ঢাকা , সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লোকসান দেখাতে অস্বাভাবিক উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি : অন্যদের কমেছে

একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যয়ের হার কমে আসা ও নিট মুনাফা বৃদ্ধি স্বাভাবিক হলেও ব্যতিক্রম ঘটেছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আরগন ডেনিমসের ক্ষেত্রে। এ কোম্পানিটির আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধের তুলনায় পণ্য বিক্রি ৪৯ শতাংশ বৃদ্ধি সত্ত্বেও নিট মুনাফা বাড়েনি। বরং কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে বলে সন্দেহজনক আর্থিক হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে। যার পেছনে আগের অর্থবছরের ৮৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯৬ শতাংশের মতো অস্বাভাবিক উৎপাদন ব্যয় দেখানো প্রধান কারন হিসেবে রয়েছে। তবে একই ধরনের পণ্যের ব্যবসায়ি এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অন্য কোম্পানিগুলোর বিক্রি বৃদ্ধির কারনে উৎপাদন ব্যয় বাড়েনি। বরং কমেছে।

২০১৩ সালে অনেক ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখিয়ে শেয়ারবাজারে আসে আরগন ডেনিমস। সাড়ে ৫টাকার ইপিএস দেখিয়ে শেয়ারবাজার থেকে ২৫ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৩৫ টাকায় প্রতিটি শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ১০৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। যে কোম্পানির ব্যবসায় ধারাবাহিক পতনে শেয়ার দর এখন ইস্যু মূল্যের প্রায় অর্ধেকে বা ১৮.৬০ টাকায় অবস্থান করছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, বিক্রি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যয়ের হার কমে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু সেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ের ৮৩ শতাংশ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে ৯৬ শতাংশ হওয়া অস্বাভাবিক। এটা আরও বেশি সন্দেহজনক, যখন প্রতিযোগী কোম্পানির উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি না পাওয়া। তাই এ জাতীয় কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা যাচাইয়ে এবং বিনিয়োগকারীদেরকে ন্যায্য অধিকার বুঝিয়ে দিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিশেষ নিরীক্ষা করা দরকার। অন্যথায় এভাবে বছরের পর বছর কোম্পানিগুলো সাধারন বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করে যাবে।

দেখা গেছে, আরগন ডেনিমসের আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে ১৩৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছিল। যা উৎপাদনে ৮২.৫৬ শতাংশ হারে ১১০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছিল। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে এই ব্যয়ের হার ৯৬.৩৯ শতাংশ দেখিয়েছে আরগন ডেনিমস কর্তৃপক্ষ। কোম্পানিটির ১৯৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকার বিক্রির বিপরীতে ১৯২ কোটি ৪৭ লাখ টাকার উৎপাদন ব্যয় দেখিয়েছে।

কোম্পানিটির এই অস্বাভাবিক উৎপাদন ব্যয় বেশি দেখানোর কারনে বিক্রি ৪৯ শতাংশ বৃদ্ধি সত্ত্বেও লোকসান হয়েছে। আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটির ১৩৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করে ৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকার নিট মুনাফা বা শেয়ারপ্রতি ০.৬৪ টাকা মুনাফা হয়েছিল। কিন্তু সেই কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৬৫ কোটি ২৪ লাখ টাকার বা ৪৯ শতাংশ বিক্রি বেড়ে ১৯৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকার হওয়া সত্ত্বেও লোকসান হয়েছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকার বা শেয়ারপ্রতি ০.৪৮ টাকা।

অথচ একই সময়ে প্রতিযোগী অন্য কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। বিক্রি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যয়ের হার কমেছে। এমনকি বিক্রি কমে আসা কোম্পানিরও উৎপাদন ব্যয়ের হার বাড়েনি।

এ বিষয়ে দ্য ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট অব বাংলাদেশের (আইসিএমএবি) সাবেক সভাপতি আবু সাঈদ মোঃ শায়খুল ইসলাম বিজনেস আওয়ারকে বলেন, বিক্রি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যয়ের হার কমে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার জন্য তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে পর্ষদের নিজেদের মতো করে আর্থিক হিসাব তৈরী করার অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। তেমনটি না হলে, একটি কোম্পানির ৪৯ শতাংশ বিক্রি বৃদ্ধি সত্ত্বেও ৮৩ শতাংশের উৎপাদন ব্যয় ৯৬-এ উন্নিত হওয়ার কথা না। যেখানে একই ধরনের ব্যবসায়ীদের উৎপাদন ব্যয় না বাড়া আরও সন্দেহ তৈরী করেছে।

আরও পড়ুন……
গেম্বলিং শেষে ধারাবাহিক পতনে ন্যাশনাল ফিডের মুনাফা

আরগন ডেনিমসের প্রতিযোগী ও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ডেনিমস খাতের বড় ব্যবসায়ী শাশা ডেনিমস। এ কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৫৬৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকার পণ্য বিক্রির পেছনে ৮৮.৬০ শতাংশ হারে ৫০২ কোটি ১৪ লাখ টাকার উৎপাদন ব্যয় হয়েছে। যার পরিমাণ আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৪৬৭ কোটি ৯ লাখ টাকার বিক্রির বিপরীতে ৮৯.৪৫ শতাংশ হারে ৪১৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা হয়েছিল। অর্থাৎ কোম্পানিটির ৬৪ কোটি ৬২ লাখ টাকার বা ১২.৮৭ শতাংশ বিক্রি বৃদ্ধির সঙ্গে কিছুটা উৎপাদন ব্যয় কমেছে।

এদিকে আরেক প্রতিযোগী কোম্পানি প্যাসিফিক ডেনিমসের আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৯৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রির পেছনে ৮৫.১৭ শতাংশ হারে ৮১ কোটি ৫১ লাখ টাকার উৎপাদন ব্যয় হয়েছিল। যা চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেও একই হারে হয়েছে। এ বছর ৮১ কোটি ৬১ লাখ টাকার বিক্রির পেছনে ৮৫.৪৪% হারে ৬৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকার উৎপাদন ব্যয় হয়েছে।

উৎপাদন ব্যয়ের বিষয়ে প্যাসিফিক ডেনিমসের সচিব মো. সোরহাব আলী বিজনেস আওয়ারকে বলেন, কোন ডেনিমস কোম্পানির উৎপাদন ব্যয়ের হার ৮৩ থেকে বেড়ে ৯৬ শতাংশ হওয়া স্বাভাবিক না। আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একইসময়ে এতো উৎপাদন ব্যয়ের হার বৃদ্ধি পাওয়ার মতো কোন কারন দেখছি না। এই খাতে উৎপাদন ব্যয় ৮০-৯০ শতাংশ হতে পারে।

এ বিষয়ে আরগন ডেনিমসের সচিব মো. মনিরুজ্জামান ভূইয়া বিজনেস আওয়ারকে বলেন, কাচাঁমালের দাম বৃদ্ধির কারনে উৎপাদন ব্যয়ের হার বেড়েছে। আমরা বিক্রির জন্য ৬ মাস আগে অর্ডার নিলেও পণ্য তৈরীর সময় কাচাঁমালের দাম বেড়ে যায়। কিন্তু পণ্যের বিক্রি দর আগেই নির্ধারিত হওয়ায় সেটা আর বাড়াতে পারিনি। কিন্তু অন্য ডেনিমস কোম্পানির উৎপাদন ব্যয়ের হার বাড়েনি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ওইসব কোম্পানিতে হয়তো দাম বাড়ার আগেই কাচাঁমাল কিনে স্টক করে রাখা হয়েছিল।

তবে শাশা ডেনিমস ও প্যাসিফিক ডেনিমসের আর্থিক হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে কাচাঁমাল ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। তারা শুধু পূর্বে স্টকে থাকা কাচাঁমাল দিয়ে পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করেছে এমনটি নয়। ওই দুই কোম্পানির মধ্যে শাশা ডেনিমসের বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধের তুলনায় কাচাঁমাল ক্রয়ের জন্য বেশি টাকা প্রদান করতে হয়েছে। আর বিক্রি কমে আসা প্যাসফিক ডেনিমসকেও কাচাঁমাল ক্রয়ের পেছনে অর্থ প্রদান করতে হয়েছে।

দেখা গেছে, শাশা ডেনিমসের আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে কাচাঁমাল ক্রয়সহ অন্যান্য ব্যয়ের পেছনে ৩৪৯ কোটি ৩ লাখ টাকা প্রদান করতে হয়েছিল। যা এ অর্থবছরের প্রথমার্ধে বেড়ে ৪৪৭ কোটি ৩২ লাখ দিয়েছে।

অন্যদিকে আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে কাচাঁমাল ক্রয়সহ অন্যান্য ব্যয়ের বিপরীতে প্যাসিফিক ডেনিমস প্রদান করে ৮৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। আর এ বছরের প্রথমার্ধে প্রদান করেছে ৭২ কোটি ৮ লাখ টাকা।

সোরহাব আলী বলেন, কাচাঁমালের দাম বেড়েছে, এটা সঠিক। কিন্তু সেটা বিক্রিত পণ্য উৎপাদনে ব্যয়ের হার ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত হওয়ার মতো না। এ বৃদ্ধির হার ২-৩ শতাংশ বেড়েছে। ফলে উৎপাদন ব্যয়ও ২-৩ শতাংশ বাড়া স্বাভাবিক।

এমন অস্বাভাবিক আর্থিক হিসাবের বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহি পরিচালক ও মূখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিজনেস আওয়ারকে বলেন, আন্তর্জাতিক হিসাব মান (আইএএস) মেনে কোম্পানিগুলোর আর্থিক হিসাব জমা ও বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কেউ যদি হিসাব মান লঙ্ঘন করে কৃত্রিম আর্থিক হিসাব প্রকাশ করে থাকে, তাহলে কমিশন সে বিষয় খতিয়ে দেখবে।

এদিকে মুনাফা বাড়ানোর লক্ষ্যে শেয়ারবাজার থেকে ১০৫ কোটি টাকা সংগ্রহের পর থেকেই নিম্নমূখী আর্থিক হিসাব দেখিয়ে আসছে আরগন ডেনিমস। যাতে টানা কোম্পানিটির মুনাফা কমছে। একে করে আইপিও পূর্ব ২০১১ সালের ৫.৪৬ টাকার শেয়ারপ্রতি মুনাফা সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ০.৭১ টাকায় নেমে এসেছে।

ডিএসইর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সর্বশেষ ৪ অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ি, কোম্পানিটির ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নিট মুনাফা ৩৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা বা ইপিএস ৩.১৮ টাকা হয়েছিল। এরপরে নিয়মিত কমেছে। যাতে করে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিট মুনাফা ৩৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বা ইপিএস ৩.০৬ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে নিট মুনাফা ১৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা বা ইপিএস ১.৫৩ টাকা ও সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা বা ইপিএস ০.৭১ টাকা হয়। তবে চলতি অর্থবছরে কম হলেও মুনাফা ধরে রাখতে পারেনি। কোম্পানিটি লোকসানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

অথচ ২০১৩ সালে আরগন ডেনিমসের মুনাফা বাড়ানোর জন্য শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করা হয়। এজন্য সাধারন বিনিয়োগকারীদের কাছে ২৫ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৩৫ টাকা করে প্রতিটি শেয়ার ইস্যুর সংগ্রহ করা হয় ১০৫ কোটি টাকা। যা ঋণ পরিশোধ, প্রকল্প বর্ধিতকরন ও আইপিও ব্যয় পরিচালনার জন্য উত্তোলন করা হয়। এ কাজে কোম্পানিটিকে সহযোগিতার জন্য ইস্যু ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করে লংকাবাংলা ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড।

বিজনেস আওয়ার/২০ মার্চ, ২০২২/আরএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান:
ট্যাগ :

One thought on “লোকসান দেখাতে অস্বাভাবিক উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি : অন্যদের কমেছে

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার মেইলে তথ্য জমা করুন

লোকসান দেখাতে অস্বাভাবিক উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি : অন্যদের কমেছে

পোস্ট হয়েছে : ০১:৫৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ মার্চ ২০২২

একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যয়ের হার কমে আসা ও নিট মুনাফা বৃদ্ধি স্বাভাবিক হলেও ব্যতিক্রম ঘটেছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আরগন ডেনিমসের ক্ষেত্রে। এ কোম্পানিটির আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধের তুলনায় পণ্য বিক্রি ৪৯ শতাংশ বৃদ্ধি সত্ত্বেও নিট মুনাফা বাড়েনি। বরং কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে বলে সন্দেহজনক আর্থিক হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে। যার পেছনে আগের অর্থবছরের ৮৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯৬ শতাংশের মতো অস্বাভাবিক উৎপাদন ব্যয় দেখানো প্রধান কারন হিসেবে রয়েছে। তবে একই ধরনের পণ্যের ব্যবসায়ি এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অন্য কোম্পানিগুলোর বিক্রি বৃদ্ধির কারনে উৎপাদন ব্যয় বাড়েনি। বরং কমেছে।

২০১৩ সালে অনেক ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখিয়ে শেয়ারবাজারে আসে আরগন ডেনিমস। সাড়ে ৫টাকার ইপিএস দেখিয়ে শেয়ারবাজার থেকে ২৫ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৩৫ টাকায় প্রতিটি শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ১০৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। যে কোম্পানির ব্যবসায় ধারাবাহিক পতনে শেয়ার দর এখন ইস্যু মূল্যের প্রায় অর্ধেকে বা ১৮.৬০ টাকায় অবস্থান করছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, বিক্রি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যয়ের হার কমে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু সেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ের ৮৩ শতাংশ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে ৯৬ শতাংশ হওয়া অস্বাভাবিক। এটা আরও বেশি সন্দেহজনক, যখন প্রতিযোগী কোম্পানির উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি না পাওয়া। তাই এ জাতীয় কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা যাচাইয়ে এবং বিনিয়োগকারীদেরকে ন্যায্য অধিকার বুঝিয়ে দিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিশেষ নিরীক্ষা করা দরকার। অন্যথায় এভাবে বছরের পর বছর কোম্পানিগুলো সাধারন বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করে যাবে।

দেখা গেছে, আরগন ডেনিমসের আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে ১৩৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছিল। যা উৎপাদনে ৮২.৫৬ শতাংশ হারে ১১০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছিল। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে এই ব্যয়ের হার ৯৬.৩৯ শতাংশ দেখিয়েছে আরগন ডেনিমস কর্তৃপক্ষ। কোম্পানিটির ১৯৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকার বিক্রির বিপরীতে ১৯২ কোটি ৪৭ লাখ টাকার উৎপাদন ব্যয় দেখিয়েছে।

কোম্পানিটির এই অস্বাভাবিক উৎপাদন ব্যয় বেশি দেখানোর কারনে বিক্রি ৪৯ শতাংশ বৃদ্ধি সত্ত্বেও লোকসান হয়েছে। আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটির ১৩৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করে ৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকার নিট মুনাফা বা শেয়ারপ্রতি ০.৬৪ টাকা মুনাফা হয়েছিল। কিন্তু সেই কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৬৫ কোটি ২৪ লাখ টাকার বা ৪৯ শতাংশ বিক্রি বেড়ে ১৯৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকার হওয়া সত্ত্বেও লোকসান হয়েছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকার বা শেয়ারপ্রতি ০.৪৮ টাকা।

অথচ একই সময়ে প্রতিযোগী অন্য কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। বিক্রি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যয়ের হার কমেছে। এমনকি বিক্রি কমে আসা কোম্পানিরও উৎপাদন ব্যয়ের হার বাড়েনি।

এ বিষয়ে দ্য ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট অব বাংলাদেশের (আইসিএমএবি) সাবেক সভাপতি আবু সাঈদ মোঃ শায়খুল ইসলাম বিজনেস আওয়ারকে বলেন, বিক্রি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যয়ের হার কমে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার জন্য তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে পর্ষদের নিজেদের মতো করে আর্থিক হিসাব তৈরী করার অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। তেমনটি না হলে, একটি কোম্পানির ৪৯ শতাংশ বিক্রি বৃদ্ধি সত্ত্বেও ৮৩ শতাংশের উৎপাদন ব্যয় ৯৬-এ উন্নিত হওয়ার কথা না। যেখানে একই ধরনের ব্যবসায়ীদের উৎপাদন ব্যয় না বাড়া আরও সন্দেহ তৈরী করেছে।

আরও পড়ুন……
গেম্বলিং শেষে ধারাবাহিক পতনে ন্যাশনাল ফিডের মুনাফা

আরগন ডেনিমসের প্রতিযোগী ও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ডেনিমস খাতের বড় ব্যবসায়ী শাশা ডেনিমস। এ কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৫৬৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকার পণ্য বিক্রির পেছনে ৮৮.৬০ শতাংশ হারে ৫০২ কোটি ১৪ লাখ টাকার উৎপাদন ব্যয় হয়েছে। যার পরিমাণ আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৪৬৭ কোটি ৯ লাখ টাকার বিক্রির বিপরীতে ৮৯.৪৫ শতাংশ হারে ৪১৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা হয়েছিল। অর্থাৎ কোম্পানিটির ৬৪ কোটি ৬২ লাখ টাকার বা ১২.৮৭ শতাংশ বিক্রি বৃদ্ধির সঙ্গে কিছুটা উৎপাদন ব্যয় কমেছে।

এদিকে আরেক প্রতিযোগী কোম্পানি প্যাসিফিক ডেনিমসের আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৯৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রির পেছনে ৮৫.১৭ শতাংশ হারে ৮১ কোটি ৫১ লাখ টাকার উৎপাদন ব্যয় হয়েছিল। যা চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেও একই হারে হয়েছে। এ বছর ৮১ কোটি ৬১ লাখ টাকার বিক্রির পেছনে ৮৫.৪৪% হারে ৬৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকার উৎপাদন ব্যয় হয়েছে।

উৎপাদন ব্যয়ের বিষয়ে প্যাসিফিক ডেনিমসের সচিব মো. সোরহাব আলী বিজনেস আওয়ারকে বলেন, কোন ডেনিমস কোম্পানির উৎপাদন ব্যয়ের হার ৮৩ থেকে বেড়ে ৯৬ শতাংশ হওয়া স্বাভাবিক না। আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একইসময়ে এতো উৎপাদন ব্যয়ের হার বৃদ্ধি পাওয়ার মতো কোন কারন দেখছি না। এই খাতে উৎপাদন ব্যয় ৮০-৯০ শতাংশ হতে পারে।

এ বিষয়ে আরগন ডেনিমসের সচিব মো. মনিরুজ্জামান ভূইয়া বিজনেস আওয়ারকে বলেন, কাচাঁমালের দাম বৃদ্ধির কারনে উৎপাদন ব্যয়ের হার বেড়েছে। আমরা বিক্রির জন্য ৬ মাস আগে অর্ডার নিলেও পণ্য তৈরীর সময় কাচাঁমালের দাম বেড়ে যায়। কিন্তু পণ্যের বিক্রি দর আগেই নির্ধারিত হওয়ায় সেটা আর বাড়াতে পারিনি। কিন্তু অন্য ডেনিমস কোম্পানির উৎপাদন ব্যয়ের হার বাড়েনি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ওইসব কোম্পানিতে হয়তো দাম বাড়ার আগেই কাচাঁমাল কিনে স্টক করে রাখা হয়েছিল।

তবে শাশা ডেনিমস ও প্যাসিফিক ডেনিমসের আর্থিক হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে কাচাঁমাল ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। তারা শুধু পূর্বে স্টকে থাকা কাচাঁমাল দিয়ে পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করেছে এমনটি নয়। ওই দুই কোম্পানির মধ্যে শাশা ডেনিমসের বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধের তুলনায় কাচাঁমাল ক্রয়ের জন্য বেশি টাকা প্রদান করতে হয়েছে। আর বিক্রি কমে আসা প্যাসফিক ডেনিমসকেও কাচাঁমাল ক্রয়ের পেছনে অর্থ প্রদান করতে হয়েছে।

দেখা গেছে, শাশা ডেনিমসের আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে কাচাঁমাল ক্রয়সহ অন্যান্য ব্যয়ের পেছনে ৩৪৯ কোটি ৩ লাখ টাকা প্রদান করতে হয়েছিল। যা এ অর্থবছরের প্রথমার্ধে বেড়ে ৪৪৭ কোটি ৩২ লাখ দিয়েছে।

অন্যদিকে আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে কাচাঁমাল ক্রয়সহ অন্যান্য ব্যয়ের বিপরীতে প্যাসিফিক ডেনিমস প্রদান করে ৮৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। আর এ বছরের প্রথমার্ধে প্রদান করেছে ৭২ কোটি ৮ লাখ টাকা।

সোরহাব আলী বলেন, কাচাঁমালের দাম বেড়েছে, এটা সঠিক। কিন্তু সেটা বিক্রিত পণ্য উৎপাদনে ব্যয়ের হার ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত হওয়ার মতো না। এ বৃদ্ধির হার ২-৩ শতাংশ বেড়েছে। ফলে উৎপাদন ব্যয়ও ২-৩ শতাংশ বাড়া স্বাভাবিক।

এমন অস্বাভাবিক আর্থিক হিসাবের বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহি পরিচালক ও মূখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিজনেস আওয়ারকে বলেন, আন্তর্জাতিক হিসাব মান (আইএএস) মেনে কোম্পানিগুলোর আর্থিক হিসাব জমা ও বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কেউ যদি হিসাব মান লঙ্ঘন করে কৃত্রিম আর্থিক হিসাব প্রকাশ করে থাকে, তাহলে কমিশন সে বিষয় খতিয়ে দেখবে।

এদিকে মুনাফা বাড়ানোর লক্ষ্যে শেয়ারবাজার থেকে ১০৫ কোটি টাকা সংগ্রহের পর থেকেই নিম্নমূখী আর্থিক হিসাব দেখিয়ে আসছে আরগন ডেনিমস। যাতে টানা কোম্পানিটির মুনাফা কমছে। একে করে আইপিও পূর্ব ২০১১ সালের ৫.৪৬ টাকার শেয়ারপ্রতি মুনাফা সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ০.৭১ টাকায় নেমে এসেছে।

ডিএসইর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সর্বশেষ ৪ অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ি, কোম্পানিটির ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নিট মুনাফা ৩৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা বা ইপিএস ৩.১৮ টাকা হয়েছিল। এরপরে নিয়মিত কমেছে। যাতে করে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিট মুনাফা ৩৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বা ইপিএস ৩.০৬ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে নিট মুনাফা ১৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা বা ইপিএস ১.৫৩ টাকা ও সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা বা ইপিএস ০.৭১ টাকা হয়। তবে চলতি অর্থবছরে কম হলেও মুনাফা ধরে রাখতে পারেনি। কোম্পানিটি লোকসানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

অথচ ২০১৩ সালে আরগন ডেনিমসের মুনাফা বাড়ানোর জন্য শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করা হয়। এজন্য সাধারন বিনিয়োগকারীদের কাছে ২৫ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৩৫ টাকা করে প্রতিটি শেয়ার ইস্যুর সংগ্রহ করা হয় ১০৫ কোটি টাকা। যা ঋণ পরিশোধ, প্রকল্প বর্ধিতকরন ও আইপিও ব্যয় পরিচালনার জন্য উত্তোলন করা হয়। এ কাজে কোম্পানিটিকে সহযোগিতার জন্য ইস্যু ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করে লংকাবাংলা ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড।

বিজনেস আওয়ার/২০ মার্চ, ২০২২/আরএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান: