প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) অনুমোদনে উল্টো পথে হাটছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। দেশের অর্থনীতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আইপিও বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক হলেও কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ৯ বছরে সবচেয়ে কম অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় শেয়ারবাজারের আকারকে ক্রমান্বয়ে ছোট করে তুলছে।
দেশের অর্থনীতির সঙ্গে শেয়ারবাজার এগোতে পারছে না বলে সব মহলেই সমালোচনা করা হয়। এই সমস্যা কাটিয়ে তুলতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকের পরিবর্তে শেয়ারবাজারকে উৎস করার পরামর্শ বিশ্লেষকদের। কিন্তু গত ৯ বছরে তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। বরং উল্টো পথে হেটেছে কমিশন। এই সময় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বাড়ানোর দরকার পড়লেও কমিয়েছে।
দেখা গেছে, বিএসইসি গঠনের ২৭ বছরে (১৯৯৩) শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে ২৮৪ কোম্পানি (তালিকাচ্যুত ছাড়া)। এরমধ্যে কমিশন গঠনের প্রথম ৯ বছরে তালিকাভুক্ত হয়েছে ৯৯ কোম্পানি। আর দ্বিতীয় ৯ বছরে তালিকাভুক্ত হয়েছে ৯৪টি। বাকি ৯ বছরে অর্থাৎ খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন সময়ে তালিকাভুক্ত হয়েছে ৯১টি। অথচ এই সময়ে দেশের অর্থনীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নিত হয়েছে।
এদিকে শেয়ারবাজারে কমিশন গঠনের পরে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২৮৪টি বর্তমানে শেয়ারবাজারে থাকলেও গত বছরের রহিমা ফুড ও মডার্ণ ডাইংসহ এ পর্যন্ত শেয়ারবাজারের ইতিহাসে যোগ্যতার অভাবে ৩৮টি কোম্পানি তালিকাচ্যুত বা শেয়ারবাজার থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। এরমধ্যে কমিশন গঠনের প্রথম ১৮ বছরে রহিমা ফুডসহ তালিকাভুক্ত হওয়া কিছু কোম্পানি রয়েছে। এ হিসাবে বিএসইসি গঠনের প্রথম ১৮ বছরে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানির সংখ্যা আরও বেশি। ফলে বর্তমান কমিশনের সময়ে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানির অনুপাত আরও কম।
শেয়ারবাজারের এক ক্রান্তিলগ্নে কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন খায়রুল হোসেন। যেসময় শেয়ারবাজার ছিল নানা অনিয়মে জর্জরিত, ছিল না সুশাসন ও কমিশন থেকে চাকরী ছেড়ে চলে যাচ্ছিল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সেই দুঃসময়ে অনিয়ম দূর করা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাই ছিল খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশনের চ্যালেঞ্জিং কাজ। তবে এই কাজ করতে গিয়ে আইপিওতে পিছিয়ে পড়েছে তার নেতৃত্বাধীন কমিশন।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বিজনেস আওয়ারকে বলেন, দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে এবং অনেক বড় হয়েছে। কিন্তু দেশের শেয়ারবাজার সেভাবে এগোচ্ছে না। এই সমস্যা কাটিয়ে তুলতে শেয়ারবাজারের অংশগ্রহণ বাড়ানো দরকার। এক্ষেত্রে বেশি বেশি করে ভালো কোম্পানি শেয়ারবাজারে আনতে হবে।
গত ৯ বছর আগে জিডিপির তুলনায় শেয়ারবাজারের আকার ছিল ৫০.৭০ শতাংশ। যা এখন ১৩.৩৯ শতাংশে নেমে এসেছে। এর অন্যতম কারন হিসাবে রয়েছে দেশের অর্থনীতি যে হারে এগোচ্ছে, সে হারে শেয়ারবাজারে কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। এছাড়া ২০১৯ সালে শেয়ারবাজারের মন্দার কারনেও অনুপাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এদিকে জিডিপিতে শেয়ারবাজার পিছিয়ে পড়ার আরেকটি অন্যতম কারন হিসেবে রয়েছে আর্থিক খাতের মন্দাবস্থা ও শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেওয়া। একসময় ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির শেয়ার চাঙ্গা থাকলেও এখন তলানিতে। অথচ শেয়ারবাজারে এই খাতের অংশগ্রহণ বেশি। যাতে চাঙ্গা মূহূর্তে জিডিপির তুলনায় শেয়ারবাজারের অনুপাত বেশি ছিল। কিন্তু ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির শেয়ারের তলানিতে নেমে আসায় অনুপাতও কমেছে। এছাড়া ২০০৯-১০ সালে ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার সুযোগ ছিল বেশি। আর সেই সুযোগের থেকেও অনেক ব্যাংক বেশি বিনিয়োগ করে। আর এখন বিনিয়োগের সুযোগ প্রায় ৪ ভাগের ১ ভাগে কমিয়ে আনার পরেও অনেক ব্যাংকের বিনিয়োগ ঘাটতি রয়েছে।
জিডিপির তুলনায় ডিএসইর বাজার মূলধন-
সাল | জিডিপির অনুপাত |
২০১০ | ৫০.৭০% |
২০১১ | ৩৩.২০% |
২০১২ | ২৬.৩০% |
২০১৩ | ২৫.৫০% |
২০১৪ | ২৪.১০% |
২০১৫ | ২০.৬০% |
২০১৬ | ১৯.৭০% |
২০১৭ | ২১.৬২% |
২০১৮ | ১৭.২১% |
২০১৯ | ১৩.৩৯% |
এদিকে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের মূলধন জিডিপির তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এমনকি পাকিস্তানের থেকেও পিছিয়ে বাংলাদেশ। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা রয়েছে। এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে শেয়ারবাজারে বিভিন্ন কোম্পানির তালিকাভুক্তি বাড়ানো দরকার হলেও ২০১৯ সালে তা আরো কমেছে।
নিম্নে কয়েকটি দেশের বাজার মূলধন ও জিডিপির অনুপাত তুলে ধরা হল-
বিএসইসির আরেক সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বিজনেস আওয়ারকে বলেন, শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপন একটি বড় বাধা। কিন্তু কোন ডায়নামিক উদ্যোক্তা শেয়ারবাজার থেকে ফান্ড সংগ্রহের জন্য ২ বছর অপেক্ষা করবে না। তাদের জন্য ব্যাংক ঋণ দেওয়ার জন্য বসে রয়েছে। এমতাবস্থায় তারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে কোম্পানিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই ভালো কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনার জন্য এই সমস্যার বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তার প্রয়োজন।
বাংলাদেশে এখনো পুঁজির উৎস হিসেবে উদ্যোক্তারা শেয়ারবাজারের চেয়ে ব্যাংক ঋণের উপর বেশি নির্ভরশীল। সামগ্রিকভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহের চেয়ে অনেক বেশি। গত কয়েক বছরে শেয়ারবাজারের অবস্থা আগের তুলনায় শক্তিশালী হলেও এখান থেকে মৌলিক খাতে মূলধন স্থানান্তরের প্রবণতা অনেক কম।
সাল | ঋণ দাড়িঁয়েছে (কোটি টাকা) | ঋণ সরবরাহ (কোটি টাকা) | শেয়ারবাজার থেকে অর্থায়ন (কোটি টাকা) | শেয়ারবাজারের অংশ |
২০০৯ | ২৯৩৫০০ | ৪৪৭০০ | ৯১৮ | ২% |
২০১০ | ৩৭৭৩০০ | ৮৩৮০০ | ৩৩৯০ | ৩.৮৯% |
২০১১ | ৪৪৯০০০ | ৭১৭০০ | ৩২৩৪ | ৪.৩২% |
২০১২ | ৫২৫৮০০ | ৭৬৮০০ | ১৮৪৩ | ২.৩৪% |
২০১৩ | ৫৬৯৫০০ | ৪৩৭০০ | ৯১১ | ২.০৪% |
২০১৪ | ৬৫৫৮০০ | ৮৬৩০০ | ৩২৬৪ | ৩.৬৪% |
২০১৫ | ৭৫৭৬০০ | ১০১৮০০ | ৬৭৬ | ০.৬৬% |
২০১৬ | ৮৭৬৩০০ | ১১৮৭০০ | ৯৫০ | ০.৭৯% |
২০১৭ | ১০৪৩৬০০ | ১৬৭৩০০ | ১৪৪২ | ০.৮৫% |
২০১৮ | ১১৯১৭৯০ | ১৪৮১৯০ | ৬৫৫.৪০ | ০.৪৪% |
সূত্র : বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি
বিজনেস আওয়ার/ ০৬ মে, ২০২০/আরএ