বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক: ঢাকার উত্তরা দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে মঙ্গলবার শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করছিল। কেউ কাঁদছিলেন প্রিয় সহপাঠীর জন্য, প্রিয় সহকর্মী হারানোর কষ্টে শিক্ষকরাও ছিলেন নীরব-নিস্তব্ধ।
এর মাঝেই দেখা হয় স্কুলটির শারীরিক শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক নাসিরউদ্দিনের সঙ্গে। সোমবার (২১ জুলাই) দুর্ঘটনার সময় নিজে প্রাণে বেঁচে গেছেন। চোখের সামনে দাউ দাউ আগুনে পুড়তে দেখেছেন স্নেহের শিক্ষার্থীদের। সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির কথা বিবিসি বাংলার কাছে তুলে ধরছিলেন নাসির উদ্দিন।
তিনি বলছিলেন, ‘একটা প্রচণ্ড সাউন্ড হয়। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আমি রুম থেকে বের হয়ে আসি। এসে দেখি একটা অংশ পুরো ভেঙে গেছে। তারপরই সবাই বলে আগুন আগুন। যেখানে বিমানটা পড়েছে ওখানটায় গিয়ে দেখি মাত্র আগুন ধরছে। তারপর পরই সময় যত বেড়েছে আগুনের পরিমাণ বেড়েই চলছিল।’
তিনি জানান, বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে পৌঁছায় ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা।
নাসিরউদ্দিন বলছিলেন, ‘বারবার আমরা পানি দিচ্ছিলাম, কিন্তু আগুন কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণে আসছিল না। কিছুক্ষণ পরে আমার হাতের বামে দেখি অনেকগুলো স্টুডেন্ট আমার নাম ধরে ডাকছে, বলছে – স্যার আমাদের বাঁচান’।
‘পরে আমিসহ কয়েকজন গ্রিল ভেঙে ১২/১৩ জনকে উদ্ধার করি। প্রায় আধাঘণ্টা পর আমি আমার ডিপার্টমেন্টে আসি। আমার ডিপার্টমেন্টে আসি যখন, তখন আমার পিয়ন বলে স্যার ডিপার্টমেন্ট পুরোটা ভেঙে গেছে’, বলছিলেন তিনি।
স্কুলটির শারীরিক শিক্ষা বিভাগেই নাসিরউদ্দিনের অফিস। বিধ্বস্ত ভবনে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী উদ্ধার অভিযান শুরু করার নিজ বিভাগে ফিরে আসেন তিনি।
‘তারপর ভেতরে ঢুকে দেখি আমার ডেস্ক পুরোটা দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে গেছে। ওপরে দেখতে পাই প্যারাসুট। তখন গুঞ্জন আসলো প্যারাসুট থাকলে মানুষ আসতে পারে’, বলছিলেন নাসিরউদ্দিন।
তিনি বলছিলেন, ‘বিমান বাহিনীর লোকরা সার্চ করে দেখে আমার ঘরের এক কোনায় পড়েছিল পাইলট। টিনের চাল ভেঙে আমার ঘরেই মধ্যে পড়েছিল পাইলট। সেখান থেকেই উদ্ধার করা হয়েছে পাইলটকে।’
জীবন উৎসর্গ করেন পাইলট: বিমানবাহিনী প্রধান
মঙ্গলবার দুপুরে কুর্মিটোলায় যুদ্ধবিমানটির নিহত পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম সাগরের ফিউনারেল প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। প্যারেড শেষে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
শেষ শ্রদ্ধা অনুষ্ঠানে বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন বলেন, সোমবার দুপুর ১টা ১৩ মিনিটে যুদ্ধবিমানটি প্রশিক্ষণ করার সময় রানওয়ের খুব কাছে বিধ্বস্ত হয়। ক্রাশ ল্যান্ডিং হয় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে। যেখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকসহ অনেকে নিহত হয়েছেন। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। এছাড়া অনেকেই আহত হয়েছেন। আহতরা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) আহতদের দেখে এসেছি, বার্ন ইনস্টিটিউটসহ কয়েকটি হাসপাতালে আহতদের দেখতে যাবো।
বিমানবাহিনী প্রধান বলেন, বিমানটি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল পাইলট তখন সর্বোপরি চেষ্টা করেছেন বিমানকে খালি জায়গায় নামানোর। বিশেষ করে একটি মাঠ পেয়েছিলেন, সেখানে নামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তার শেষ চেষ্টা সফল হয়নি। যার কারণে বিমানটি আছড়ে পড়ে ভবনটির ওপরে। পাইলট বিমানটি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মূল্যবান সময় দিয়েছেন। বিমান থেকে বের হওয়ার জন্য যে পদ্ধতি তা বিলম্বিত হয়ে যায়, তার ফলে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন পাইলট।
এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন বলেন, দয়া করে দেশের এ বিপদের সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন গুজব ও মিস ইনফরমেশনে কান দেবেন না। একটি শক্তিশালী বিমানবাহিনী দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য অপরিহার্য। গুজব ছড়িয়ে দেশের সার্বভৌমত্বের স্তম্ভ দুর্বল করে দেবেন না।
তিনি বলেন, দুর্ঘটনাস্থলে যত দ্রুত সম্ভব হেলিকপ্টার ব্যবহার করে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এরই মধ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতি শিগগির তদন্ত কমিটি বের করবে, কী ধরনের ত্রুটি ছিল।
যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) মঙ্গলবার দুপুর ২টার পর জানায়, দুপুর ১২টা পর্যন্ত তারা ৩১ জনের মৃত্যু ও ১৬৫ জন আহত হওয়ার তথ্য পেয়েছে।
মঙ্গলবার রাত সোয়া ১২টার দিকে জাতীয় বার্ন জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নাফি নামে এক ছাত্রের মৃত্যু হয়। মঙ্গলবার বিকেলে রাজশাহী মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্টেডিয়ামে পাইলট তৌকির ইসলামের জানাজায় অংশ নেন হাজারও মানুষ। জানাজা শেষে নগরীর সপুরা কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
বিজনেস আওয়ার/ ২৩ জুলাই / কাওছার