রেজোয়ান আহমেদ : তিন বছর আগে বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার পরেও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে খুব একটা পরিবর্তন এসেছে বলাটা কঠিন। তারা এখনো হুজুগে বিনিয়োগ এবং গেম্বলারদেরকে অনুসরন করে। এমনকি কোন কিছু না জেনেই কৃত্রিম ক্রেতার ফাঁদে পড়ে নতুন শেয়ারে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নিয়মিত। অথচ ওই জাতীয় অন্য কোম্পানি অনেক আগে থেকে শেয়ারবাজারে ভালো ব্যবসা নিয়ে কম দামে থাকলেও তাতে আগ্রহী হয় না।
আগের ন্যায় শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সময়ে লেনদেন শুরু হওয়া কোম্পানির ক্ষেত্রেও বিনিয়োগকারীদের পূর্বের আচরন বিদ্যমান রয়েছে। তারা কোম্পানির পারফরমেন্স না দেখেই নতুন শেয়ারে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। যার ফলে একটি সময়ে গিয়ে প্রতিটি নতুন শেয়ারের দর কমে আসছে।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, দূর্বল কিংবা সবল, যেকোন ধরনের নতুন কোম্পানির শেয়ার পেতে বিনিয়োগকারীরা মরিয়া হয়ে উঠে। যাতে নতুন শেয়ারগুলো মৌলভিত্তি ছাড়াই টানা দর বাড়ে। কিন্তু একসময় অযৌক্তিক দর বৃদ্ধির কারনে তার পতন হতেই হয়। বিনিয়োগকারীদের এই নির্বুদ্ধিতার বিনিয়োগের কারনে আইপিওধারীরা লাভবান হলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে সেকেন্ডারীর বিনিয়োগকারীদেরকে লোকসান গুণতে হয়।
বিনিয়োগকারীদের এই নির্বুদ্ধিতাকে স্বার্থ হাসিলে একটি গোষ্ঠী কাজে লাগাচ্ছে বলে জানান এক শীর্ষ স্থানীয় ব্রোকারেজ হাউজের কর্ণধার। তিনি বলেন, ওই গোষ্ঠীটি নতুন শেয়ারের টানা দর বাড়াতে কোটি কোটি শেয়ারের কৃত্রিম ক্রয় আদেশ দেয়। আর এই ক্রয় আদেশ দেখে সবাই বিক্রি বন্ধ করে দেয় এবং সাধারন বিনিয়োগকারীরাদের ওই শেয়ারে আগ্রহ তৈরী হয়। যাতে করে টানা হল্টেড হতে থাকে। এভাবে কৃত্রিমভাবে দর বাড়িয়ে এক পর্যায়ে গিয়ে ওই গোষ্ঠীটি তাদের শেয়ার বিক্রি শুরু করে এবং সাধারন বিনিয়োগকারীরা কিনতে থাকে। এরফলে চূড়ান্তভাবে সাধারন বিনিয়োগকারীদেরকেই লোকসান গুণতে হয়।
অথচ ওই কোটি কোটি শেয়ারের ক্রয় আদেশের সময় যদি বিক্রির চাপ তৈরী হয়, তাহলে তা অর্থের অভাবে বাস্তবায়ন হবে না বলে জানান তিনি। কারন হিসেবে বলেন, টাকা ছাড়াই এখন নতুন শেয়ারে বড় বড় ক্রয় আদেশ দেওয়া হচ্ছে। এই আদেশে শেয়ার কেনা না লাগলেও বিনিয়োগকারীদেরকে আকৃষ্ট করা যাচ্ছে। তবে বিক্রির চাপ তৈরী হলে ওই সব কৃত্রিম ক্রেতা থাকবে না। তারা তাদের ক্রয় আদেশ তুলে নেবে।
সম্প্রতি লেনদেনে আসা রবি আজিয়াটা এবং এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশনে কৃত্রিম ক্রয় আদেশ নিয়ে শেয়ারবাজারের বিভিন্ন মহলে আলোচনা করতে দেখা গেছে। কারন রবি আজিয়াটার শেয়ারে ৭০ টাকাতে কোটি কোটি শেয়ারের ক্রেতা থাকলেও এখন ৫৫ টাকাতে নেই। এছাড়া এনার্জিপ্যাকের ৯০ টাকার উপরে অনেক শেয়ারের ক্রেতা থাকলেও এখন টানা লুজারের শীর্ষ স্থান দখল করছে কোম্পানিটি।
অবশ্য এই কৃত্রিম ক্রয় আদেশ নিয়ে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে বিএসইসি। এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহি পরিচালক ও মূখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম সাংবাদিকদের এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বলেন, নতুন শেয়ারে বড় বড় ক্রয় আদেশগুলো যাচাই করবে কমিশন। এক্ষেত্রে দেখা হবে, যারা ক্রয় আদেশ দেয়, তাদের আসলে কেনার মতো টাকা থাকে কিনা।
আরও পড়ুন….
কোম্পানির পর্ষদ পূণ:গঠনের সুফল পেতে শুরু করেছে বিনিয়োগকারীরা
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নির্ধারিত দরের শেয়ারও লেনদেনের শুরুতে টানা বৃদ্ধি পায়। এটা খুবই অবাক করার বিষয়। যেখানে বুক বিল্ডিংয়ে যোগ্য বিনিয়োগকারীদের নির্ধারিত দরকেই অতিমূল্যায়িত বলে অভিযোগ ওঠে, সেখানে সেইসব শেয়ারও লেনদেনে এসে টানা দর বৃদ্ধি পায়।
দেখা গেছে, নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পরে ৭টি কোম্পানির লেনদেন শুরু হয়েছে। যার সবগুলো শেয়ার লেনদেনের প্রথম দিন থেকে টানা বাড়ে। কিন্তু কোনটিই সেই দর ধরে রাখতে পারেনি। প্রত্যেকটি শেয়ারের দর কয়েকদিনের ব্যবধানে নেমে এসেছে। এক্ষেত্রে গড়ে কোম্পানিগুলোর দর পতন হয়েছে ২৭ শতাংশ।
ওই ৭টি কোম্পানির মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দর পতন হয়েছে ২ ডিসেম্বর লেনদেন শুরু হওয়া ডমিনেজ স্টিলের। ১০ টাকা ইস্যু মূল্যের শেয়ারটি টানা বেড়ে ৯ কার্যদিবসের ব্যবধানে ১৪ ডিসেম্বর হয় ৪৩.৩০ টাকা। অর্থাৎ ওই সময় শেয়ারটির দর বাড়ে ৩৩.৩০ টাকা বা ৩৩৩ শতাংশ। কিন্তু সেই শেয়ারটি ২৮ জানুয়ারি ২৭ টাকায় নেমে এসেছে। এ হিসেবে শেয়ারটির ৩৭.৬৪ শতাংশ দর পতন হয়ে গেছে। অথচ আগের টানা উত্থান এবং পরবর্তীতে পতনের পেছনে কোন যৌক্তিক কারন নেই।
নিম্নে কোম্পানিগুলোর শেয়ার দরের বিস্তারিত তুলে ধরা হল-
কোম্পানির নাম | লেনদেন শুরু | ইস্যু মূল্য (টাকা) | সর্বোচ্চ দর (টাকা) | ২৮ জানুয়ারির দর (টাকা) | পতনের হার |
এনার্জিপ্যাক পাওয়ার | ১৯ জানুয়ারি | ৩৫ | ৯২.৬০ | ৭১.৭০ | ২২.৫৭% |
রবি আজিয়াটা | ২৪ ডিসেম্বর | ১০ | ৭০.১০ | ৫৩.১০ | ২৪.২৫% |
ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স | ২১ ডিসেম্বর | ১০ | ৫৩.৮০ | ৪৩ | ২০.০৭% |
ডমিনেজ স্টিল | ২ ডিসেম্বদর | ১০ | ৪৩.৩০ | ২৭ | ৩৭.৬৪% |
এসোসিয়েটেড অক্সিজেন | ২৫ অক্টোবর | ১০ | ৬৫.৬০ | ৪৩.৯০ | ৩৩.০৮% |
ওয়ালটন হাইটেক | ২৩ সেপ্টেম্বর | ৩১৫ | ১১৭৯.১০ | ১০২৫.৬০ | ১৩.০২% |
এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স | ২৪ আগস্ট | ১০ | ৪৪.৭০ | ২৭.৭০ | ৩৮.০৩% |
দেশের শেয়ারবাজারে সর্বশেষ গত ১৯ জানুয়ারি লেনদেন শুরু হয়েছে এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশনের। যোগ্য বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নির্ধারিত ৩৫ টাকা মূল্যের এই কোম্পানির শেয়ারটি প্রতিদিন সর্বোচ্চ সীমায় বাড়তে বাড়তে ২৫ জানুয়ারি ৯২.৬০ টাকা হয়ে যায়। কিন্তু সেই শেয়ারটি সর্বশেষ ৩ কার্যদিবস লুজারের শীর্ষ স্থান দখল করেছে। এর আগে কেনো টানা বাড়ল এবং পরবর্তীতে কেনো কমল, তার কোন জবাব নেই।
ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, বুদ্ধি-বিবেচনা না করে এবং পারফরমেন্স না দেখেই নতুন শেয়ারে বিনিয়োগকারীদেরকে ঝাঁপিয়ে পড়তে আগেও দেখা গেছে, যা এখনো চলমান রয়েছে। কিন্তু একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগের আগে ওই কোম্পানির পারফরমেন্স দেখার জন্য অপেক্ষা করা উচিত। কারন আইপিও পেতে কৃত্রিম বা অতিরঞ্জিত আর্থিক হিসাব দেখালেও তালিকাভুক্ত হওয়ার পরে লভ্যাংশ দেওয়া লাগায় ধীরে ধীরে কোম্পানির প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসে।
তিনি বলেন, নতুন শেয়ারে ঝাঁপিয়ে পড়া একটি মনস্তাত্তিক বিষয় হয়ে দাড়িঁয়েছে। এক্ষেত্রে একটা সময়ে গিয়ে লোকসান নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও বিনিয়োগকারীরা এমনটি করে। অথচ ওই একই খাতের পুরাতন, পরীক্ষিত এবং ভালো কোম্পানি থাকলেও তাতে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হয় না। এমনকি দামে কম হলেও সেখানে যায় না।
বিজনেস আওয়ার/৩১ জানুয়ারি, ২০২১/আরএ