নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) শেয়ারবাজারকে এগিয়ে নিতে নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ তাতে পিছু টেনে ধরছে। অথচ বাজারের উন্নয়নে তাদেরই অগ্রণী ভূমিকা রাখা দরকার। কিন্তু তারা বারবার অদক্ষ লোককে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টার মাধ্যমে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন। যে স্টক এক্সচেঞ্জটি দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি পথচলার পরেও আইটি খাতে নিরলস সাপোর্ট দিতে পারছে না। যার ফলপ্রসু করোনার সময় পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার ৬৬দিন বন্ধ থাকার রেকর্ড করেছে। যা বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার সর্ম্পকে নেতিবাচক ধারনা তৈরী করেছে।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বিজনেস আওয়ারকে বলেন, এরা এফডিআর ও বিএসইসির উপর নির্ভর করে চলে। যেখানে তদবির করে নিয়োগ পাওয়া যায়, সেখানে ভালো কিছু আশা করা যায় না। অথচ স্টক এক্সচেঞ্জে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া উচিত। যারা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবসায় উন্নতি করতে সক্ষম। আর সিএসইতে তো লেনদেনই হয় না। এরা বসে বসে বেতন ভাতা নিতেছে। একইসঙ্গে পর্ষদের লোকজনও ভালো মিটিং ফি নিচ্ছে। অথচ শেয়ারবাজারের উন্নয়নে বিএসইসির পাশাপাশি তাদেরও সমানতালে ভূমিকা রাখা উচিত। স্টক এক্সচেঞ্জ পিছিয়ে থাকলে শুধুমাত্র বিএসইসির একক চেষ্টায় বাজারের উন্নতি করা সম্ভব না।
বিএসইসি বাজারকে এগিয়ে নিতে চাইলেও স্টক এক্সচেঞ্জ যে পিছিয়ে বা তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না, এই অভিযোগ অনেক পুরাতন। সাবেক কমিশনার অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন নিজামী থেকে শুরু করে বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদও এই অভিযোগ বা সমালোচনা করেছেন। কিন্তু ডিএসইর কোন উন্নতি হচ্ছে না। তবে বাজারের উন্নতি জন্য বা অন্য যেকোন কারনেই হোক, ডিএসইতে নিয়মিত পর্ষদ সভা আয়োজিত হয়।
তবে দেশে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) নামে আরও একটি শেয়ারবাজার থাকলেও সেটা না থাকার মতোই। যে কারনে স্টক এক্সচেঞ্জটি কখনো আলোচনা বা সমালোচনায় উঠে আসে না। যাতে করে সেখানে যোগ্য বা অযোগ্য, যাকেই নিয়োগ দেওয়া হোক না কেনো, তাও কখনো আলোচনার জন্ম দেয় না। দুই যুগ পথচলার পরেও এই দূরাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য স্টক এক্সচেঞ্জটি দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন শেয়ারবাজারকে এগিয়ে নিতে গত কয়েক মাসে নানা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরমধ্যে দোষীদেরকে শাস্তির আওতায় আনা এবং কাজের গতি বৃদ্ধি অন্যতম। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি করে ডিএসইর লেনদনকে মাত্র কয়েক কোটি টাকা থেকে আড়াই হাজার কোটিতে উন্নিত করেছে। এছাড়াও লেনদেনে ভারসাম্য রাখার জন্য বিদেশী বিনিয়োগসহ অবন্ঠিত কয়েক হাজার কোটি টাকার ফান্ড গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তারপরেও লেনদেনের গতি ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এতে সবার প্রথম এবং সবচেয়ে বড় ধাক্কা দেয় ডিএসইর আইটি দূর্বলতা।
ডিএসইর এই আইটি দূর্বলতার কারনে বিনিয়োগকারীদেরকে দফায় দফায় লেনদেনে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিরুপ প্রভাব ফেলেছে। একইসঙ্গে বিদেশীসহ প্রবাসিদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরী করেছে। যাতে করে লেনদেনে পতন হয়েছে।
এছাড়াও গতানুগতিক কাজের বাহিরে গিয়ে শেয়ারবাজারের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে না পারলেও স্টক এক্সচেঞ্জটিতে বারবার অযোগ্য ব্যক্তিকে ব্যবস্থাপনার প্রধান হিসেবে এমডি পদে নিয়োগ করার চেষ্টা করতে দেখা গেছে। শেয়ারবাজারের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষার্থে এই নিয়োগের চেষ্টা করা হয়েছে বলে বাজারে গুঞ্জন আছে।
ডিএসইর পর্ষদের কিছু লোকের এই খামখেয়ালিপনা সিদ্ধান্তের কারনে স্টক এক্সচেঞ্জটিকে নিয়ে শেয়ারবাজারের বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এমনকি বিএসইসিও তাদের এই কর্মকাণ্ডে নাখোশ।
সবচেয়ে বেশি সমালোচনার জন্ম দিয়েছে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সানাউল হককে এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে। এতে অবশ্য ডিএসইর ৩ জন শেয়ারহোল্ডার পরিচালক বিরোধীতা করেন। তারপরেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তাকে ডিএসইর পর্ষদ নিয়োগ দেয়। কিন্তু ৩ বছরের নিয়োগ চুক্তির ১ বছর পার না হতেই পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন কাজী সানাউল। এরমধ্যে আবার শেয়ারবাজার বন্ধ ছিল ৬৬দিন। যিনি পদত্যাগের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন তাকে নিয়োগ কতটা অযৌক্তিক ছিল।
এরপরেও থেমে থাকেনি ডিএসই। কাজী সানাউল হকের অধ্যায় পার হওয়ার পরে যোগ্য নয় এমন আরেক ব্যক্তিকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় স্টক এক্সচেঞ্জটির পর্ষদ। তারা এবার সিটি ব্যাংকের চিফ কান্ট্রি কমপ্লায়েন্স অফিসার (সিসিসিও) ও চিফ অ্যান্টি মানি লন্ডারিং অফিসার (সিএএমএলও) এম আশিক রহমানকে নিয়োগের চেষ্টা করে। তবে এই দফায় বিএসইসির বাধায় তা ব্যর্থ হয়।
ডিএসই পরিচালনার যোগ্যতা নেই বিবেচনায় আশিক রহমানকে নিয়োগের প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছে বিএসইসি। এরপরেও স্টক এক্সচেঞ্জটির মধ্যে কোন সচেতনতা তৈরী হবে কিনা, তা সময় বলে দেবে।
আশিক রহমানকে নির্বাচিত করার বিষয়ে এক অনুষ্ঠানে ডিএসইর চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বলেন, আবেদনকারীদের মধ্যে পর্ষদ তাকে যোগ্য মনে করেই এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়।
ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বিজনেস আওয়ারকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে একজন যোগ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ দিতে না পারা ডিএসইর জন্য খুবই দুঃখজনক। অথচ এটি শেয়ারবাজারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ। তাই দ্রুত সময়ে ডিএসইর সব পরিচালকের সম্মতিতে একজন যোগ্য ব্যক্তিকে এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া উচিত।
এদিকে শেয়ারবাজারের উন্নয়নে, বিশেষ করে ভালো কোম্পানি আনা ও লেনদেন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিএসইসিকেই দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। অথচ এই দায়িত্ব পালন করার কথা ডিএসইর। একটি কোম্পানি লিস্টিংয়ের মাধ্যমে স্টক এক্সচেঞ্জের আয় বাড়ে। এক্ষেত্রে লিস্টিং ফির পাশাপাশি লেনদেন থেকে কমিশন পেয়ে থাকে। কিন্তু এই স্বার্থ না থাকা সত্ত্বেও জনবল সংকট নিয়েই বাজার নিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি এসব কাজ করে যাচ্ছে কমিশন। এমনকি বাজারে লেনদেন বাড়ানোর জন্য সম্প্রতি বিদেশের মাটিতে রোড শো করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। অথচ বিএসইসির থেকে ৩গুণ বা প্রায় ৩৬০ জনের বিশাল জনবল নিয়েও ডিএসইর এসব কর্মকাণ্ড করতে দেখা যায় না।
অথচ নিজেদের স্বার্থেই লেনদেন বাড়ানোর দায়িত্বটা নেওয়া উচিত স্টক এক্সচেঞ্জের। লেনদেন বেশি হলে স্টক এক্সচেঞ্জ কমিশন পাবে। এর সাথে বিএসইসির কোন ব্যবসা নেই। তারপরেও লেনদেন বাড়ানোর জন্য বিএসইসিকে যতটা ভূমিকা রাখতে দেখা যায়, তা স্টক এক্সচেঞ্জের ক্ষেত্রে চোখে পড়ে না।
স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবসায় উন্নতি না হলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে ব্যয় কম হয় না। উচ্চ বেতনে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হলেও ব্যবসা হয় গতানুগতিক।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কোন মন্তব্য করতে চাননি ডিএসইর সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী।
বিজনেস আওয়ার/২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১/আরএ