হঠাৎ করে গত বছরের মার্চের পরে অস্বাভাবিক দর বাড়তে শুরু করে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ন্যাশনাল ফিড মিলের শেয়ার দর। কয়েকদিনের ব্যবধানে শেয়ারটি কয়েকগুণ হয়ে যায়। এরপরেই প্রকাশ করা হয় ৩য় প্রান্তিকের ব্যবসায় হাজার শতাংশের উপরে ব্যবসায় উন্নতির খবর। কিন্তু সে উন্নতি পরের প্রান্তিকেই হারিয়ে যায়। মাঝে তিন মাসের শেয়ারটি নিয়ে হয়ে যায় গেম্বলিং। যেখানে কোম্পানির সরাসরি সম্পৃক্ততাসহ শেয়ারবাজারের একজন আলোচিত-সমালোচিত গেম্বলারের নাম চাউর হয়।
২০২১ সালের ৩১ মার্চ ন্যাশনাল ফিড মিলের শেয়ার দর ছিল ১৬.৬০ টাকা। এরপরে কোম্পানিটির ৩য় প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ ২১) ব্যবসায় বড় উত্থানের খবর প্রকাশ করা হয় ২৭ মে। কিন্তু তার আগে থেকেই (১১ এপ্রিল) শেয়ারটি টানা বাড়তে থাকে। যা বেড়ে ২০ জুন হয়ে যায় ৪১.৯০ টাকা।
ওইসময় কোম্পানিটির ৩য় প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) দেখানো হয় ০.৭০ টাকা। যাতে ৯ মাসে (জুলাই ২০-মার্চ ২১) ইপিএস দাড়াঁয় ১.২৫ টাকায়। যার পরিমাণ আগের অর্থবছরের ৩য় প্রান্তিকের ০.০৬ টাকা লোকসানের মাধ্যমে ৯ মাসে হয়েছিল ০.১৬ টাকা। অর্থাৎ ৩য় প্রান্তিকে কোম্পানিটির ব্যবসায় ১২৬৬ শতাংশ এবং ৯ মাসের ব্যবসায় ৬৮১ শতাংশ উত্থান দেখানো হয়।
এই উত্থান দেখানোর আগেই ১১ এপ্রিলের ১৪.৬০ টাকার শেয়ারটি ২৭ মে বেড়ে হয়ে যায় ৩২.৭০ টাকা। অর্থাৎ এই সময়টিতে কোম্পানির ব্যবসায়িক উন্নতির তথ্য কারও জানার কথা না থাকলেও দর বাড়ে। তাহলে এই দর কি অনুমান নির্ভরতার কারনে বেড়েছে? আমাদের দেশের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা ন্যাশনাল ফিডের মতো কোম্পানির ব্যবসায় অস্বাভাবিক উন্নতির খবর আগেই অনুধাবন করার সক্ষমতা কতটুকু, সেটা আগে চিন্তার বিষয় আছে। তবে এ জাতীয় উন্নতির খবর কোম্পানি কর্তৃপক্ষ নিজেদের শেয়ার ব্যবসার স্বার্থে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের আগেই গেম্বলারদের মাধ্যমে বাজারে যে ছড়িয়ে দেয়, তা এখন সবাই অনুধাবন করে।
নয় মাসের ব্যবসায় এমন উত্থানের ন্যাশনাল ফিডের পুরো অর্থবছরে (জুলাই ২০-জুন ২১) তলানিতে নেমে আসে। কোম্পানিটির ৯ মাসে যেখানে ইপিএস ১.২৫ টাকা হয়েছিল, সেই কোম্পানির ১২ মাসে কমে দাড়াঁয় ০.১৮ টাকায়। এতে করে শেয়ার দর আবারও জায়গায় চলে এসেছে।
তবে চলতি অর্থবছরের ৬ মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর ২১) ব্যবসায় কোম্পানিটি ব্যবসায় আরেক ধাপ নিচে নেমেছে। ওইসময় কোম্পানিটির নিট লোকসান হয়েছে ১০ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ০.০১ টাকা। অথচ কোম্পানিটির আগের অর্থবছরের একই সময়ে নিট মুনাফা হয়েছিল ৫ কোটি ৫ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ০.৫৫ টাকা।
ব্যবসায় এমন অস্বাভাবিক উত্থান-পতনের সঙ্গে শেয়ার দরেও একই আচরন দেখা গেছে। যাতে গত বছরের ২০ জুনের ৪১.৯০ টাকার শেয়ারটি এখন ১৮.৮০ টাকায় নেমে এসেছে।
করোনায় দেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ২০২০ সালে। ওই বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনা সনাক্ত হওয়ার পরে ২৬ মার্চ দেশের সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। এরমধ্যে দিয়েই ওই বছরের প্রথমার্ধের ব্যবসায় বড় উত্থান দেখায় ন্যাশনাল ফিড।
আরও পড়ুন….
গেম্বলিং করতে উৎপাদন ব্যয় কম দেখিয়েছে ইয়াকিন পলিমার
কোম্পানিটির ২০২০ সালের শেষার্ধে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ কোটি ৫১ লাখ টাকার বা ৪৬ শতাংশ বেড়ে ৫৮ কোটি ৭২ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়। যার উপর নির্ভর করে কোম্পানিটির নিট মুনাফা হয় ৫ কোটি ৫ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ০.৫৯ টাকা।
কিন্তু দেশে করোনার পরিস্থিতি যখন উন্নতি হয়েছে, তখন ন্যাশনাল ফিডের ব্যবসায় পতন শুরু হয়েছে। যা বাস্তবতার বিপরীত দিকে চলা। ফলে আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধের ৫৮ কোটি ৭২ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর ২১) নেমে এসেছে ৩০ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে বিক্রি কমেছে ২৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকার বা ৪৯ শতাংশ। এতে করে নিট মুনাফার পরিবর্তে লোকসানে নেমেছে।
এই উত্থান-পতনের বিষয়ে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ডিএসইকে জানিয়েছেন, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে বিক্রি ও দর বৃদ্ধির কারনে মুনাফা বেড়েছিল। আর চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে পতনের কারন হিসাবে বিক্রি কমে আসা এবং কাঁচামালের দর বৃদ্ধিকে উল্লেখ করেছে। এছাড়া কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের নগদে পণ্য বিক্রি জোরদার ও বাকিতে বিক্রির ক্ষেত্রে শক্তভাবে মনিটরিংকেও উল্লেখ করেছেন।
তারপরেও ৯২ কোটি ৪৪ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটিতে বাকিতে বিক্রির কারনে দেনাদারের পরিমাণ বেড়েছে। গত বছরের ৩০ জুন বাকিতে বিক্রির কারনে বিভিন্ন গ্রাহকের কাছে পাওনা টাকার পরিমাণ ছিল ৭৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। যা গত ৩১ ডিসেম্বর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ কোটি ১০ লাখ টাকায়।
এই অস্বাভাবিক বাকিতে বিক্রি ন্যাশনাল ফিডকে দূর্বল করে তুলছে। এরইমধ্যে বিভিন্ন গ্রাহকের কাছে পাওনা টাকা আদায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে গত অর্থবছরে (২০২০-২১) পাওয়া যাবে না, এমন শঙ্কায় ৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ওই টাকা আদায় হবে না বিবেচনায় হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং লোকসান হিসাবে দেখানো হয়েছে।
এই ঝুঁকিপূর্ণ বাকিতে বিক্রির বিষয়ে ন্যাশনাল ফিড মিলের ২০১৯-২০ অর্থবছরের আর্থিক হিসাব নিরীক্ষায় নিরীক্ষক শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। ওই সময় নিরীক্ষক জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের ৩০ জুন বিভিন্ন গ্রাহকের কাছে বাকিতে বিক্রির কারনে পাওনা টাকা ছিল ৭২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। যা ২০২০ সালের ৩০ জুন বেড়ে হয় ৭৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এভাবে নিয়মিত গ্রাহকের কাছে পাওনা টাকার পরিমাণ বাড়লেও বছরভিত্তিক গ্রাহকদের কাছ থেকে সন্তোষজনক আদায় হচ্ছে না। এছাড়া আদায়ে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কোম্পানি কর্তৃপক্ষ কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
এমন ঝুঁকিপূর্ণ বাকিতে বিক্রিসহ নানা জটিলতায় ভুগছে ন্যাশনাল ফিড। এরমধ্যে আবার কোম্পানিটি থেকে উদ্যোক্তা/পরিচালকদের ব্যক্তিগত কোম্পানিতে টাকা সরানো হয়েছে। এরমধ্যে কর্ণপুর অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজে ৩৬ লাখ ও ন্যাশনাল হ্যাচারিতে ৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বিনাসুদে দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ন্যাশনাল ফিড মিল ২০১৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এ কোম্পানিটি শেয়ারবাজার থেকে ১৮ কোটি টাকা সংগ্রহের পরে ২ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) ১ টাকার উপরে থাকে। এরপরে শুরু হয় পতন। যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ০.৫৬ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ০.১৫ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ০.১৭ টাকা ও সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ০.১৮ টাকা ইপিএস হয়েছে।
বিজনেস আওয়ার/১৪ মার্চ, ২০২২/আরএ
One thought on “গেম্বলিং শেষে ধারাবাহিক পতনে মুনাফা”