতে তার সঙ্গীর কাছে সে কেমন আচরণ আশা করবে। তাই ছোটবেলা থেকেই আপনার পুত্র ও কন্যার সামনে আপনি এমন একটি সম্পর্কের উদাহরণ তৈরি করুন যেখানে সম্মান, ভালোবাসা ও প্রাধান্য সব থাকে।
২. নারীদের নিজের পরিচয় থাকতে হবে। একজন মা যখন তার সারা জীবনের সবগুলো মুহূর্ত খরচ করেন তার পুত্রের জন্য, তখন পুত্রের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তার প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। একজন মা তার কন্যাকেও নিশ্চয় প্রচণ্ড ভালোবাসেন, কিন্তু সামাজিক নিয়মে কন্যা একসময় দূরে চলে যাবে, এটি সে নিজেকে বুঝিয়ে ফেলে। অথচ পুত্রের বিষয়ে এমনটা ভাবেন না যে, সে-ও একসময় বড় হয়ে নিজের মতো জীবনযাপন করবে। তাই মায়েদের উচিত নিজের পরিচয়, নিজস্ব কিছু ভাবনা, শখ, কাজ – এসব উৎসর্গ না করা। নিজেকে নিয়ে অখুশি থাকলে মানুষ অন্যের ওপর মানসিকভাবে বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তখন সেই মানুষটিকেও নিজের ওপর নির্ভরশীল করে রাখার আকাঙ্ক্ষা কাজ করে নিজের অজান্তেই। কিন্তু এটি আপনার সন্তানের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
৩. মায়েরা নিজেদের দাম্পত্যজীবন আনন্দময় রাখার চেষ্টা করুন। শেষ বয়সে যখন সন্তানরা বড় হবে, তখন যেন আবার দুজন দুজনার একান্ত সময়টি উপভোগ করতে পারেন। সন্তানের ব্যস্ততা যেন আপনাকে একা করে না দেয়। কেননা, এই একাকিত্বের অনুভূতি থেকেই সম্পর্কে চলে আসে টক্সিসিটি।
৪. এবার আসি পুত্রের প্রসঙ্গে। অনেক ছেলেই বিয়ের পর বউকে বলে ‘শুধু আমার মায়ের সঙ্গে মানিয়ে নাও। আর আমাকে তোমাদের ঝামেলায় জড়াবে না।’ আচ্ছা একবার ভেবে দেখুন, আপনার সঙ্গে আপনার পুরো পরিবার আছে, আর আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আছেন শুধু আপনি। পরিবারের বাকিরা তার জীবনে আছে শুধু আপনার কারণে। তাহলে কোনো বিষয় শেয়ার করা দরকার পড়লে যদি আপনাকে বলা নিষেধ হয়, সে কাকে বলবে?
তার কষ্ট বা অভিমানে আপনার প্রতিক্রিয়া যদি নেতিবাচক হয়, তখন নিজের মন হালকা করতে আপনার স্ত্রী অন্য কারও কাছে নিজের কথা বলবেন, পরিবারের কথা বাইরে যাবে। সেটিও কিন্তু আপনি ভালো ভাবে নিতে পারবেন না। তাই আপনার স্ত্রীর বন্ধু হোন। একটা বিষয় বোঝার চেষ্টা করুন যে, আপনি দুজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষে পরিণত হয়েছেন। তাই নতুন মানুষটির প্রতি দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি আপনার গর্ভধারিণীর প্রতি দায়িত্ব ভুলে যাবেন না। আপনার স্ত্রী যদি একজন হোমমেকারও হন, যিনি সারাদিন আপনার মায়ের খেয়াল রেখেছেন, তবুও বাড়ি ফিরে আপনি নিজে একবার খোঁজ নিন। মায়ের সঙ্গে কয়েক মিনিট সময় দিন।
৫. আপনার স্ত্রী যদি আপনার পরিবারের কারও কাছে অপমানজনক অভিজ্ঞতার শিকার হয়, এমন পরিস্থিতিতে তার আগে আপনি প্রতিবাদ করুন। শুরুতেই ভুল কার, তা বিচার করতে না গিয়ে আগে সবাইকে সম্মানজনক আচরণ করতে উৎসাহ দিন। তারপর আলাদা ভাবে সবার কথা শুনুন। স্ত্রীর কথা অবশ্যই একান্তে শুনবেন। পরিবারের কারও সামনে স্ত্রীকে জেরা করবেন না। এতে পরিবারের কাছে আপনার স্ত্রীর সম্মান কমবে।
৬. একইভাবে আপনার মায়ের জন্যও অবস্থান নিন। স্ত্রীর সামনে মাকে জেরা করবেন না। এতে আপনার মায়ের আত্মসম্মানে আঘাত লাগবে, একই সঙ্গে আপনার স্ত্রীর মনেও তার জন্য সম্মান কমে যেতে পারে। মা-কে গুরুত্ব দিয়ে তার কথা শুনুন।
৭. এসবের সঙ্গে সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, দুজন মানুষ যখন বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করে, তখন তাদের সামনে অসংখ্য ছোট ছোট বিষয় থাকে যেগুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। নিজেদের বুঝতে, মানিয়ে নিতে সময় ও প্রাইভেসি প্রয়োজন হয়। একটি দম্পতি যদি এই সময়টুকু পায় তাহলে পরিবারের দায়িত্ব পালনেও তারা সজাগ হবে।
`মা বড় না বউ’ এই বস্তাপচা প্রশ্নটি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দুজনকে তাদের নিজ স্থানে যথেষ্ট সম্মান দিন। সমাজ যখন শাশুড়ি ও পুত্রবধূকে প্রতিপক্ষ বানানো বন্ধ করবে, তখন থেকেই শুরু হবে স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের যাত্রা।
বিজনেস আওয়ার/ ১৪ মে / হাসান