ঢাকা , সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫, ৩ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইউরোপে ঘুরতে গিয়ে ‘অবাধ্য’ হলেই গুনতে হবে জরিমানা

  • পোস্ট হয়েছে : এই মাত্র
  • 0

বিজনেস আওয়ার ডেস্ক: খালি পায়ে হাঁটলে যেমন জরিমানা হতে পারে কোনো জায়গায়, আবার স্যান্ডেল পরে গাড়ি চালানোর জন্য অর্থদণ্ড হতে পারে অন্য এলাকায়। কোথাও বা পোশাক ঠিক না রাখলে হবে ‘দণ্ড’, আবার কোথাও সাঁতার কাটাই ‘অপরাধ’। ইউরোপ ঘুরতে যাওয়ার কথা ভেবে থাকলে এই বিষয়গুলো আপনার জানা থাকাই হয়তো ভালো।

চলতি বছর বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ ‘খারাপ আচরণকারী’ পর্যটকদের জন্য মোটা অঙ্কের জরিমানা চালু করেছে। কিন্তু এখনই কেন এটা করা হলো? এতে কি ছুটি কাটাতে আসা মানুষের আচরণ আসলেই পাল্টাবে?

দৃশ্যটা কল্পনা করুন–– আপনার বিমানটি তুরস্কের সাগরপাড়ের পর্যটন আকর্ষণ আন্তালিয়ায় অবতরণ করেছে এবং আপনি বিমান থেকে নামার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে সিটবেল্ট খুলে ফেললেন এবং মাথার ওপরের লকার থেকে আপনার ব্যাগটি ধরলেন

ঠিক তখনি হয়তো বিমানের একজন কর্মী আপনাকে ধরে একপাশে নিয়ে গেলো এবং আপনাকে দ্রুত ৬২ ইউরো বা ৫৪ পাউন্ড দিতে হবে বলে জরিমানা করলো। কারণ হলো–– আপনি একটি নতুন নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন।

চলতি বছর থেকে, বিমান চলা পুরোপুরি বন্ধ না হলে সিটবেল্ট খুলে ফেলা বা আসন ছেড়ে উঠে যাওয়াকে একটি ‘অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে এবং এর জন্য জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। এভাবেই ‘শাস্তি’ মাথায় নিয়েই হয়তো শুরু হতে পারে আপনার ‘আনন্দভ্রমণ’।

এবারের গ্রীষ্মে ইউরোপের অনেক দেশই ছুটি কাটাতে আসা ‘অবাধ্য’ পর্যটকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। গাড়ি চালানোর সময় স্যান্ডেল পরা থেকে শুরু করে সৈকতে ধূমপান পর্যন্ত, মহাদেশজুড়ে পর্যটকদের জরিমানার এক নতুন ঢেউ বয়ে যাচ্ছে।

পর্তুগালের জনপ্রিয় সমুদ্র তীরবর্তী শহর আলবুফেইরাতে সৈকতের বাইরে সাঁতারের পোশাক পরলে আপনার যেমন দেড় হাজার ইউরো পর্যন্ত খরচ হয়ে যেতে পারে, আবার স্পেনের বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জে অথবা ম্যালোর্কা বা ইবিজা দ্বীপে জনসমক্ষে মদ্যপান করলে তিন হাজার ইউরো পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।

এমনকি ছোটখাটো লঙ্ঘন, যেমন রোদ পোহানোর জন্য কোনো সানবেড ভাড়া করে অনেক বেশি সময় তা ধরে রাখলে অথবা যাওয়ার সময় তোয়ালেটা সেখানে ফেলে গেলে সেটাও ‘দণ্ডনীয়’ হতে পারে।

আবার হয়তো ঘুরতে ঘুরতে ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে যাওয়াটাও আপনার ছুটির বাজেটে ধাক্কা দিতে পারে। এসব শুনে মনে হতেই পারে যে, এসব ব্যবস্থার মানে হলো যাদের হাত ধরে পয়সা আসছে সেই পর্যটকদের হাতেই কামড় বসানোর মতো বিষয় কি না। যেখানে ইউরোপের অনেক দেশই পর্যটনখাত থেকেই বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে।

তবে বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষ যুক্তি দিয়ে বলছে, নিয়মগুলো স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপত্তা দেওয়ার এবং ছুটি কাটাতে আসা মানুষদের ‘দায়িত্বশীল’ আচরণ করতে উৎসাহিত করবে।

লন্ডনে স্প্যানিশ পর্যটন অফিসের প্রেস বিভাগের প্রধান জেসিকা হার্ভে টেলর বলেন, এসব নিয়ম তালিকাভুক্ত করার সময় কঠোর এবং শাস্তিমূলক শোনালেও দায়িত্বশীল এবং সহানুভূতিশীল ভ্রমণকে উৎসাহিত করার জন্যই করা হয়েছে। ছুটির দিনে দায়িত্বশীল আচরণকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অভিজ্ঞতা ভালো রাখার জন্যই এগুলো তৈরি করা হয়েছে।

স্পেনের মালাগায় পর্যটকদের জন্য ১০ দফা আচরণবিধি- যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইমপ্রুভ ইয়োর স্টে’, সেটা বাসে, বিলবোর্ডে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হচ্ছে। শহরে কেমন আচরণ করা উচিত তা তুলে ধরা হয়েছে এখানে।

এর মধ্যে রয়েছে সম্মানজনক পোশাক পরা, যেখানে সেখানে আবর্জনা না ফেলা, অতিরিক্ত শব্দ না করা এবং বেপরোয়া ইস্কুটার ব্যবহার না করা। যারা এই নীতি মেনে চলবে না তাদের সর্বোচ্চ ৭৫০ ইউরো (৬৫০ পাউন্ড) পর্যন্ত জরিমানা করা হবে।

চলতি বছর পর্তুগালের আলবুফেইরাতেও পাবলিক প্লেসে একই ধরনের আচরণবিধি চালু করা হয়েছে, যেখানে প্রকাশ্যে নগ্নতা থেকে শুরু করে জনসমক্ষে প্রস্রাব করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, আবার শপিং কার্ট (শপিং মলে কেনাকাটার সময় চাকা লাগানো যে ঝুড়ি ব্যবহার করা হয়) সেগুলো যেখানে সেখানে ফেলে যাওয়াও ‘অবৈধ’ করা হয়েছে।

স্থানীয়রা বলছেন, নিয়মগুলো শুধু দেখানোর জন্যই চালু করা হয়নি, বরং শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে পুলিশের গতিবিধি দেখা যাচ্ছে এবং তারা ‘অবাধ্য’ পর্যটকদের পাকড়াও করছে।

পরিবেশগতভাবে নাজুক এলাকা বা সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল এলাকায় – যেমন গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ বা ল্যাপল্যান্ডের সামি গোষ্ঠীপ্রধান এলাকায় আগে থেকেই কিছু আচরণবিধি মেনে চলতে হয়।

তবে এখন মূলধারার সৈকত বা রিসোর্টগুলোতেও নিয়মকানুন চালু একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এর মানে হলো পর্যটকদের অনেকের আচরণই এখন খারাপ হয়েছে এবং কর্তৃপক্ষ শহরগুলো ও সেখানকার বাসিন্দাদের পর্যটনের খারাপ দিকগুলো থেকে রক্ষার চেষ্টা করছে।

ম্যালোর্কার ক্যালভিয়া শহরের মেয়র হুয়ান আন্তোনিও আমেঙ্গুয়াল বলেন, আমাদের দুটি প্রধান ধারণা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে; একটি হলো পরিবেশ সুরক্ষা এবং অন্যটি হলো সংরক্ষণ; সঙ্গে পর্যটন আমাদের সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না তা নিশ্চিত করাও লক্ষ্য। পর্যটন কখনোই স্থানীয় নাগরিকদের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

কোথায়, কীভাবে, কত টাকা জরিমানা

চলতি গ্রীষ্মে ইউরোপে কোথায়, কীভাবে, কত টাকা জরিমানা হতে পারে তার একটি ধারণা দেওয়া যেতে পারে––

জরিমানা: ফ্লিপ ফ্লপ বা সহজ ভাষায় যাকে বলা হয় চপ্পল বা স্যান্ডেল পরে অথবা খালি পায়ে গাড়ি চালানোর জন্য ৩০০ ইউরো (২৬১ পাউন্ড) পর্যন্ত জরিমানা।

কোথায়: স্পেন, গ্রীস, ইতালি, ফ্রান্স, পর্তুগাল।

কীভাবে এড়াবেন: গাড়ি চালানোর সময় সঠিক জুতা পরতে হবে।

জরিমানা: সমুদ্রসৈকত থেকে দূরে সাঁতারের পোশাক পরার জন্য এক হাজার ৫০০ ইউরো (এক হাজার ৩০৭ পাউন্ড) পর্যন্ত জরিমানা।

কোথায়: স্পেনের বার্সেলোনা, পর্তুগালের আলবুফেইরা, ক্রোয়েশিয়ার স্প্লিট, ইতালির সোরেন্টো ও ভেনিস, ফ্রান্সের কান।

কীভাবে এড়াবেন: সমুদ্রসৈকত থেকে বের হওয়ার সময় মুখ ঢেকে রাখুন।

জরিমানা: জনসমক্ষে মদ্যপানের জন্য তিন হাজার ইউরো (দুই হাজার ৬১৫ পাউন্ড) পর্যন্ত।

কোথায়: স্পেনের ম্যালোর্কা, ইবিজা, ম্যাগালুফ দ্বীপ ও ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ।

কীভাবে এড়াবেন: বার, রেস্তোরাঁয় অথবা ভিলা বা অ্যাপার্টমেন্টে পরিমিত পরিমাণে পান করতে হবে।

জরিমানা: সমুদ্রসৈকত থেকে খোলস বা নুড়ি তোলার জন্য এক হাজার ইউরো (৮৭১ পাউন্ড) পর্যন্ত।

কোথায়: গ্রীস

কীভাবে এড়ানো যায়: নুড়ি না তুলে ছবি তুলুন।

জরিমানা: খালে সাঁতার কাটার জন্য ৩৫০ ইউরো (৩০৫ পাউন্ড)

কোথায়: ভেনিস

কীভাবে এড়ানো যায়: মনে রাখবেন যে খাল দিয়ে ময়লা-আবর্জনা আসে, এর বদলে গন্ডোলা বা নৌকায় উঠে ঘুরতে শুরু করুন। মনে রাখার মতো বিষয় হলো––জরিমানা হতে পারে এমন কাজের তালিকা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

আয়ারল্যান্ডের এয়ারলাইন্স রায়ানএয়ার ‘বিঘ্ন’ সৃষ্টিকারী যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৫০০ ইউরো বা ৪৩৫ পাউন্ড আদায় করে নিতে পারে।

অনুপযুক্ত জুতা পরে ইতালির উপকূলীয় পর্যটনকেন্দ্র সিনকে তেরতের ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলে পর্যটকদের আড়াই হাজার ইউরো (দুই হাজার ১৮০ পাউন্ড) পর্যন্ত জরিমানার শিকার হতে পারে।

আর ধূমপান করতে গিয়ে সৈকত বা খেলার মাঠে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ফ্রান্স ঘটনাস্থলেই ৯০ ইউরো (৭৮ পাউন্ড) জরিমানা চালু করেছে। দায়িত্বশীল পর্যটন নিয়ে কর্মরত বিরগিত্তা স্পি-কোনিগ বলেন, স্থানীয়রা পর্যটকদের অনেক আচরণে বিরক্ত।

এই জরিমানাগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, স্থানীয়রা তাদের নিজেদের জন্য আলাদা পরিসর চায়। আর এটাও বিবেচনায় রাখা উচিত যে প্রতিটি জরিমানাই একেকটি সাজা নয় বরং এগুলো শ্রদ্ধাশীল হওয়ারও আহ্বান জানায়।

ইউরোপে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পর্যটন বা অতিমাত্রায় পর্যটনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বেড়েছে। স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোর দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে স্বল্পমেয়াদী বিভিন্ন ব্যবস্থা বা আইন যেমন নেওয়া হয়েছে, আবার নতুন নতুন জরিমানা আরোপও তাদের পক্ষে যাচ্ছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলো স্বীকার করছে যে তাদের বাসিন্দাদের পক্ষে দাঁড়াতে হবে এবং এটি করার জন্য পর্যটকদের বিরক্তির ঝুঁকিও তারা নিচ্ছে।

এটি ছুটি কাটাতে আসা লোকদের জন্যও একটি সংকেত যে বাড়ি থেকে দূরে থাকা আপনার ইচ্ছামতো কিছু করার জন্য মুক্ত সুযোগ নয়। জরিমানা সংস্কৃতি পরিবর্তন করবে না এ কথা উল্লেখ করে স্পি-কোনিগ কিছুটা সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করলেও দীর্ঘমেয়াদে এগুলো আচরণ পরিবর্তনকারী হিসেবে প্রমাণিত নাও হতে পারে।

ভালো দিকনির্দেশনা, স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি এবং স্থানীয় ও পর্যটকদের আকাঙ্ক্ষার সমন্বয় ছাড়া খুব কমই পরিবর্তন হবে। নতুন নতুন জরিমানা আরোপের বিষয়টি কাজ করছে কি না তা বলা এখনি সম্ভব নয়।

পর্তুগালের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় শহর আলগারভে পর্যটকদের পরিষেবা দানকারী সংস্থা গোটুআলগারভের পরিচালক রবার্ট অ্যালার্ড জানান, আলবুফেইরার নাইটলাইফ এলাকায় নতুন নজরদারি ক্যামেরা এবং পুলিশের উপস্থিতি বৃদ্ধি লক্ষ্য করেছেন তিনি।

কিছু লোককে জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও সত্যি, মানুষ নতুন নিয়ম সম্পর্কে আসলে সচেতন নয়। যদিও হোটেলের লবিতে লিফলেট ও বিভিন্ন স্থানে এসব নিয়মের পোস্টার দেখা যাচ্ছে।

আচরণ পরিবর্তনের জন্য চালানো প্রচারণা কার্যকর হতে সময় নেয় এবং একটি মৌসুমই দর্শনার্থীদের অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট নয়। তবে বার্তাটি স্পষ্ট–– সূর্য, বালি ও সমুদ্র অপেক্ষায় আছে, তবে কেবল তাদের জন্য যারা সংবেদনশীলভাবে এবং কিছুটা সংযতভাবে সেগুলো উপভোগ করতে সম্মত হবেন।

বিজনেস আওয়ার/ ১৮ আগস্ট / হাসান

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান:
ট্যাগ :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার মেইলে তথ্য জমা করুন

ইউরোপে ঘুরতে গিয়ে ‘অবাধ্য’ হলেই গুনতে হবে জরিমানা

পোস্ট হয়েছে : এই মাত্র

বিজনেস আওয়ার ডেস্ক: খালি পায়ে হাঁটলে যেমন জরিমানা হতে পারে কোনো জায়গায়, আবার স্যান্ডেল পরে গাড়ি চালানোর জন্য অর্থদণ্ড হতে পারে অন্য এলাকায়। কোথাও বা পোশাক ঠিক না রাখলে হবে ‘দণ্ড’, আবার কোথাও সাঁতার কাটাই ‘অপরাধ’। ইউরোপ ঘুরতে যাওয়ার কথা ভেবে থাকলে এই বিষয়গুলো আপনার জানা থাকাই হয়তো ভালো।

চলতি বছর বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ ‘খারাপ আচরণকারী’ পর্যটকদের জন্য মোটা অঙ্কের জরিমানা চালু করেছে। কিন্তু এখনই কেন এটা করা হলো? এতে কি ছুটি কাটাতে আসা মানুষের আচরণ আসলেই পাল্টাবে?

দৃশ্যটা কল্পনা করুন–– আপনার বিমানটি তুরস্কের সাগরপাড়ের পর্যটন আকর্ষণ আন্তালিয়ায় অবতরণ করেছে এবং আপনি বিমান থেকে নামার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে সিটবেল্ট খুলে ফেললেন এবং মাথার ওপরের লকার থেকে আপনার ব্যাগটি ধরলেন

ঠিক তখনি হয়তো বিমানের একজন কর্মী আপনাকে ধরে একপাশে নিয়ে গেলো এবং আপনাকে দ্রুত ৬২ ইউরো বা ৫৪ পাউন্ড দিতে হবে বলে জরিমানা করলো। কারণ হলো–– আপনি একটি নতুন নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন।

চলতি বছর থেকে, বিমান চলা পুরোপুরি বন্ধ না হলে সিটবেল্ট খুলে ফেলা বা আসন ছেড়ে উঠে যাওয়াকে একটি ‘অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে এবং এর জন্য জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। এভাবেই ‘শাস্তি’ মাথায় নিয়েই হয়তো শুরু হতে পারে আপনার ‘আনন্দভ্রমণ’।

এবারের গ্রীষ্মে ইউরোপের অনেক দেশই ছুটি কাটাতে আসা ‘অবাধ্য’ পর্যটকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। গাড়ি চালানোর সময় স্যান্ডেল পরা থেকে শুরু করে সৈকতে ধূমপান পর্যন্ত, মহাদেশজুড়ে পর্যটকদের জরিমানার এক নতুন ঢেউ বয়ে যাচ্ছে।

পর্তুগালের জনপ্রিয় সমুদ্র তীরবর্তী শহর আলবুফেইরাতে সৈকতের বাইরে সাঁতারের পোশাক পরলে আপনার যেমন দেড় হাজার ইউরো পর্যন্ত খরচ হয়ে যেতে পারে, আবার স্পেনের বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জে অথবা ম্যালোর্কা বা ইবিজা দ্বীপে জনসমক্ষে মদ্যপান করলে তিন হাজার ইউরো পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।

এমনকি ছোটখাটো লঙ্ঘন, যেমন রোদ পোহানোর জন্য কোনো সানবেড ভাড়া করে অনেক বেশি সময় তা ধরে রাখলে অথবা যাওয়ার সময় তোয়ালেটা সেখানে ফেলে গেলে সেটাও ‘দণ্ডনীয়’ হতে পারে।

আবার হয়তো ঘুরতে ঘুরতে ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে যাওয়াটাও আপনার ছুটির বাজেটে ধাক্কা দিতে পারে। এসব শুনে মনে হতেই পারে যে, এসব ব্যবস্থার মানে হলো যাদের হাত ধরে পয়সা আসছে সেই পর্যটকদের হাতেই কামড় বসানোর মতো বিষয় কি না। যেখানে ইউরোপের অনেক দেশই পর্যটনখাত থেকেই বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে।

তবে বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষ যুক্তি দিয়ে বলছে, নিয়মগুলো স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপত্তা দেওয়ার এবং ছুটি কাটাতে আসা মানুষদের ‘দায়িত্বশীল’ আচরণ করতে উৎসাহিত করবে।

লন্ডনে স্প্যানিশ পর্যটন অফিসের প্রেস বিভাগের প্রধান জেসিকা হার্ভে টেলর বলেন, এসব নিয়ম তালিকাভুক্ত করার সময় কঠোর এবং শাস্তিমূলক শোনালেও দায়িত্বশীল এবং সহানুভূতিশীল ভ্রমণকে উৎসাহিত করার জন্যই করা হয়েছে। ছুটির দিনে দায়িত্বশীল আচরণকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অভিজ্ঞতা ভালো রাখার জন্যই এগুলো তৈরি করা হয়েছে।

স্পেনের মালাগায় পর্যটকদের জন্য ১০ দফা আচরণবিধি- যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইমপ্রুভ ইয়োর স্টে’, সেটা বাসে, বিলবোর্ডে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হচ্ছে। শহরে কেমন আচরণ করা উচিত তা তুলে ধরা হয়েছে এখানে।

এর মধ্যে রয়েছে সম্মানজনক পোশাক পরা, যেখানে সেখানে আবর্জনা না ফেলা, অতিরিক্ত শব্দ না করা এবং বেপরোয়া ইস্কুটার ব্যবহার না করা। যারা এই নীতি মেনে চলবে না তাদের সর্বোচ্চ ৭৫০ ইউরো (৬৫০ পাউন্ড) পর্যন্ত জরিমানা করা হবে।

চলতি বছর পর্তুগালের আলবুফেইরাতেও পাবলিক প্লেসে একই ধরনের আচরণবিধি চালু করা হয়েছে, যেখানে প্রকাশ্যে নগ্নতা থেকে শুরু করে জনসমক্ষে প্রস্রাব করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, আবার শপিং কার্ট (শপিং মলে কেনাকাটার সময় চাকা লাগানো যে ঝুড়ি ব্যবহার করা হয়) সেগুলো যেখানে সেখানে ফেলে যাওয়াও ‘অবৈধ’ করা হয়েছে।

স্থানীয়রা বলছেন, নিয়মগুলো শুধু দেখানোর জন্যই চালু করা হয়নি, বরং শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে পুলিশের গতিবিধি দেখা যাচ্ছে এবং তারা ‘অবাধ্য’ পর্যটকদের পাকড়াও করছে।

পরিবেশগতভাবে নাজুক এলাকা বা সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল এলাকায় – যেমন গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ বা ল্যাপল্যান্ডের সামি গোষ্ঠীপ্রধান এলাকায় আগে থেকেই কিছু আচরণবিধি মেনে চলতে হয়।

তবে এখন মূলধারার সৈকত বা রিসোর্টগুলোতেও নিয়মকানুন চালু একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এর মানে হলো পর্যটকদের অনেকের আচরণই এখন খারাপ হয়েছে এবং কর্তৃপক্ষ শহরগুলো ও সেখানকার বাসিন্দাদের পর্যটনের খারাপ দিকগুলো থেকে রক্ষার চেষ্টা করছে।

ম্যালোর্কার ক্যালভিয়া শহরের মেয়র হুয়ান আন্তোনিও আমেঙ্গুয়াল বলেন, আমাদের দুটি প্রধান ধারণা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে; একটি হলো পরিবেশ সুরক্ষা এবং অন্যটি হলো সংরক্ষণ; সঙ্গে পর্যটন আমাদের সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না তা নিশ্চিত করাও লক্ষ্য। পর্যটন কখনোই স্থানীয় নাগরিকদের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

কোথায়, কীভাবে, কত টাকা জরিমানা

চলতি গ্রীষ্মে ইউরোপে কোথায়, কীভাবে, কত টাকা জরিমানা হতে পারে তার একটি ধারণা দেওয়া যেতে পারে––

জরিমানা: ফ্লিপ ফ্লপ বা সহজ ভাষায় যাকে বলা হয় চপ্পল বা স্যান্ডেল পরে অথবা খালি পায়ে গাড়ি চালানোর জন্য ৩০০ ইউরো (২৬১ পাউন্ড) পর্যন্ত জরিমানা।

কোথায়: স্পেন, গ্রীস, ইতালি, ফ্রান্স, পর্তুগাল।

কীভাবে এড়াবেন: গাড়ি চালানোর সময় সঠিক জুতা পরতে হবে।

জরিমানা: সমুদ্রসৈকত থেকে দূরে সাঁতারের পোশাক পরার জন্য এক হাজার ৫০০ ইউরো (এক হাজার ৩০৭ পাউন্ড) পর্যন্ত জরিমানা।

কোথায়: স্পেনের বার্সেলোনা, পর্তুগালের আলবুফেইরা, ক্রোয়েশিয়ার স্প্লিট, ইতালির সোরেন্টো ও ভেনিস, ফ্রান্সের কান।

কীভাবে এড়াবেন: সমুদ্রসৈকত থেকে বের হওয়ার সময় মুখ ঢেকে রাখুন।

জরিমানা: জনসমক্ষে মদ্যপানের জন্য তিন হাজার ইউরো (দুই হাজার ৬১৫ পাউন্ড) পর্যন্ত।

কোথায়: স্পেনের ম্যালোর্কা, ইবিজা, ম্যাগালুফ দ্বীপ ও ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ।

কীভাবে এড়াবেন: বার, রেস্তোরাঁয় অথবা ভিলা বা অ্যাপার্টমেন্টে পরিমিত পরিমাণে পান করতে হবে।

জরিমানা: সমুদ্রসৈকত থেকে খোলস বা নুড়ি তোলার জন্য এক হাজার ইউরো (৮৭১ পাউন্ড) পর্যন্ত।

কোথায়: গ্রীস

কীভাবে এড়ানো যায়: নুড়ি না তুলে ছবি তুলুন।

জরিমানা: খালে সাঁতার কাটার জন্য ৩৫০ ইউরো (৩০৫ পাউন্ড)

কোথায়: ভেনিস

কীভাবে এড়ানো যায়: মনে রাখবেন যে খাল দিয়ে ময়লা-আবর্জনা আসে, এর বদলে গন্ডোলা বা নৌকায় উঠে ঘুরতে শুরু করুন। মনে রাখার মতো বিষয় হলো––জরিমানা হতে পারে এমন কাজের তালিকা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

আয়ারল্যান্ডের এয়ারলাইন্স রায়ানএয়ার ‘বিঘ্ন’ সৃষ্টিকারী যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৫০০ ইউরো বা ৪৩৫ পাউন্ড আদায় করে নিতে পারে।

অনুপযুক্ত জুতা পরে ইতালির উপকূলীয় পর্যটনকেন্দ্র সিনকে তেরতের ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলে পর্যটকদের আড়াই হাজার ইউরো (দুই হাজার ১৮০ পাউন্ড) পর্যন্ত জরিমানার শিকার হতে পারে।

আর ধূমপান করতে গিয়ে সৈকত বা খেলার মাঠে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ফ্রান্স ঘটনাস্থলেই ৯০ ইউরো (৭৮ পাউন্ড) জরিমানা চালু করেছে। দায়িত্বশীল পর্যটন নিয়ে কর্মরত বিরগিত্তা স্পি-কোনিগ বলেন, স্থানীয়রা পর্যটকদের অনেক আচরণে বিরক্ত।

এই জরিমানাগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, স্থানীয়রা তাদের নিজেদের জন্য আলাদা পরিসর চায়। আর এটাও বিবেচনায় রাখা উচিত যে প্রতিটি জরিমানাই একেকটি সাজা নয় বরং এগুলো শ্রদ্ধাশীল হওয়ারও আহ্বান জানায়।

ইউরোপে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পর্যটন বা অতিমাত্রায় পর্যটনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বেড়েছে। স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোর দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে স্বল্পমেয়াদী বিভিন্ন ব্যবস্থা বা আইন যেমন নেওয়া হয়েছে, আবার নতুন নতুন জরিমানা আরোপও তাদের পক্ষে যাচ্ছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলো স্বীকার করছে যে তাদের বাসিন্দাদের পক্ষে দাঁড়াতে হবে এবং এটি করার জন্য পর্যটকদের বিরক্তির ঝুঁকিও তারা নিচ্ছে।

এটি ছুটি কাটাতে আসা লোকদের জন্যও একটি সংকেত যে বাড়ি থেকে দূরে থাকা আপনার ইচ্ছামতো কিছু করার জন্য মুক্ত সুযোগ নয়। জরিমানা সংস্কৃতি পরিবর্তন করবে না এ কথা উল্লেখ করে স্পি-কোনিগ কিছুটা সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করলেও দীর্ঘমেয়াদে এগুলো আচরণ পরিবর্তনকারী হিসেবে প্রমাণিত নাও হতে পারে।

ভালো দিকনির্দেশনা, স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি এবং স্থানীয় ও পর্যটকদের আকাঙ্ক্ষার সমন্বয় ছাড়া খুব কমই পরিবর্তন হবে। নতুন নতুন জরিমানা আরোপের বিষয়টি কাজ করছে কি না তা বলা এখনি সম্ভব নয়।

পর্তুগালের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় শহর আলগারভে পর্যটকদের পরিষেবা দানকারী সংস্থা গোটুআলগারভের পরিচালক রবার্ট অ্যালার্ড জানান, আলবুফেইরার নাইটলাইফ এলাকায় নতুন নজরদারি ক্যামেরা এবং পুলিশের উপস্থিতি বৃদ্ধি লক্ষ্য করেছেন তিনি।

কিছু লোককে জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও সত্যি, মানুষ নতুন নিয়ম সম্পর্কে আসলে সচেতন নয়। যদিও হোটেলের লবিতে লিফলেট ও বিভিন্ন স্থানে এসব নিয়মের পোস্টার দেখা যাচ্ছে।

আচরণ পরিবর্তনের জন্য চালানো প্রচারণা কার্যকর হতে সময় নেয় এবং একটি মৌসুমই দর্শনার্থীদের অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট নয়। তবে বার্তাটি স্পষ্ট–– সূর্য, বালি ও সমুদ্র অপেক্ষায় আছে, তবে কেবল তাদের জন্য যারা সংবেদনশীলভাবে এবং কিছুটা সংযতভাবে সেগুলো উপভোগ করতে সম্মত হবেন।

বিজনেস আওয়ার/ ১৮ আগস্ট / হাসান

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান: