ঢাকা , সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চামড়া-হাড়-মাংস না কেটে ডিস্কের ঝুঁকিবিহীন অপারেশন

  • পোস্ট হয়েছে : ০২:২০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২ জানুয়ারী ২০২২
  • 76

মানুষের মেরুদণ্ডে শক্ত হাড় ছাড়াও দুই হাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে নরম হাড় (ইন্টারভার্টেব্রাল ডিস্ক) থাকে যা গাড়ীর স্প্রিং বা শক এবজরবারের মতো কাজ করে। সাধারণত ভারী জিনিস উঠানো, আঘাত, শরীরে বিশেষ অবস্থায় ঝুঁকি খাওয়াসহ নানাবিধ কারণে ডিস্কের স্থানচ্যুতি (প্রোল্যান্স) হয়ে সংলগ্ন মেরুরজ্জু (স্পাইনাল কর্ড) অথবা স্নায়ুমূল (নার্ভরুট) অথবা উভয়ের উপর চাপ পড়তে পারে। কোমরের (লাম্বার) ডিস্ক প্রল্যাপ্স রোগী তীব্র ব্যথা অনুভব করে। ফলে রোগী বসতে বা দাঁড়াতে পারে না। কোমরে উৎপন্ন ব্যথা কোমর থেকে পা পর্যন্ত স্নায়ুতে (নার্ভ) ছড়িয়ে পড়ে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে মাজা ব্যথার পাশাপাশি এক পাশ বা উভয় পাশের রানে, হাটুঁতে, হাঁটুর নিচে বা পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত যে কোন জায়গায় ব্যথা অনুভব হতে পারে। এ ছাড়াও উপরোক্ত জায়গাগুলোতে ঝিন-ঝিন, শিন-শিন করে, পায়ের বোধশক্তি কমে যায়, পর্য়ায়ক্রমে পা দুবর্ল হয়ে যেতে থাকে এবং এক পর্যায়ে রোগী হাঁটতে, দাঁড়াতে এমনকি বসতে পারে না। আবার ঘাড়ে (সারভাইকাল) উৎপন্ন ব্যথা ঘাড় থেকে হাত পর্যন্ত ¯œায়ুতে ছড়িয়ে থাকে। কাজেই ঘাড়ের ডিস্ক প্রোল্যাপ্সে প্রাথমিক পর্যায়ে ঘাড়ের ব্যথার পাশাপাশি ডান বা বাম হাত বা উভয় হাতে ব্যথা অনুভব হতে পারে। লাম্বার ডিস্ক প্রোল্যাপ্সের মতো এখানেও হাত ঝিন-ঝিন, শিন-শিন করে, হাতে বোধ শক্তি কমে যায়। এক পর্যায়ে হাত দুবর্ল হয়ে যেতে থাকে।

ভার্টেব্রাল ডিস্ক গঠনগতভাবে নিউক্লিয়াস প্যালপোসাস ( কেন্দ্রমধ্যস্থিত জেলির মতো পদার্থ) এবং অ্যানিউলাস ফাইব্রোসাস (চার পার্শ্বস্থ শক্ত ফাইবার বা আঁশ ও ছোট ছোট রক্তনালী) দিয়ে তৈরী। দাঁড়ানো অবস্থায় বা ভারি কিছু বহনকালে কেন্দ্রস্থিত জেলির উপর চাপ পড়ে। কিন্তু শক্ত অ্যানিউলাস ফাইব্রোসাস সেই চাপ নিয়ন্ত্রণ করে ডিস্কের গঠন ঠিক রাখে। কিন্তু বেশি ওজন বহনে বা অনিয়ন্ত্রিত নড়াচড়ায় নিউক্লিয়াস প্যালপোসাসের উপর মাত্রাতিরিক্ত বা অসম চাপ পড়ে গেলে সেই অতিরিক্ত চাপ (Raised Intradiscal Pressure) অ্যানিউলাস ফাইব্রোসাস আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে, নিউক্লিয়াস প্যালপোসাস অ্যানিউলাস ফাইব্রোসাস এবং কখনও কখনও অ্যানিউলাস ফাইব্রোসাস ছিঁড়ে কোন এক দিকে বের হয়ে আসে। ফলে মেরুরজ্জ (স্পাইনাল কর্ড) অথবা স্নায়ুমূল (নার্ভরুট) অথবা উভয়ের উপরই চাপ পড়ে।

১৯৩৪ সাল থেকে প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে পিঠের চামড়া, মাংস ও হাড়ের মাঝখানে দিয়ে কেটে বেরিয়ে আসা বা প্রোল্যান্সড নিউক্লিয়াস প্যালপোস্যাসের অংশটুকু তুলে এনে স্নায়ুরজ্জুর চাপকে প্রশমিত করা হয়। গবেষণা বা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, পারকিউটেনিয়াস লেজার ডিস্ক ডিকস্প্রেশনের (PLDD) মাধ্যমে নির্দিষ্ট মাত্রার ও নির্দিষ্ট ধরনের লেজার রশ্মি প্রয়োগ করে অতি সহজেই নিউক্লিয়াস প্যালপোসাসসের অংশ বিশেষ বাস্পায়িত করার মাধ্যমে এর অতিরিক্ত চাপ কমানো সম্ভব। ফলে স্থানচ্যুত (প্রোল্যাপ্সড) ডিস্ক পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে এবং স্পাইনাল কর্ড ও নার্ভরুটের উপর থেকে চাপ কমে গিয়ে রোগী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এছাড়া লেজারের অপটো-থারমো-মেকানিক্যাল স্টিমুলেশনের মাধ্যমে ছিঁড়ে যাওয়া এ্যানিউলাস ফাইব্রোসাস পুরো ক্ষমতাটাকেই রিপেয়ার বা পূর্বাবস্থানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে হাড়, মাংস ও চামড়া কাঁঁটার যেমন প্রয়োজন হয় না তেমনই অজ্ঞান করারও প্রয়োজন হয় না। ফলে ডায়াবেটিক বা হৃদরোগীদের ক্ষেত্রে লেজার সার্জারি তেমন কোন অন্তরায় হয় না। আর হাড় মাংস না কাটার ফলে লেজার প্রয়োগের স্থানেও দুর্বল হয় না এবং কোন ক্ষতচিহ্ন (স্কার) থাকে না- যে কোন কারণে ভবিষ্যতে এই অংশে স্কারের টানের কোন ব্যথা অনুভূত হয় না।

উন্নত বিশ্বে ডিস্ক প্রোল্যাপ্সের বেশিরভাগ রোগীরই এখন আর কেটে অপারেশন করা হয় না। সারভাইক্যাল/লাম্বার ডিস্ক প্রোল্যাপ্সের বেশিরভাগ রোগীই পারকিউটেনিয়াস লেজার ডিস্ক ডিস্প্রেশনের (PLDD) মাধ্যমে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে, এই চিকিৎসায় যে ধরনের বা যে মাত্রার লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয়ে থাকে তার কোন ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। আমেরিকার ফেডারেল ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (US-FDA) ইতোমধ্যে এই পদ্ধতির চিকিৎসাকে (PLDD) নিরাপদ চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশেও ইতোমধ্যেই সফলভাবে লেজার চিকিৎসার মাধ্যমে ডিস্ক প্রোল্যাপ্স রোগীরা সুস্থতা লাভ করছেন।

ডা. মোহাম্মদ ইযাকুব আলী
পরিচালক, বিএলসিএস ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতাল, আফতাবনগর ঢাকা, মোবাইল ০১৭৫১-৯৩১৫৩০, ০১৬১৮-৪১৮৩৯৩, ই-মেইল: [email protected]

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান:
ট্যাগ :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার মেইলে তথ্য জমা করুন

চামড়া-হাড়-মাংস না কেটে ডিস্কের ঝুঁকিবিহীন অপারেশন

পোস্ট হয়েছে : ০২:২০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২ জানুয়ারী ২০২২

মানুষের মেরুদণ্ডে শক্ত হাড় ছাড়াও দুই হাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে নরম হাড় (ইন্টারভার্টেব্রাল ডিস্ক) থাকে যা গাড়ীর স্প্রিং বা শক এবজরবারের মতো কাজ করে। সাধারণত ভারী জিনিস উঠানো, আঘাত, শরীরে বিশেষ অবস্থায় ঝুঁকি খাওয়াসহ নানাবিধ কারণে ডিস্কের স্থানচ্যুতি (প্রোল্যান্স) হয়ে সংলগ্ন মেরুরজ্জু (স্পাইনাল কর্ড) অথবা স্নায়ুমূল (নার্ভরুট) অথবা উভয়ের উপর চাপ পড়তে পারে। কোমরের (লাম্বার) ডিস্ক প্রল্যাপ্স রোগী তীব্র ব্যথা অনুভব করে। ফলে রোগী বসতে বা দাঁড়াতে পারে না। কোমরে উৎপন্ন ব্যথা কোমর থেকে পা পর্যন্ত স্নায়ুতে (নার্ভ) ছড়িয়ে পড়ে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে মাজা ব্যথার পাশাপাশি এক পাশ বা উভয় পাশের রানে, হাটুঁতে, হাঁটুর নিচে বা পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত যে কোন জায়গায় ব্যথা অনুভব হতে পারে। এ ছাড়াও উপরোক্ত জায়গাগুলোতে ঝিন-ঝিন, শিন-শিন করে, পায়ের বোধশক্তি কমে যায়, পর্য়ায়ক্রমে পা দুবর্ল হয়ে যেতে থাকে এবং এক পর্যায়ে রোগী হাঁটতে, দাঁড়াতে এমনকি বসতে পারে না। আবার ঘাড়ে (সারভাইকাল) উৎপন্ন ব্যথা ঘাড় থেকে হাত পর্যন্ত ¯œায়ুতে ছড়িয়ে থাকে। কাজেই ঘাড়ের ডিস্ক প্রোল্যাপ্সে প্রাথমিক পর্যায়ে ঘাড়ের ব্যথার পাশাপাশি ডান বা বাম হাত বা উভয় হাতে ব্যথা অনুভব হতে পারে। লাম্বার ডিস্ক প্রোল্যাপ্সের মতো এখানেও হাত ঝিন-ঝিন, শিন-শিন করে, হাতে বোধ শক্তি কমে যায়। এক পর্যায়ে হাত দুবর্ল হয়ে যেতে থাকে।

ভার্টেব্রাল ডিস্ক গঠনগতভাবে নিউক্লিয়াস প্যালপোসাস ( কেন্দ্রমধ্যস্থিত জেলির মতো পদার্থ) এবং অ্যানিউলাস ফাইব্রোসাস (চার পার্শ্বস্থ শক্ত ফাইবার বা আঁশ ও ছোট ছোট রক্তনালী) দিয়ে তৈরী। দাঁড়ানো অবস্থায় বা ভারি কিছু বহনকালে কেন্দ্রস্থিত জেলির উপর চাপ পড়ে। কিন্তু শক্ত অ্যানিউলাস ফাইব্রোসাস সেই চাপ নিয়ন্ত্রণ করে ডিস্কের গঠন ঠিক রাখে। কিন্তু বেশি ওজন বহনে বা অনিয়ন্ত্রিত নড়াচড়ায় নিউক্লিয়াস প্যালপোসাসের উপর মাত্রাতিরিক্ত বা অসম চাপ পড়ে গেলে সেই অতিরিক্ত চাপ (Raised Intradiscal Pressure) অ্যানিউলাস ফাইব্রোসাস আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে, নিউক্লিয়াস প্যালপোসাস অ্যানিউলাস ফাইব্রোসাস এবং কখনও কখনও অ্যানিউলাস ফাইব্রোসাস ছিঁড়ে কোন এক দিকে বের হয়ে আসে। ফলে মেরুরজ্জ (স্পাইনাল কর্ড) অথবা স্নায়ুমূল (নার্ভরুট) অথবা উভয়ের উপরই চাপ পড়ে।

১৯৩৪ সাল থেকে প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে পিঠের চামড়া, মাংস ও হাড়ের মাঝখানে দিয়ে কেটে বেরিয়ে আসা বা প্রোল্যান্সড নিউক্লিয়াস প্যালপোস্যাসের অংশটুকু তুলে এনে স্নায়ুরজ্জুর চাপকে প্রশমিত করা হয়। গবেষণা বা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, পারকিউটেনিয়াস লেজার ডিস্ক ডিকস্প্রেশনের (PLDD) মাধ্যমে নির্দিষ্ট মাত্রার ও নির্দিষ্ট ধরনের লেজার রশ্মি প্রয়োগ করে অতি সহজেই নিউক্লিয়াস প্যালপোসাসসের অংশ বিশেষ বাস্পায়িত করার মাধ্যমে এর অতিরিক্ত চাপ কমানো সম্ভব। ফলে স্থানচ্যুত (প্রোল্যাপ্সড) ডিস্ক পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে এবং স্পাইনাল কর্ড ও নার্ভরুটের উপর থেকে চাপ কমে গিয়ে রোগী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এছাড়া লেজারের অপটো-থারমো-মেকানিক্যাল স্টিমুলেশনের মাধ্যমে ছিঁড়ে যাওয়া এ্যানিউলাস ফাইব্রোসাস পুরো ক্ষমতাটাকেই রিপেয়ার বা পূর্বাবস্থানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে হাড়, মাংস ও চামড়া কাঁঁটার যেমন প্রয়োজন হয় না তেমনই অজ্ঞান করারও প্রয়োজন হয় না। ফলে ডায়াবেটিক বা হৃদরোগীদের ক্ষেত্রে লেজার সার্জারি তেমন কোন অন্তরায় হয় না। আর হাড় মাংস না কাটার ফলে লেজার প্রয়োগের স্থানেও দুর্বল হয় না এবং কোন ক্ষতচিহ্ন (স্কার) থাকে না- যে কোন কারণে ভবিষ্যতে এই অংশে স্কারের টানের কোন ব্যথা অনুভূত হয় না।

উন্নত বিশ্বে ডিস্ক প্রোল্যাপ্সের বেশিরভাগ রোগীরই এখন আর কেটে অপারেশন করা হয় না। সারভাইক্যাল/লাম্বার ডিস্ক প্রোল্যাপ্সের বেশিরভাগ রোগীই পারকিউটেনিয়াস লেজার ডিস্ক ডিস্প্রেশনের (PLDD) মাধ্যমে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে, এই চিকিৎসায় যে ধরনের বা যে মাত্রার লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয়ে থাকে তার কোন ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। আমেরিকার ফেডারেল ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (US-FDA) ইতোমধ্যে এই পদ্ধতির চিকিৎসাকে (PLDD) নিরাপদ চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশেও ইতোমধ্যেই সফলভাবে লেজার চিকিৎসার মাধ্যমে ডিস্ক প্রোল্যাপ্স রোগীরা সুস্থতা লাভ করছেন।

ডা. মোহাম্মদ ইযাকুব আলী
পরিচালক, বিএলসিএস ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতাল, আফতাবনগর ঢাকা, মোবাইল ০১৭৫১-৯৩১৫৩০, ০১৬১৮-৪১৮৩৯৩, ই-মেইল: [email protected]

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান: