পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত ২৯ এপ্রিল বিএসইসির সভায় কর্পোরেট সুশাসন বিধিমালায় (কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড) স্বতন্ত্র পরিচালকদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার মানদণ্ড নির্ধারণ করে স্বতন্ত্র পরিচালকদের একটি প্যানেল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বাজার সংশ্লিষ্টরা নানা প্রশ্ন তুলছেন।
বিএসইসি এই সিদ্ধান্তের যুক্তি হিসেবে সুশাসন বাড়ানোর চেষ্টার কথা বললেও পুঁজিবাজার ও আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাদের শঙ্কা, বিএসইসির এই সিদ্ধান্ত কোম্পানিগুলোতে ‘রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ’ তৈরি করে দেবে। পাশাপাশি তা স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে বিদ্যমান আইন ও বিধির সঙ্গেও ‘সাংঘর্ষিক’ হতে পারে।
তবে বাজার সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ কোম্পানিগুলোর সুশাসনের জন্য ‘পরীক্ষামূলকভাবে’ স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের প্যানেল গঠনের পক্ষে বলেছেন।
তবে ওই প্যানেল কীভাবে গঠন করা হবে, কারা তাতে থাকবেন, কোম্পানির জন্য ওই প্যানেল থেকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ বাধ্যতামূলক হবে কি না- সেসব বিষয়ে বিস্তারিত কিছু এখনও জানায়নি বিএসইসি।
কমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মহামারীর কারণে সরকারঘোষিত ছুটি শেষ হলে ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বিএসইসি মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে সুশাসন বাড়াতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কোম্পানিগুলো সহজেই এই প্যানেল থেকে স্বতন্ত্র পরিচালক বেছে নিতে পারবে। এতে কোম্পানির কাজ সহজ হবে।
অনেক সময় কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের মধ্যে কোম্পানির সম্পদ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে দেখা যায়, যার ফলে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাই শেয়ারহোল্ডারদের আমানত দেখভাল করার জন্যই স্বাধীন পরিচালক নিয়োগের বিধান (কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড) করা হয়েছে।
সেখানে স্বতন্ত্র পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা ও শর্ত সবই উল্লেখ করা আছে। স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেন কোম্পানির পরিচালকরা, যার অনুমোদন সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা বার্ষিক সাধারণ সভায় দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, “দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালকরা সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষা না করে শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের কথা মত চলেন। হয়ত এ কারণেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা স্বতন্ত্র পরিচালকের প্যানেল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের কাছের লোক নিয়োগ না পায়।
তবে এটা ‘খুব একটা ভাল সিদ্ধান্ত’ হয়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, এটা আরেকটা সমস্যা তৈরি করবে। এখন স্বতন্ত্র পরিচালক হন শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের কাছের বন্ধু-বান্ধবরা। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে স্বতন্ত্র পরিচালক হবেন রাজনৈতিক প্রভাবসম্পন্ন ব্যক্তিরা। তাতে কোম্পানিগুলোতে সুশাসন আসবে না।
“বিএসইসিতো সরকারি রেগুলেটর। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে এসব প্রতিষ্ঠান প্রায়ই রাজনীতিকদের দখলে চলে যায়। এখানে এমনসব লোকজন চলে আসেন, যারা রাজনৈতিক চাপে মাথা নত করে ফেলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর কর্পোরেট গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স স্টাডিজের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম বাকী খলিলীও মনে করেন, বিএসইসির প্যানেল থেকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের সুযোগে কোম্পানিগুলোতে ‘রাজনৈতিক প্রভাব’ ঢুকবে। পাশাপাশি এটি অন্যান্য আইনের সাথে সাংঘর্ষিকও হতে পারে। কারণ স্বাধীন পারচালক নিয়োগের দায়িত্ব শুধু বিএসইসির নয় এ ব্যাপারে কোম্পানি আইনে এবং ব্যাংক কোম্পানি আইনেরও দিক নির্দেশনা থাকতে পারে।
তবে বিএসইসির এই প্যানেল থেকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ বাধ্যতামূলক না হয়ে যদি ঐচ্ছিক হয়, অর্থাৎ কোম্পানির পক্ষ থেকে যোগ্য স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে বিএসইসির অনুমোদনের বিধান রাখা হয়, তখনই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করেন খলিলী।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম অবশ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার নতুন সিদ্ধান্ত ‘পরীক্ষামূলকভাবে’ চালানোর পক্ষে। তিনি বলেন, “আমি নতুন পদ্ধতি পরীক্ষা করার পক্ষে। কারণ যেহেতু আগেরটা ফেইল করেছে… স্বতন্ত্র পরিচালকদের প্যানেল করা হোক, দেখা যাক ফলাফল কী হয়।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, স্বতন্ত্র পরিচালকদের প্যানেলের দুটো দিক আছে। এতদিন দেখা গেছে কোম্পানিগুলোর কাছে এই পরিচালক নির্বাচনের সুযোগ ছিল।
“তারা নিজের মামা-শালা অর্থাৎ কাছের লোকদের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিতেন। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে বিএসইসি স্বতন্ত্র পরিচালকদের প্যানেল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে এখন দক্ষ লোকরা স্বতন্ত্র পরিচালক হতে পারবেন। তবে এর বিপক্ষেও যুক্তি আছে, এখানে দেখা যাবে আনওয়ান্টেড লোক চলে আসতে পারে।”
তবে এই প্যানেল গঠনের সিদ্ধান্ত বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে বলে বলে মনে করেন বিএসইসির সাবেক এক কমিশনার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ব্যাংক-কোম্পানি আইন অনুসারে ব্যাংকগুলোকে পরিচালক নিয়োগ দিতে হলে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও অনুমোদন নিতে হয়। সে হিসেবে স্বতন্ত্র পরিচালকদের প্যানেল কার্যকর হবে না।