বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক : আজ ভয়াল ২১ আগস্ট। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির সমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা হয়। সেদিন আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২২ জন নেতা-কর্মী প্রাণ হারান।
আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে সংগঠনের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের প্রথম সারির জাতীয় নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে ওই ঘৃণ্য হামলা চালায় ঘাতকচক্র। শুধু গ্রেনেড হামলাই নয়, সেদিন শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার গাড়ি লক্ষ্য করেও চালানো হয় গুলি। শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও তিনি আহত হন, তাঁর শ্রবণশক্তি চিরদিনের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকসহ আহত হন পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী। আজও সে আঘাত নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন অনেকে।
আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য, জোট সরকারের আমলে এ সংক্রান্ত মামলার সঠিক তদন্ত হয়নি, ষড়যন্ত্রের হোতাদের রক্ষার উদ্দেশ্যে মামলাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে এবং আলামত ধ্বংস করার নানাবিধ ষড়যন্ত্র হয়েছে। এমনকি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় গ্রেনেড হামলা মামলাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হয়।
সময়ের পরিক্রমায় এ ঘটনা নিয়ে দুইটি মামলা চলমান থাকে। একটি হত্যা মামলা এবং অপরটি বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আইনের মামলা। দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২০১৮ সালে আদালত ২১ আগস্ট দুই মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে জীবিত মোট ৪৯ আসামির মধ্যে ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনের যাবজ্জীবন এবং বাকি ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়।
মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাস্টারমাইন্ড বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ পালাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে আদালতের রায় কার্যকর করতে সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা এবং তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদে ওই দিন বিকেলে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এ সমাবেশে খোলা ট্রাকের ওপর স্থাপিত উন্মুক্ত মঞ্চে বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
বক্তৃতা শেষে ৫টা ২২ মিনিটে শেখ হাসিনা সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই বৃষ্টির মতো গ্রেনেড এসে সমাবেশস্থলে পড়তে থাকে। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, গুলিস্তান, পুরানা পল্টন ও এর আশপাশের এলাকা। গ্রেনেডের আঘাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ক্ষত-বিক্ষত হন এবং অনেকে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
চারদিক থেকে সভাস্থলে গ্রেনেড এসে পড়তে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে সমাবেশস্থল রক্তাক্ত হয়ে পড়ে, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিণত হয় রক্তাক্ত আর মৃত্যুর জনপদে। শত শত মানুষের আর্তচিৎকার, ছড়িয়ে-ছিঁটিয়ে পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন দেহ, রক্ত আর বারুদের পোড়া গন্ধে পুরো এলাকা জুড়ে বীভৎস পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
এ সময় সেখানে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ আহতদের সাহায্য করার পরিবর্তে ভীত-সন্ত্রস্ত এবং আহত মানুষের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা সেই গ্রেনেড হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের আঘাতে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন প্রাণ হারান। হামলায় ২৩ জন ঘটনাস্থলেই মারা যান। গুরুতর আহত অবস্থায় আইভি রহমান সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে ২৪ আগস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
গ্রেনেড বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাকে রক্ষা করার জন্য ট্রাকের ওপর মানববর্ম রচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এ হত্যাযজ্ঞ থেকে দলের নেত্রীকে বাঁচাতে নেতাকর্মীরা মানববর্ম দিয়ে আড়াল করে তাকে দ্রুত গাড়িতে তুলে দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে বের হওয়ার পথেই শেখ হাসিনার বুলেট প্রুফ গাড়িতেও ঘাতকরা অবিরাম গুলিবর্ষণ করে।
২১ আগস্টের এ ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় যারা নিহত হন, তারা হলেন আইভি রহমান, মোস্তাক আহমেদ সেন্টু, ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, রফিকুল ইসলাম আদা চাচা, সুফিয়া বেগম, হাসিনা মমতাজ রীনা, লিটন মুন্সী ওরফে লিটু, রতন সিকদার, মো. হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মামুন মৃধা, বেলাল হোসেন, আমিনুল ইসলাম, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, আতিক সরকার, নাসিরউদ্দিন সরদার, রেজিয়া বেগম, আবুল কাসেম, জাহেদ আলী, মমিন আলী, শামসুদ্দিন, আবুল কালাম আজাদ, ইছহাক মিয়া এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরো দু’জন।
বিজনেস আওয়ার/২১ আগস্ট, ২০২১/এ