বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক : শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত মাগুরা গ্রুপের পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং থেকে একই গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিতে কোটি কোটি টাকা ফেলে রাখা হয়েছে। অথচ কোম্পানিটি নিজে ঋণে জর্জরিত। এই অবস্থায় গ্রুপের কোম্পানিগুলো থেকে টাকা আদায় না করে উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা শেয়ার বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করবেন। যে অর্থ কতদিন পেপার প্রেসেসিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হবে, তার কোন সময়সীমা বেধে দেওয়া হয়নি। ফলে কিছুদিন পরে কোম্পানি আবারও ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে পারবে।
এতে করে ঋণ পরিশোধের যে উদ্দেশ্য তা ব্যহত হবে। কিন্তু গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিতে পড়ে থাকা অর্থ আদায় করে ঋণ পরিশোধ করলে, সেই ঝুঁকি থাকত না।
উদ্যোক্তা/পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি করে ঋণ পরিশোধে ঝুঁকি থাকলেও তারা নিজেদের স্বার্থ ঠিকই আদায় করে নিয়েছে। শেয়ার বেচে ঋণ পরিশোধকে খুব ভালো সংবাদ হিসেবে প্রচার করে উচ্চ দরে বিক্রি করেছে। তারা প্রতিটি ১৬৫.৫৩ টাকা করে ৯,৩৬,৯৮০টি শেয়ার ১৫ কোটি ৫১ লাখ টাকায় বিক্রি করেছে।
সাধারন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় তালিকাভুক্ত কোম্পানি থেকে গ্রুপের অন্যান্য কোম্পানিতে অর্থ পাচার প্রতিরোধে গত বছর শক্ত অবস্থান নেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। যার আলোকে অনেক কোম্পানি টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়। তবে সেটার মনিটরিংয়ের অভাবে পেপার প্রসেসিংয়ের মতো অনেকে এখনো বিনিয়োগকারীদেরকে ঠকাচ্ছে।
দেখা গেছে, পেপার প্রসেসিং থেকে গ্রুপটির ১৪ কোম্পানিতে বিনাসুদে ১৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা ফেলে রাখা হয়েছে। এরমধ্যে মাগুরা পেপার মিলসে সবচেয়ে বেশি ৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা রয়েছে। এরপরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশ নিউজ অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেডে ২ কোটি ৬২ লাখ টাকা, তৃতীয় সর্বোচ্চ বাংলাদেশ ডেভেলোপমেন্ট কোম্পানিতে ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা ও চতুর্থ সর্বোচ্চ পার্ল পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলসে ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা রয়েছে।
এই প্রদত্ত অর্থের বিপরীতে পেপার প্রসেসিং কোন রিটার্ন পাচ্ছে না। এটাকে বিনাসুদে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সাধারন শেয়ারহোল্ডারদের অর্থ উদ্যোক্তা/পরিচালকদের ব্যক্তিগত কোম্পানিতে সরবরাহ বলা যেতে পারে। এতে উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন সাধারন বিনিয়োগকারীরা। কারন যেসব কোম্পানিতে সরানো হয়েছে, সেগুলোতে সাধারন বিনিয়োগকারীদের মালিকানা নেই। অথচ পেপার প্রসেসিংয়ে ৬৫ শতাংশের বেশি মালিকানা রয়েছে সাধারন বিনিয়োগকারীদের।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বিজনেস আওয়ারকে বলেন, সাধারন বিনিয়োগকারীদের মালিকানাধীন তালিকাভুক্ত কোম্পানি থেকে উদ্যোক্তা/পরিচালকদের ব্যক্তিগত কোম্পানিতে অর্থ সড়ানো কোনভাবেই মেনে নেওয়া ঠিক হবে না। এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রকসংস্থাগুলোর শক্ত অবস্থান নিতে হবে। একইসঙ্গে অর্থ ফেরত আনা নিশ্চিত করে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং থেকে ওই ফেলে রাখা অর্থের তালিকায় রয়েছে একই গ্রুপের অতি ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশ নিউজ অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড। এই কোম্পানিটি মূলত সংবাদ মাধ্যমের জন্য। কোম্পানিটির অধীনে বাংলাদেশের খবর, দিন পরিবর্তন ও বাংলাদেশ নিউজ নামের ৩টি গণমাধ্যম প্রকাশিত হত। যেগুলো এখন মৃতপ্রায়। যাতে অর্থ আদায়ে খুবই শঙ্কা থাকা স্বাভাবিক।
(বাংলাদেশ নিউজ অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেডের ওয়েবসাইটের তথ্য)
এই অর্থ গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিতে ফেলে রাখার বিপরীতে মাগুরা গ্রুপের ৪ কোম্পানিতে পেপার প্রসেসিংয়ের বকেয়া আছে ৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
নিজেদের গ্রুপের অন্যসব কোম্পানিকে লাভবান করতে গিয়ে তালিকাভুক্ত পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিংকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে গ্রুপটির কর্তা-ব্যক্তিরা। এই কোম্পানিটি থেকে অন্যত্র অর্থ সরিয়ে নিয়ে ঋণে জড়ানো হয়েছে। যাতে করে ওই ঋণের সুদ বহন করতে গিয়ে মুনাফায় দূর্বল হয়ে পড়েছে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি।
দেখা গেছে, গত ৩১ মার্চ ১০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের পেপার প্রসেসিংয়ের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এরমধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা ও স্বল্পমেয়াদি ১৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে।
এই বিশাল ঋণের কারনে সুদজনিত ব্যয়ও হচ্ছে অনেক। যাতে মুনাফায় বড় ধাক্কা লাগছে। যেমন পেপার প্রসেসিংয়ের গত অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই ২১-মার্চ ২২) উচ্চ সুদজনিত ব্যয়ের কারনে ৬ কোটি ৪৫লাখ টাকার পরিচালন মুনাফা কমে ৩ কোটি ১১ লাখ টাকার নিট মুনাফা হয়েছে। ওইসময় কোম্পানিটির সুদজনিত ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে পেপার প্রসেসিংয়ের কোম্পানি সচিব মুস্তাফিজুর রহমান বিজনেস আওয়ারকে বলেন, ঋণ পরিশোধের শর্তে কমিশন উদ্যোক্তা/পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিতে পড়ে থাকা অর্থ আদায় করেওতো ঋণ পরিশোধ করা যেত-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সেটা ঠিক আছে। এখন একসঙ্গেতো আর সব অর্থ আদায় করা যাচ্ছে না। আমরা ধাপে ধাপে আদায় করছি।
শেয়ার বিক্রি থেকে ঋণ পরিশোধে প্রদত্ত অর্থ কতদিন কোম্পানিতে থাকবে-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কোন শর্ত নেই। তাহলে এখন ঋণ শোধ করে কিছুদিন পর কোম্পানি আবারও ঋণ নিয়ে যদি সেই অর্থ উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা ফেরত নিয়ে নেয়- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে আসলে কোন শর্ত দেওয়া হয়নি।
উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ওভার দ্য মার্কেটে (ওটিসি) ছিল মাগুরা গ্রুপের মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং ও পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। তবে গত বছরের ১৩ জুন কোম্পানি দুটির শেয়ার লেনদেন মূল মার্কেটে শুরু হয়েছে। এরপর থেকেই শেয়ার দুটি নিয়ে শুরু হয় কারসাজি। যাতে করে অস্বাভাবিক হারে বাড়ে শেয়ার দর।
বিজনেস আওয়ার/১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২/আরএ