সম্প্রতি একের পর এক ব্রোকারেজ হাউজে বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে। এতে করে ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির আমানতকারীদের ন্যায় দেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নিজেদের অর্থ ফেরত নিয়ে ভয় বা আতঙ্ক তৈরী হয়েছে। ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানিগুলো যেমন গ্রাহকদের আমানত বিভিন্ন উপায়ে আত্মসাত করছে, একইরকম ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে শেয়ারবাজারে ব্রোকারেজ হাউজগুলোতেও। তবে দেশের অন্যান্য খাতের তুলনায় ব্রোকারেজ হাউজগুলোতে কেলেঙ্কারীর পরিমাণ খুবই কম হওয়ায় সহজেই সমাধানযোগ্য বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, শেয়ারবাজারে আইন-কানুন ব্যত্যয়ের কারনে ৭টি ব্রোকারেজ হাউজের লেনদেন কার্যক্রম স্থগিত করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে বর্তমান কমিশনের সময় এমনটি করা হয়েছে ৩টি প্রতিষ্ঠানের। যেসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকারীরা ৬৬ কোটি ৬ লাখ টাকা পাওনা দাবি করে ডিএসইকে জানিয়েছে। যার মধ্যে মাত্র ৮০ লাখ টাকা বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে ডিএসই কর্তৃপক্ষ।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন সেই আস্থা যদি নিজের অর্থ ফেরত পাওয়ার উপরেই না রাখা যায়, তাহলে বাজারের উন্নয়ন খুবই কঠিন। এমনিতেই এই বাজার সংবেদনশীল হওয়ায় অল্পতেই অনেক কিছু ঘটে যায়। সেখানে নিজের বিনিয়োগ ফেরতের উপর আস্থা রাখতে না পারলে বড় কিছু ঘটতে পারে। তাই ঘটনা ঘটার পরের পরিবর্তে আগেই রেগুলেটরদের সতর্ক হতে হবে। তাদেরকে এ বিষয়ে যত করণীয় প্রয়োজন, তাই করতে হবে।
বিনিয়োগকারীদেরকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্রোকারেজ হাউজের দারস্থ হতে হয়। যেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিনিয়োগ ও তা প্রত্যাহার করতে হয়। এজন্য বিনিয়োগকারীদেরকে ব্রোকারেজ হাউজে টাকা প্রদান করতে হয় এবং তাদের মাধ্যমে সিকিউরিটিজ কেনা হয়। কিন্তু কিছু ব্রোকারেজ হাউজ কর্তৃপক্ষ গ্রাহকদের টাকা ও সিকিউরিটিজ আত্মসাতের জন্ম দিয়েছে। যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরী করেছে।
এমন ঘটনা তৈরী হওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউজের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় ডিএসই। এছাড়া বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইস) বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। এতে করে দায়ী ব্যক্তিদের হয়রানি বা জেল খাটার নজির আছে। কিন্তু যাদের অর্থ আত্মসাত হয়, তারা ফেরত পায় না। এতে করে প্রকৃত অর্থে কোন সুফল আসে না।
দেখা গেছে, বিভিন্ন সময় অনিয়মের কারনে ডিএসই ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ, বানকো সিকিউরিটিজ, তামহা সিকিউরিটিজ, ডন সিকিউরিটিজ, ইনডেক্স সিকিউরিটিজ, অ্যালায়েন্স সিকিউরিটিজ ও সগির সিকিউরিটিজের লেনদেন কার্যক্রম বন্ধ করেছে।
এরমধ্যে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সময়ে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় বন্ধ করা হয়েছে ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ, বানকো সিকিউরিটিজ ও তামহা সিকিউরিটিজের কার্যক্রম। এরমধ্যে ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ ও বানকো সিকিউরিটিজ কর্তৃপক্ষকে কারাগারে পর্যন্ত যেতে হয়েছে। তবে তারা এখন জামিনে মুক্ত। অন্যদিকে তামহা সিকিউরিটিজের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে বিএসইসি। হয়তো এই হাউজটির কর্তৃপক্ষকেও জেলে যেতে হবে এবং একসময় জামিনে বেরিয়ে আসবে। তাতে বিনিয়োগকারীদের কি লাভ হবে- এমন প্রশ্ন থেকেই যায়।
হয়তো অনিয়মের কারনে জরিমানাও করবে বিএসইসি। তাতেই বা কি লাভ হবে ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীদের। ওই জরিমানার ফলে টাকা পাবে বিএসইসি, এতে বিনিয়োগকারীদের কি?
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ি, ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ, বানকো সিকিউরিটিজ ও তামহা সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারীরা হাউজগুলোতে ৬৬ কোটি ৬ লাখ ১৭ হাজার ১০১ টাকা পাওনা দাবি করে ডিএসইকে জানিয়েছেন। এরমধ্যে মাত্র ৮০ লাখ টাকা বুঝিয়ে দিতে পেরেছে ডিএসই।
অথচ শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট সবগুলো রেগুলেটর প্র্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব বা অগ্রাধিকার দেয় বলে সবসময় দাবি করে আসে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে ব্রোকারেজ হাউজগুলো এমন ঘটনার জন্ম দেয় কিভাবে? কোথায় রেগুলেটরদের বুলি আওরানো সুশাসন ও সুপারভিশন?
এ বিষয়ে ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বিজনেস আওয়ারকে বলেন, একজন দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ব্রোকার হিসেবে ব্রোকারেজ হাউজে অর্থ কেলেঙ্কারী আমার জন্য বিব্রতকর। আমি মনে করে বিনিয়োগকারীদের টাকা আমাদের কাছে আমানত। সেই টাকা আত্মসাত খুবই বিব্রতকর এবং খারাপ সংবাদ। তারপরেও যে পরিমাণ অনিয়মের খবর এসেছে, তা রেগুলেটরদের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব। এমনকি যতদুর জানি ব্রোকারেজ হাউজগুলোও সমাধান করতে ইচ্ছুক। তবে এ জাতীয় অনিয়ম প্রতিরোধে বিএসইসি ও ডিএসইকে ঘটনা ঘটার আগেই সর্বোচ্চ তদারকি করতে হবে এবং ঘটে গেলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
তবে ৫ লাখ কোটি টাকার বাজারে ৩টি ব্রোকারেজ হাউজের ৬৬ কোটি টাকার অর্থ কেলেঙ্কারীর ঘটনাকে যেভাবে বিভিন্ন জায়গায় বড় করে দেখানো হচ্ছে, তার সঙ্গে একমত নন ডিএসইর এই সাবেক পরিচালক। তিনি বলেন, ২৫০ ব্রোকার ডিএসইতে ব্যবসা করে আসছে। যেসব প্রতিষ্ঠানে গড়ে প্রতি কার্যদিবস ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন ধরলেও ব্রোকার হাউজগুলোতে গত ১০ বছরে ২০ লাখ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। সে তুলনায় ৬৬ কোটি টাকার অপরাধ কতটা? যেখানে দেশে ব্যাংক-লিজিং কোম্পানির লক্ষ্যাধিক কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে, হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচাঁর করা হয়েছে, জীবন বীমা কোম্পানিগুলোতে একের পর এক অর্থ কেলেঙ্কারীর ঘটনা বের হচ্ছে। এছাড়া আইপিওর মাধ্যমে অসংখ্য অযোগ্য কোম্পানির টাকা নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও যেখানে রয়েছে।
নিম্নে ব্রোকারেজ হাউজ ৩টিতে বিনিয়োগকারীদের দাবিকৃত পাওনা ও সমাধানের পরিমাণ তুলে ধরা হল-
ট্রেক নাম | দাবির সংখ্যা (টাকা ও শেয়ার) | দাবিকৃত অর্থ (টাকা) | সমাধানকৃত অর্থ (টাকা) | শেয়ার স্থানান্তরের মাধ্যমে সমাধানকৃত দাবি |
বানকো সিকিউরিটিজ | ২৭৩৪ | ২৩,৮৪,৯১৮০০ | ২৪৫৪ | |
ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ | ৬২৯০ | ৩৫,৩৮,৭৫৯৬৮ | ৮০,০০০০০ | ৪১৩৭ |
তামহা সিকিউরিটিজ | ২৮২ | ৬,৮২,৪৯৩৩৩ | ১০৭ | |
মোট | ৯৩০৬ জন | ৬৬,০৬,১৭১০১ | ৮০,০০০০০ | ৬৬৯৮ জন |
ওই ৩টি ব্রোকারেজ হাউজে ৯৩০৬ জন অর্থ ও শেয়ারের দাবি জানিয়ে ডিএসইকে অবহিত করেছেন। এরমধ্যে ৬৬৯৮ জনের শেয়ার স্থানান্তরের মাধ্যমে সমাধান করেছেন। কিন্তু টাকার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। যেসব শেয়ার বিওতে ছিল, সেগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু যার শেয়ার বিক্রি করে ও নগদ অর্থ আত্মসাত করেছে, সেগুলো ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে বিনিয়োগকারীরা।
বিজনেস আওয়ার/২৩ জানুয়ারি, ২০২২/আরএ
3 thoughts on “ব্রোকারেজ হাউজ কেলেঙ্কারী : অর্থ আত্মসাত ৬৬.০৬ কোটি টাকা, ফেরত ৮০ লাখ”