শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বিচ হ্যাচারির শেয়ার নিয়ে ২০০৯-১০ সালে কারসাজি করে কোম্পানিটির পরিচালকেরা এবং দুজন বিনিয়োগকারী। যাদেরকে সেই কেলেঙ্কারীর ১১ বছরের পরে এসে জরিমানা করে চিঠি দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এই দীর্ঘসময়ের ব্যবধানে শাস্তির চিঠি দেওয়ার আগেই মারা গেছেন শেয়ার কেলেঙ্কারীতে প্রধান অভিযুক্ত ও সবচেয়ে বেশি লাভবান হওয়া কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, এখনো ১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারীতে জড়িত অনেকের মামলা ঝুঁলে আছে। এই বিলম্ব বিচারব্যবস্থা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনাস্থা তৈরী করে। এরমধ্যে আদালতে যাওয়ার আগে কমিশনও যদি বিলম্ব করে, তাহলে অবশিষ্ট আস্থাটুকুও ধরে রাখা কঠিন হবে। তাই অপরাধীদেরকে দ্রুত শাস্তির আওতায় এনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দোষীদের বিরুদ্ধে বিদ্যমান মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। যাতে সবাই বুঝে অপরাধ করলে অপরাধীকে শাস্তি পেতেই হবে এবং গড়িমসির মাধ্যমে রেহাই পাওয়ার সুযোগ নেই।
২০০৯ ও ২০১০ সালে বিচ হ্যাচারির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে কোম্পানিটির পরিচালকেরা। মিথ্যা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রদানের মাধ্যমে উচ্চ দরে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে। এছাড়া কোম্পানির বাহিরেও দুইজন বিনিয়োগকারী অস্বাভাবিক লেনদেনের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়। যে অপরাধের জন্য গত ৩ মে জরিমানা করে চিঠি দিয়েছে বিএসইসি। কিন্তু এর আগেই মারা গেছেন বিচ হ্যাচারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম।
মারা যাওয়ার কারনে শরিফুল ইসলামকে জরিমানা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে কমিশন। অন্যান্যদের মধ্যে বিচ হ্যাচারির পরিচালক ও শরিফুল ইসলামের স্ত্রী ফাহমিদা ইসলামকে ১০ লাখ টাকা, কর্পোরেট পরিচালক মেঘনা শ্রিম্প কালচার লিমিটেডকে ২৫ লাখ টাকা ও পরিচালক সাঈদ নুর আহমেদকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে।
বিচ হ্যাচারির উদ্যোক্তা/পরিচালকদের বাহিরে এনবিএল সি্কিউরিটিজের গ্রাহক মোহাম্মদ সাইফ উল্লাহকে (ক্লায়েন্ট কোড ০১৫৭১ ও ০১৫৯১) ১৫ লাখ টাকা ও ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন সার্ভিসেস এর গ্রাহক এস.এম মফিদুল হককে (ক্লায়েন্ট কোড ১৪৯২৩) ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বিএসইসি।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বিজনেস আওয়ারকে বলেন, অপরাধীকে শাস্তি প্রদানে শুধুমাত্র শেয়ারবাজারে না, পুরো দেশেই ধীরগতি। এই শেয়ারবাজারে এখনো ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারীতে অভিযুক্তরা শাস্তির বাহিরে রয়েছে। যে কারনে বিনিয়োগকারীদের মনে শেয়ার কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে বিচারহীনতার ধারনা আছে।
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহি পরিচালক ও মূখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিজনেস আওয়ারকে বলেন, আসলে কমিশনে প্রয়োজনের তুলনায় জনবল অনেক কম। এরমধ্যে সব বিভাগের ফাইল এনফোর্সমেন্ট বিভাগে যায়। তারা সেগুলো নিয়ে আইনকানুনের বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে শোকজ ও শুনানি করে। এই জনবলের সংকটের কারনে সবকাজ সঠিক সময়ে করা কঠিন হয়ে যায়। তারপরেও কমিশন চেষ্টা করছে অভিযোগগুলো দ্রুত সমাধান করার জন্য। যাতে আগামিতে ঝুলে থাকা অভিযোগ কমে আসবে।
বিচ হ্যাচারির কেলেঙ্কারীতে গঠিত বিএসইসির তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, শেয়ারবাজারের কালো অধ্যায় ২০১০ সালের মহাধসে সরকার উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। যে কমিটির সুপারিশের আলোকে বিএসইসি আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। যাদের তদন্তে বিচ হ্যাচারির শেয়ার কেলেঙ্কারীর বিষয়টি বেরিয়ে আসে।
তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ি, ২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিচ হ্যাচারির শেয়ার ৫.৮০ টাকা থেকে বেড়ে ১১৯.১০ টাকা হয়ে যায়। এই দর বৃদ্ধির মধ্যে ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে ২০১০ সালের ২৭ মে সময়কালীন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফুল ইসলাম ৪১ লাখ ১৫ হাজার, পরিচালক ফাহমিদা ইসলাম ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৮০০টি, কর্পোরেট পরিচালক মেঘনা শ্রিম্প কালচার ৭ লাখ ২৫ হাজার, পরিচালক সাঈদ নুর আহমেদ ৫ লাখ, পরিচালক নজরুল ইসলাম (অব:) ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮০০টি ও কর্পোরেট পরিচালক যুব কর্মসংস্থান সোস্যাইটি (অব:) ১২ লাখ ৩২ হাজার শেয়ার বিক্রি করে। এই সময়ে পরিচালকেরা ৭৪ লাখ ৪১ হাজার ৬০০টি শেয়ার বিক্রি করে। যা কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৩৩.৮৩ শতাংশ।
ওই সময় শুধুমাত্র বিচ হ্যাচারির পরিচালক ফাহমিদা ইসলাম বিক্রির পাশাপাশি ৬ লাখ ৩২ হাজার শেয়ার ক্রয় করেন। বাকিরা সবাই শুধু বিক্রি করেছেন।
এই বিক্রির মাধ্যমে শরিফুল ইসলাম ২৩ কোটি ২২ লাখ টাকা তুলে নেয়। এছাড়া কর্পোরেট পরিচালক মেঘনা শ্রিম্প কালচার ৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, পরিচালক সাঈদ নুর আহমেদ ৩ কোটি ৮ লাখ টাকা, পরিচালক নজরুল ইসলাম (অব:) ৯৩ লাখ টাকা ও কর্পোরেট পরিচালক যুব কর্মসংস্থান সোস্যাইটি (অব:) ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা তুলে নেয়।
বিচ হ্যাচারির ওইসময় অস্বভাবিক দর বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারন হিসেবে ছিল পরিচালকদের মিথ্যা ৪টি স্টিল বডির ট্রলার কেনার ঘোষণা। যারা ফাইনালি ট্রলার কেনা বাতিল করে। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এই বাতিলের মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করে না। তা না করে ওইসময় পরিচালকেরা নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে। এক্ষেত্রে বিচ হ্যাচারির উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশের ১৭(এ), (বি) ও (সি) লঙ্ঘন করে।
এই লঙ্ঘনের অপরাধে বিএসইসি বিচ হ্যাচারির পরিচালকদের শুনানিতে ডাকে। এর আলোকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ২০১৫ সালের ১৪ মে উপস্থিত হয়ে লিখিত বক্তব্য দেন। এতে তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে চাহিদা ও যোগানের উপরে উপরে শেয়ারের দর উঠানামা করাটা স্বাভাবিক ঘটনা। এরমধ্যে ১৯৯৬ সালের ধসের পরে ২০০৯ সালে শেয়ারবাজার ছিল বুমিং। যেখানে সব খাতের শেয়ারের দর বেড়েছে। এছাড়া বিচ হ্যাচারির ইপিএস, এনএভি ও ডিভিডেন্ড ইল্ড ভালো ছিল। যাতে বিচ হ্যাচারির শেয়ার দর বেড়েছে। যা মাঝেমধ্যে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।
তিনি লিখিত বক্তব্যে আরও জানান, আমাদের পরিচালকেরা সঠিক ডিসক্লোজার ও সব নিয়ম পরিপালনের মাধ্যমে শেয়ার বিক্রি করেছেন। ওইসময় পরিচালকেরা ৫৫ টাকা গড়ে প্রতিটি শেয়ার বিক্রি করেছে। অথচ শেয়ারটি ১১৯.৪০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। ফলে পরিচালকেরা যদি ম্যানুপুলেশনের সঙ্গে জড়িত থাকত, তাহলে তারা প্রতিটি ১১৯ টাকা করে বিক্রি করতে পারত।
এছাড়া ট্রলার ক্রয় ব্যবসার একটি স্বাভাবিক অংশ বলে জানান বিচ হ্যাচারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তবে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের অর্থায়নে অনিচ্ছার কারনে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এমনকি বিকল্প হিসেবে ১টি সাধারন শেয়ারের বিপরীতে ২টি রাইট শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত নিলেও তার অনুমোদন পাইনি।
তবে কমিশনের কাছে শরিফুল ইসলামের এই ব্যাখ্যা গ্রহনযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। যে কারনে শেয়ারবাজারের শঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জনস্বার্থে শরিফুল ইসলাম, ফাহমিদা ইসলাম, মেঘনা শ্রিম্প কালচার, সাঈদ নুর আহমেদকে জরিমানা সমীচিন মনে করে কমিশন। কিন্তু এরমধ্যে মৃত্যুজনিত কারনে শরিফুল ইসলামকে জরিমানা থেকে মওকুফ ও অন্যদের শাস্তি প্রদান করে চিঠি দিয়েছে।
পরিচালকদের বাহিরে ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন সার্ভিসেসের গ্রাহক এমএম মফিদুল হক ম্যানুপুলেটেড করে বিচ হ্যাচারির শেয়ার বিক্রি করে অনেক টাকা আয় করে বলে বিএসইসির তদন্তে বেরিয়ে আসে। যিনি সিরিয়াল ট্রেডিংয়ের সঙ্গে সরাসরি অংশগ্রহন বরেন। এই মফিদুল হক ২০০৯-১০ সালে ৬ লাখ ৪৮ হাজার শেয়ার গড়ে প্রতিটি ৯৪.০৩ টাকা করে বিক্রি করেন।
তার লেনদেনের ক্ষেত্রে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ১৯৬৯ এর ধারা ১৭ (ই)(৩) ও (৫) লঙ্ঘন হয়। এ কারনে তার ব্যাখ্যা চেয়ে ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর শুনানিতে ডাকা হলে সময় বাড়ানোর আবেদন করে। যা বাড়িয়ে ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল এবং ১৪ মে নির্ধারন করে। এরপরেও তিনি আবারও পূণ:সময় আবেদন করলে কমিশন তা নাখোচ করে দেয়।
এসব পরিস্থিতিতে মফিদুল হককে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে চিঠি দিয়েছে কমিশন। যা চিঠি দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে বিএসইসির অনুকূলে জমা প্রদান করতে বলা হয়েছে। অন্যথায় তার পরিচালিত বিও হিসাব স্থগিত এবং ওই বিও হিসাবের সিকিউরিটিজ বিক্রি করে জরিমানার টাকা আদায়ের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিক্রি করে পুরো টাকা আদায় না হলে আইনি ব্যবস্থা নেবে কমিশন।
মফিদুল হকের ন্যায় এনবিএল সিকিউরিটিজের মোহাম্মদ সাইফ উল্লাহ বিচ হ্যাচারির শেয়ারে ম্যানুপুলেট করে। তিনি ০১৫৭১ নং কোড থেকে ১০৪.৬৮ টাকা করে ৬ লাখ এবং ০১৫৯১ নং কোড থেকে ১০৫.০৬ টাকা করে ৫৫ হাজার শেয়ার ক্রয় করেন। এরপরে ১১৬.২০ টাকা করে ৬ লাখ এবং ১০৬ টাকা করে ৫৫ হাজার শেয়ার বিক্রি করেন। এই লেনদেনের মাধ্যমে তিনি ক্রয় চাপ তৈরী করেন এবং সরবরাহ সংকট তৈরী করেন। যা শেয়ারটির দর বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে।
এই অনিয়মের বিষয়ে ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর শুনানিতে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ২০১০ সালের ২৪ নভেম্বর বিচ হ্যাচারির ১৮ লাখ ৮৩ হাজার ৫০০টি শেয়ার লেনদেন হয়েছিল। এরমধ্যে আমার কেনা শেয়ারের সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৫৫ হাজার। যা ওইদিনের লেনদেনের ৩৪.৭৭ শতাংশ। এরপরে ২৫ নভেম্বর ১৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫০০টি ও ২৮ নভেম্বর ১৩ লাখ ৬৩ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল। অর্থাৎ ২৪-২৮ নভেম্বরের ৩ কার্যদিবসে ৫১ লাখ ১১ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল। এ হিসেবে আমার লেনদেনের পরিমাণ ১২.৮১ শতাংশ। এরফলে আমার পক্ষে বিচ হ্যাচারির শেয়ার সরবরাহে সংকট তৈরী করা সম্ভব ছিল না।
তবে কমিশন তার ব্যাখ্যাকে গ্রহনযোগ্য মনে করেনি। আর অনিয়মের কারনে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে।
বিজনেস আওয়ার/০৮ জুন, ২০২১/আরএ
One thought on “বিচ হ্যাচারির শেয়ার কেলেঙ্কারির ১১ বছর পরে এসে জরিমানা, আগেই মূলহোতার মৃত্যু”