ঢাকা , বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মেয়াদ বাড়ানো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত’

  • পোস্ট হয়েছে : ০৩:৪৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮
  • 23

রেজোয়ান আহমেদ : শেয়ারবাজারের স্বার্থে ২০১০ সালে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে কোন রকম যাছাই-বাছাই ছাড়াই সরকারের নির্দেশনায় গত ১৬ সেপ্টেম্বর সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এরমাধ্যমে আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। যা মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতটিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে বলে মনে করেন তারা।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, শেয়ারবাজারের স্বার্থ চিন্তা না করে, শুধুমাত্র সরকারের নির্দেশনায় মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি। এটি শেয়ারবাজারের অন্তরায় কাজ করবে। একইসঙ্গে মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতের জন্য এই সিদ্ধান্ত বড় ধাক্কা। এছাড়া এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একটি গোষ্ঠীকে সহযোগিতা করা হলেও বিনিয়োগকারীদেরকে বিপদের মুখে ও তাদের স্বার্থকে ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়নি। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা নতুন বাস্তবতার স্বীকার হবে।

মিউচ্যুয়াল ফান্ড আইনে মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ থাকলেও শেয়ারবাজারের স্বার্থে ২০১০ সালে তা স্থগিত করা হয়। তবে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপক বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য সেটিও আবার প্রত্যাহার করে নিয়েছে বিএসইসি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বিজনেস আওয়ারকে বলেন, মেয়াদি ফান্ডগুলো গঠন করা হয়েছে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে অবসায়নের জন্য। তাই ফান্ডগুলোর মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঠিক না। এ সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা তৈরী করতে পারে। প্রয়োজনে নতুন ফান্ড গঠন করা যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, বিএসইসি একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। শেয়ারবাজারের উন্নয়নে সকল সিদ্ধান্ত বিএসইসির নেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে সরকারের কোন সিদ্ধান্ত দেওয়া ঠিক না। তবে শেয়ারবাজারের স্বার্থে সরকার সুপারিশ করতে পারে। যা যাছাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেবে বিএসইসি।

জানা গেছে, একটি অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্ট প্রতিষ্ঠানের কিছু ফান্ডের মেয়াদ কয়েক বছরের মধ্যে শেষ হবে। তবে ওই অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্ট প্রতিষ্ঠান ফান্ডগুলোর টাকা অপব্যবহার করেছে। যাতে মেয়াদ শেষে অবসায়নে ইউনিটহোল্ডারদের টাকা প্রদানের সক্ষমতা নেই। এ কারনে শুরুতে ফান্ডের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য বিএসইসিতে তদবির করে। তবে এক্ষেত্রে বিএসইসি সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয়। পরে ওই অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্ট প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থমন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হয়। যার আলোকে অর্থমন্ত্রী ফান্ডের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য বিএসইসিতে সুপারিশ করে।

এর আগে ২০১৪ সালে বেশ কিছু মেয়াদি ফান্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে আসার প্রেক্ষাপটে দেশের প্রথম বেসরকারি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি এইমস বাংলাদেশ এইমস প্রথম এবং গ্রামীণ ওয়ান স্কিম-১ মিউচুয়াল ফান্ডের আরও ১০ বছর মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু শেয়ারবাজারের স্বার্থে বিএসইসি তা নাকচ করে দেয়। যা নিয়ে ২০১৬ সালের ৩১ মে এইমস ফার্স্ট ও গ্রামীণ ওয়ান: স্কিম ওয়ান মিউচুয়াল ফান্ডের অবসায়ন-সংক্রান্ত দায়ের করা সব রিট খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও মির্জা হোসেন হায়দারের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। এ রায়ের ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির প্রজ্ঞাপন অনুসারে মিউচুয়াল ফান্ডের অবসায়নের বাধা দূর হয়।

মিউচ্যুয়াল ফান্ড আইন ২০০১ এর ৫০খ ধারায় বলা হয়েছে, মেয়াদি স্কীমের মেয়াদ অনুরুপ একটি মেয়াদের জন্য বাড়ানো যাবে। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার ১ বছর আগে বিশেষ সভার (ইজিএম) মাধ্যমে ইউনিটহোল্ডারদের অনুমোদন নিতে হবে। এক্ষেত্রে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের মাধ্যমে এই মেয়াদ বাড়ানো যাবে। তবে ২০১০ সালে বিএসইসি এক আদেশের মাধ্যমে তা স্থগিত করেন।

২০১০ সালের ২৪ জানুয়ারির ওই আদেশে বলা হয়, শেয়ারবাজারের অব্যাহত উন্নয়ন ও জনস্বার্থে সকল মেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মেয়াদ ১০ বছরের বেশি হইবে না। আর চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বরের এক আদেশে সেটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে এবার কিসের স্বার্থে এমনটি করা হয়েছে, তা কমিশন উল্লেখ করেনি। শুধুমাত্র সরকারির নির্দেশনা মোতাবেক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে।

শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ বিজনেস আওয়ারকে বলেন, বিএসইসির উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্তের কারনে মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতটি ধ্বংসের পথে। সংস্থাটি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয় না। বরং বিনিয়োগকারীদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। এরা দেখে অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্টের স্বার্থ। যাতে এ খাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা শূন্যের কোঠায়।

তিনি বলেন, দুনিয়ার কোথাও মিউচ্যুয়াল ফান্ডে পূণ: বিনিয়োগের (আরআইইউ) সুযোগ নেই। অথচ বর্তমান কমিশন এই খাতে পূণ:বিনিয়োগের মাধ্যমে অ্যাসেট ম্যানেজারদের দূর্বলতাকে আড়াল করার সুযোগ করার দিয়েছে। এছাড়া মেয়াদি ফান্ডকে বে-মেয়াদিতে রুপান্তর করার মাধ্যমেও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর সর্বশেষ মেয়াদি ফান্ডের আরেক দফায় মেয়াদ বাড়ানোর মাধ্যমে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মাধ্যমে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের কফিনে শেষ পেরেকটি মেরেছে বিএসইসি।

তিনি আরও বলেন, বিএসইসি একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। এখানে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সরকারকে মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিএসইসির বোঝানো উচিত ছিল। কিন্তু তারা তা করে নাই। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে স্টেকহোল্ডারদের মতামত না নিয়ে, স্বার্থজড়িত অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্ট প্রতিষ্ঠানের মতামতের ভিত্তিতে করা হয়েছে। যারা মেয়াদ বাড়ানোর জন্য তারল্য সংকট হবে বলে একটি খোড়াঁ যুক্তি উপস্থাপন করেছে। অথচ অবসায়নের পরে প্রাপ্ত অর্থ ইউনিটহোল্ডারদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করাটাই স্বাভাবিক। এছাড়া ফান্ডগুলোর যে অর্থ অন্যত্র ব্যবহার করা হয়েছে, অবসায়নের মাধ্যমে সেগুলোও শেয়ারবাজারে আসার সুযোগ তৈরী হত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বিজনেস আওয়ারকে বলেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) মেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর মেয়াদ বাড়ানোর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। এক্ষেত্রে বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়নি। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা নতুন বাস্তবতার স্বীকার হবে।

তিনি বলেন, মেয়াদি ফান্ডগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে অবসায়নের জন্য। এটা জেনেই বিনিয়োগকারীরা ফান্ডগুলোতে বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু মেয়াদ বাড়ানোর মাধ্যমে তাদের বিনিয়োগ আটকে যাবে। তাই মেয়াদি ফান্ডগুলোর ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষে অবসায়ন করাই উচিত হবে।

তিনি আরও বলেন, ফান্ড ম্যানেজাররা অর্থের সঠিক ব্যবহার করতে পারেনি। একইসঙ্গে ফান্ডগুলোর প্রদত্ত নিট সম্পদের তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মনে করেন তিনি। যে কারনে অবসায়নে গেলে ইউনিটহোল্ডারদের অর্থ পরিশোধে তারা ব্যর্থ হবে। আর এই কারনেই সম্পদ ব্যবস্থাপকরা অবসায়ন ঠেকাতে অর্থমন্ত্রণালয় ও বিএসইসির দারস্থ হয়েছে।

বিজনেস আওয়ার/২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮/আরএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান:
ট্যাগ :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার মেইলে তথ্য জমা করুন

‘মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মেয়াদ বাড়ানো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত’

পোস্ট হয়েছে : ০৩:৪৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

রেজোয়ান আহমেদ : শেয়ারবাজারের স্বার্থে ২০১০ সালে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে কোন রকম যাছাই-বাছাই ছাড়াই সরকারের নির্দেশনায় গত ১৬ সেপ্টেম্বর সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এরমাধ্যমে আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। যা মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতটিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে বলে মনে করেন তারা।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, শেয়ারবাজারের স্বার্থ চিন্তা না করে, শুধুমাত্র সরকারের নির্দেশনায় মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি। এটি শেয়ারবাজারের অন্তরায় কাজ করবে। একইসঙ্গে মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতের জন্য এই সিদ্ধান্ত বড় ধাক্কা। এছাড়া এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একটি গোষ্ঠীকে সহযোগিতা করা হলেও বিনিয়োগকারীদেরকে বিপদের মুখে ও তাদের স্বার্থকে ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়নি। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা নতুন বাস্তবতার স্বীকার হবে।

মিউচ্যুয়াল ফান্ড আইনে মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ থাকলেও শেয়ারবাজারের স্বার্থে ২০১০ সালে তা স্থগিত করা হয়। তবে একটি সম্পদ ব্যবস্থাপক বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য সেটিও আবার প্রত্যাহার করে নিয়েছে বিএসইসি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বিজনেস আওয়ারকে বলেন, মেয়াদি ফান্ডগুলো গঠন করা হয়েছে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে অবসায়নের জন্য। তাই ফান্ডগুলোর মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঠিক না। এ সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা তৈরী করতে পারে। প্রয়োজনে নতুন ফান্ড গঠন করা যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, বিএসইসি একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। শেয়ারবাজারের উন্নয়নে সকল সিদ্ধান্ত বিএসইসির নেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে সরকারের কোন সিদ্ধান্ত দেওয়া ঠিক না। তবে শেয়ারবাজারের স্বার্থে সরকার সুপারিশ করতে পারে। যা যাছাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেবে বিএসইসি।

জানা গেছে, একটি অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্ট প্রতিষ্ঠানের কিছু ফান্ডের মেয়াদ কয়েক বছরের মধ্যে শেষ হবে। তবে ওই অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্ট প্রতিষ্ঠান ফান্ডগুলোর টাকা অপব্যবহার করেছে। যাতে মেয়াদ শেষে অবসায়নে ইউনিটহোল্ডারদের টাকা প্রদানের সক্ষমতা নেই। এ কারনে শুরুতে ফান্ডের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য বিএসইসিতে তদবির করে। তবে এক্ষেত্রে বিএসইসি সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয়। পরে ওই অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্ট প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থমন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হয়। যার আলোকে অর্থমন্ত্রী ফান্ডের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য বিএসইসিতে সুপারিশ করে।

এর আগে ২০১৪ সালে বেশ কিছু মেয়াদি ফান্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে আসার প্রেক্ষাপটে দেশের প্রথম বেসরকারি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি এইমস বাংলাদেশ এইমস প্রথম এবং গ্রামীণ ওয়ান স্কিম-১ মিউচুয়াল ফান্ডের আরও ১০ বছর মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু শেয়ারবাজারের স্বার্থে বিএসইসি তা নাকচ করে দেয়। যা নিয়ে ২০১৬ সালের ৩১ মে এইমস ফার্স্ট ও গ্রামীণ ওয়ান: স্কিম ওয়ান মিউচুয়াল ফান্ডের অবসায়ন-সংক্রান্ত দায়ের করা সব রিট খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও মির্জা হোসেন হায়দারের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। এ রায়ের ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির প্রজ্ঞাপন অনুসারে মিউচুয়াল ফান্ডের অবসায়নের বাধা দূর হয়।

মিউচ্যুয়াল ফান্ড আইন ২০০১ এর ৫০খ ধারায় বলা হয়েছে, মেয়াদি স্কীমের মেয়াদ অনুরুপ একটি মেয়াদের জন্য বাড়ানো যাবে। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার ১ বছর আগে বিশেষ সভার (ইজিএম) মাধ্যমে ইউনিটহোল্ডারদের অনুমোদন নিতে হবে। এক্ষেত্রে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের মাধ্যমে এই মেয়াদ বাড়ানো যাবে। তবে ২০১০ সালে বিএসইসি এক আদেশের মাধ্যমে তা স্থগিত করেন।

২০১০ সালের ২৪ জানুয়ারির ওই আদেশে বলা হয়, শেয়ারবাজারের অব্যাহত উন্নয়ন ও জনস্বার্থে সকল মেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মেয়াদ ১০ বছরের বেশি হইবে না। আর চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বরের এক আদেশে সেটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে এবার কিসের স্বার্থে এমনটি করা হয়েছে, তা কমিশন উল্লেখ করেনি। শুধুমাত্র সরকারির নির্দেশনা মোতাবেক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে।

শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ বিজনেস আওয়ারকে বলেন, বিএসইসির উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্তের কারনে মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতটি ধ্বংসের পথে। সংস্থাটি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয় না। বরং বিনিয়োগকারীদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। এরা দেখে অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্টের স্বার্থ। যাতে এ খাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা শূন্যের কোঠায়।

তিনি বলেন, দুনিয়ার কোথাও মিউচ্যুয়াল ফান্ডে পূণ: বিনিয়োগের (আরআইইউ) সুযোগ নেই। অথচ বর্তমান কমিশন এই খাতে পূণ:বিনিয়োগের মাধ্যমে অ্যাসেট ম্যানেজারদের দূর্বলতাকে আড়াল করার সুযোগ করার দিয়েছে। এছাড়া মেয়াদি ফান্ডকে বে-মেয়াদিতে রুপান্তর করার মাধ্যমেও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর সর্বশেষ মেয়াদি ফান্ডের আরেক দফায় মেয়াদ বাড়ানোর মাধ্যমে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মাধ্যমে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের কফিনে শেষ পেরেকটি মেরেছে বিএসইসি।

তিনি আরও বলেন, বিএসইসি একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। এখানে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সরকারকে মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিএসইসির বোঝানো উচিত ছিল। কিন্তু তারা তা করে নাই। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে স্টেকহোল্ডারদের মতামত না নিয়ে, স্বার্থজড়িত অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্ট প্রতিষ্ঠানের মতামতের ভিত্তিতে করা হয়েছে। যারা মেয়াদ বাড়ানোর জন্য তারল্য সংকট হবে বলে একটি খোড়াঁ যুক্তি উপস্থাপন করেছে। অথচ অবসায়নের পরে প্রাপ্ত অর্থ ইউনিটহোল্ডারদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করাটাই স্বাভাবিক। এছাড়া ফান্ডগুলোর যে অর্থ অন্যত্র ব্যবহার করা হয়েছে, অবসায়নের মাধ্যমে সেগুলোও শেয়ারবাজারে আসার সুযোগ তৈরী হত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বিজনেস আওয়ারকে বলেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) মেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর মেয়াদ বাড়ানোর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। এক্ষেত্রে বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়নি। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা নতুন বাস্তবতার স্বীকার হবে।

তিনি বলেন, মেয়াদি ফান্ডগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে অবসায়নের জন্য। এটা জেনেই বিনিয়োগকারীরা ফান্ডগুলোতে বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু মেয়াদ বাড়ানোর মাধ্যমে তাদের বিনিয়োগ আটকে যাবে। তাই মেয়াদি ফান্ডগুলোর ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষে অবসায়ন করাই উচিত হবে।

তিনি আরও বলেন, ফান্ড ম্যানেজাররা অর্থের সঠিক ব্যবহার করতে পারেনি। একইসঙ্গে ফান্ডগুলোর প্রদত্ত নিট সম্পদের তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মনে করেন তিনি। যে কারনে অবসায়নে গেলে ইউনিটহোল্ডারদের অর্থ পরিশোধে তারা ব্যর্থ হবে। আর এই কারনেই সম্পদ ব্যবস্থাপকরা অবসায়ন ঠেকাতে অর্থমন্ত্রণালয় ও বিএসইসির দারস্থ হয়েছে।

বিজনেস আওয়ার/২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮/আরএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান: