শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৯ কোম্পানিতে ৪৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ব্র্যাক ব্যাংক। যার সবকয়টি মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি হিসেবে বিবেচিত। যেসব শেয়ার রাতারাতি বাড়ে না এবং কমেও না। যে কারনে ওইসব শেয়ারে সবাই বিনিয়োগে আগ্রহী না। তবে ব্র্যাক ব্যাংকের ওইসব শেয়ারে গত ৩১ ডিসেম্বর আনরিয়েলাইজড (অবিক্রিত) গেইন দাঁড়িয়েছে ২৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, আমাদের শেয়ারবাজারে অধিকাংশ বিনিয়োগকারী রাতারাতি মুনাফা করতে চায়। যে কারনে তারা আইটেমের পেছনে ছুটে। এটা করতে গিয়ে অধিকাংশ বিনিয়োগকারী লোকসান গুনে। কিন্তু মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানিতে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করে লোকসানের সম্ভাবনা খুবই কম। এতে মুনাফা করা সহজ।
ব্র্যাক ব্যাংকের পাশাপাশি সাবসিডিয়ারি কোম্পানিগুলো থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। যার পরিমাণ ১৪২ কোটি ৩৯ লাখ টাকার। এরমধ্যে মার্চেন্ট ব্যাংক ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট থেকে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে ৯৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ও ব্র্যাক ইপিএল ব্রোকারেজ হাউজ থেকে ৩৩ কোটি ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।
এদিকে ব্র্যাক থেকে বেক্সিমকোর সুকুক বন্ড ও আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির বন্ডেও বিনিয়োগ করা হয়েছে। এরমধ্যে আশুগঞ্জ পাওয়ারের বন্ডে ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ৫০ কোটি টাকা ও ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট থেকে বেক্সিমকো সুকুকে ১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। আর প্লেসমেন্ট শেয়ারে (আইপিও পূর্ব) মার্চেন্ট ব্যাংকটি ও ব্র্যাক ইপিএল ব্রোকারেজ হাউজটি থেকে ২ কোটি ২১ লাখ টাকা করে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
ব্যাংকটি থেকে সাবসিডিয়ারিসহ ২০২১ সালেই শেয়ারবাজারে ৮৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। যার পরিমাণ আগের বছরে ছিল ৩৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
ব্র্যাক ব্যাংক থেকে বাটা সু, বার্জার পেইন্টস, ইস্টার্ন ব্যাংক, গ্রামীণফোন, লিন্ডে বিডি, ম্যারিকো, রেনাটা, সিঙ্গার বাংলাদেশ ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসে ৪৩৪ কোটি ৮৬ লাখ ৯৭ হাজার টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসে। এ কোম্পানিটিতে ব্র্যাক ব্যাংকের বিনিয়োগ ১০৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
এরপরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে গ্রামীণফোনে। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ ৭৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে ম্যারিকো বাংলাদেশে। এছাড়া ৫০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে বার্জার পেইন্টস ও সিঙ্গার বাংলাদেশে।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বিজনেস আওয়ারকে বলেন, ব্যাংকটির পোর্টফোলিও দেখেই বোঝা যাচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করে বিনিয়োগ করা হয়েছে। যেসব কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীসহ সব স্টেকহোল্ডারদের আস্থা অনেক বেশি। এছাড়া শেয়ারবাজারে আর্থিক হিসাবের অস্বচ্ছতার যে প্রধানতম একটি সমস্যা, তা ওই কোম্পানিগুলোতে নেই। তাই ওইসব কোম্পানিতে লোকসান করার সম্ভাবনা খুবই কম।
তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে হাতেগোণা কয়েকটি কোম্পানির আর্থিক হিসাবের উপর আস্থা রাখা যায়। এখনো বেশিরভাগ কোম্পানিতে নিরীক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যে কারনে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির এক বছর মুনাফা করার পরের বছর অস্বাভাবিক লোকসানের মতো আর্থিক হিসাব দেখতে হয়। এ জায়গাটিতে রেগুলেটররা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারেননি।
ব্র্যাক ব্যাংকের ওই ৪৩৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকার বিনিয়োগের বাজার দর (৩১ ডিসেম্বর) দাঁড়িয়েছে ৪৬৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটি ২৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকার আনরিয়েলাইজড মুনাফায় রয়েছে। তবে এই মুনাফা হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করে দেখানো হয়নি।
আনরিয়েলাইজড ছাড়াই ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারবাজার থেকে ২০২১ সালে ২২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার রিয়েলাইজড গেইন হয়েছে। এছাড়া লভ্যাংশ আয় হয়েছে ১৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকার।
আরও পড়ুন….
ব্যাংকটির সাবসিডিয়ারি বিকাশের লোকসান বেড়ে ১২৩ কোটি টাকা
এদিকে ব্যাংকটি সবচেয়ে বেশি স্কয়ার ফার্মায় বিনিয়োগ করলেও মালিকানায় এগিয়ে সিঙ্গার বাংলাদেশে। এই কোম্পানিটির যে পরিমাণ শেয়ার কেনা হয়েছে, তা মোট মালিকানার ৩.৩২%। এরপরে ম্যারিকো বাংলাদেশে ১.১৯% শেয়ার কেনা হয়েছে। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ বাটা সুর ০.৭৫% শেয়ার কেনা হয়েছে।
কোম্পানির নাম | মোট শেয়ার সংখ্যা | ব্র্যাকের কেনা শেয়ার সংখ্যা | মালিকানার হার |
সিঙ্গার বাংলাদেশ | ৯৯৭০২৮৩৮ | ৩৩১০৩২০ | ৩.৩২% |
ম্যারিকো বাংলাদেশ | ৩১৫০০০০০ | ৩৭৪৭৯৮ | ১.১৯% |
বাটা সু | ১৩৬৮০০০০ | ১০২৩৮৬ | ০.৭৫% |
লিন্ডে বিডি | ১৫২১৮৩০০ | ১১৩৩৫০ | ০.৭৪% |
বার্জার পেইন্টস | ৪৬৩৭৭৮৮০ | ৩১৩১২২ | ০.৬৮% |
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস | ৮৮৬৪৫১০১১ | ৫৩৫৬০৫২ | ০.৬০% |
গ্রামীণফোন | ১৩৫০৩০০০২২ | ২৭৯৫০২৬ | ০.২১% |
ইস্টার্ন ব্যাংক | ৯৫৩৮৬৪৪৬৮ | ১৪০০২১৬ | ০.১৫% |
রেনাটা | ১০৭১৯২৯৮৩ | ১৫৮৫৬৩ | ০.১৫% |
এই ব্যাংকটির ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে আয় ও সুদজনিত ব্যয় হ্রাসে আগের বছরের ৪৪১ কোটি ৮৩ লাখ টাকার নিট মুনাফা বেড়ে ২০২১ সালে হয়েছে ৫৪৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। আগের বছরে ব্যাংকটির প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে ২ হাজার ৭০৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা সুদজনিত আয় হয়েছিল। একই সময়ে গ্রাহকদের ডিপোজিট ও গৃহিত ঋণের বিপরীতে সুদজনিত ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৩৭২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এতে করে গত বছরে নিট সুদজনিত আয় হয়েছিল ১ হাজার ৩৩৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
কিন্তু ২০২১ সালে এসে প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে সুদজনিত আয় কমে আসার পরেও নিট হিসাবে বেড়েছে। এর কারন হিসাবে রয়েছে ডিপোজিট ও গৃহিত ঋণের বিপরীতে সুদজনিত ব্যয় আয়ের চেয়ে বেশি কমে আসা। দেখা গেছে, ব্যাংকটির ২০২১ সালে সুদজনিত আয় কমে এসেছে ২ হাজার ৪২২ কোটি ৫২ লাখ টাকায়। তবে ডিপোজিট ও গৃহিত ঋণের বিপরীতে সুদজনিত ব্যয় নেমে এসেছে ৭৯১ কোটি ২৯ লাখ টাকায়। এর ফলে আগের বছরের থেকে নিট সুদজনিত আয় ২৯৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৬৩১ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
ব্যাংকটির এই সুদজনিত আয় করতে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঋণ বিতরনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৮৯৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এরমধ্যে ১৯টি গ্রুপ অব প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ৮২২ কোটি ১৩ লাখ টাকা বা ২১.৩৯ শতাংশ।
ব্র্যাক ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে সিটি গ্রুপকে। এই গ্রুপে ব্র্যাক ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ (ফান্ডেড+নন ফান্ডেড) ৮৭৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এরপরের অবস্থানে থাকা মেঘনা গ্রুপে ৮৫৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা ও তৃতীয় সর্বোচ্চ আবুল খায়ের গ্রুপে ৬৯৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকার ঋণ দেওয়া হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর.এফ হুসাইন যোগাযোগ করলে তিনি ব্যস্ত আছেন জানিয়ে কোন মন্তব্য করেননি। এছাড়া ব্যাংকটির সচিব মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
উল্লেখ্য, একটি ব্যাংক একক গ্রাহক বা গ্রুপকে মূলধনের ১০ শতাংশ ঋণ দিলে তা বড় ঋণ বা লার্জ লোন হিসেবে বিবেচিত হয়। আর ফান্ডেড ঋণ বলতে ব্যাংক থেকে সরাসরি টাকা দেওয়াকে বোঝায়। আর নন-ফান্ডেড বলতে এলসি, গ্যারান্টিসহ বিভিন্ন দায়কে বোঝানো হয়।
১৯৯৯ সালে যাত্রা শুরু করা ব্র্যাক ব্যাংকের ১৮৭টি শাখা রয়েছে। এছাড়া ১৯৮টি এরিয়া অফিস, ৪৫৬টি এসএমই ইউনিট অফিস, ৩৭৩টি এটিএম বুথ ও ৭৮৫টি এজেন্ট আউটলেট রয়েছে।
বিজনেস আওয়ার/০৫ এপ্রিল, ২০২২/আরএ
Appreciable performance.