অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে শেয়ারবাজারে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রতিটি শেয়ার ৮০ টাকা করে ইস্যু করে বসুন্ধরা পেপার মিলস। এমন উচ্চ ইস্যু মূল্যের কোম্পানিটির পর্ষদ ২০২১-২২ অর্থবছরের ব্যবসায় অভিহিত মূল্য বিবেচনায় (১০ টাকা) ১০ শতাংশ বা শেয়ারপ্রতি ১ টাকা লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। যা কাট-অফ প্রাইসের তুলনায় ১.২৫ শতাংশ। এই কোম্পানিটির কাট-অফ প্রাইস যে অতিমূল্যায়িত করা হয়েছিল, সেটা ওইসময়ই অভিযোগ উঠেছিল। যা করতে ইস্যু ম্যানেজার প্রতিষ্ঠান সক্রিয় ভূমিকা রাখে বলে অভিযোগ ছিল।
বুক বিল্ডিংয়ে আসা কোম্পানিগুলো কাট-অফ প্রাইস অতিমূল্যায়িত করার জন্য ইস্যু ম্যানেজারের সহযোগিতায় কারসাজি করেছে, সে অভিযোগ অনেক আছে। এছাড়া শেয়ারবাজারে আসার আগে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অতিরঞ্জিত করে মুনাফা দেখানোর অভিযোগ আরও পুরোনো। এরমাধ্যমে অনেক কোম্পানি উচ্চ দরে শেয়ার ইস্যু করে টাকা তুলে নিয়েছে। যাতে করে তালিকাভুক্তির পরে শেয়ারহোল্ডারদেরকে দিতে পারছে না সঠিক লভ্যাংশ। এছাড়া কমে এসেছে মুনাফার পরিমাণ। একইসঙ্গে অর্ধেক কোম্পানির শেয়ার দর কাট-অফ প্রাইসের নিচে চলে এসেছে।
দেখা গেছে, ২০১৫ সালে সংশোধিত পাবলিক ইস্যু রুলস চালুর পরে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১৫টি কোম্পানি বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রিমিয়ামে অর্থ সংগ্রহ করেছে। ওই কোম্পানিগুলো কাট-অফ প্রাইসের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরের ব্যবসায় ৫.৬৬ শতাংশ করে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। তবে ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন ও ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজকে বাদ দিলে, এই লভ্যাংশের হার মাত্র ২.৫১ শতাংশ।
বুক বিল্ডিংয়ের ১৫টি কোম্পানির মধ্যে ১২টি কোম্পানি কাট-অফ প্রাইস বিবেচনায় ৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারেনি। তারপরেও কোম্পানিগুলো ‘এ’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করবে। কিন্তু একইসময়ের অভিহিত মূল্যের দুই-একটি কোম্পানি ৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েও ‘বি’ ক্যটাগরিতে নেমে যাবে।
নিয়ম অনুযায়ি, ১০ শতাংশ বা তার বেশি লভ্যাংশ দেওয়া কোম্পানি ‘এ’ ক্যাটাগরিতে স্থান পায়। আর ১০ শতাংশের কম লভ্যাংশ দেওয়া কোম্পানি ঠাই পায় ‘বি’ ক্যাটাগরিতে। এছাড়া লভ্যাংশ না দেওয়া কোম্পানি ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভূক্ত হয়। এই হিসাব গণনায় সব ধরনের কোম্পানির জন্য লভ্যাংশ ঘোষণার ক্ষেত্রে অভিহিত মূল্যেকে (১০ টাকা) বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ প্রতিটি শেয়ার ১০ টাকা দরে ইস্যু করা কোম্পানি এবং ৮০ টাকা করে ইস্যু করা কোম্পানিকে একইভাবে বিবেচনা করা হয়।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রিমিয়াম নেওয়া কোম্পানি থেকেও যদি বিনিয়োগকারীরা অভিহিত মূল্যের কোম্পানির মতো লভ্যাংশ পায়, তাহলে বুক বিল্ডিংয়ে শেয়ারবাজারে আসার দরকার কি? যদি প্রিমিয়ামের বিপরীতে রিটার্ন নাই আসে, তাহলে শুধুমাত্র অভিহিত মূল্যের কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেওয়াই শ্রেয়। তবে ইস্যু মূল্যের লভ্যাংশের উপরে ক্যাটাগরি নির্ধারনে সুফল আসতে পারে বলে মনে করেন তারা।
আরও পড়ুন…..
দেশে ডলার সংকট : শেয়ারবাজার থেকে বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার কোটি
ব্যবসায়িক পারফরমেন্স ভালো দেখিয়ে গত ৮ বছরে বুক বিল্ডিংয়ে ১৫টি কোম্পানি প্রিমিয়াম নিয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছে। ওই কোম্পানিগুলো গড়ে ৬৮.৩৩ টাকা করে প্রতিটি শেয়ার ইস্যু করেছে। এর বিপরীতে কোম্পানিগুলো গড়ে শেয়ারপ্রতি ৩.৮৭ টাকা বা ৫.৬৬ শতাংশ হারে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। তবে ইউনাইটেড পাওয়ার ও ওয়ালটন হাই-টেক ছাড়া বাকি ১৩ কোম্পানির গড় ইস্যু মূল্য ৪৯.০৭ টাকা। যে কোম্পানিগুলোর পর্ষদ গড় শেয়ারপ্রতি ১.২৩ টাকা করে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। যা ইস্যু মূল্য বিবেচনায় ২.৫১ শতাংশ।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বিজনেস আওয়ারকে বলেন, সব ধরনের কোম্পানির লভ্যাংশে অভিহিত মূল্য বিবেচনায় নেওয়ায়, প্রিমিয়াম নেওয়া কোম্পানিগুলোর প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে না। ইস্যু মূল্য বিবেচনায় ক্যাটাগরি নির্ধারন করা হলে, প্রিমিয়াম নেওয়া কোম্পানিগুলোর জন্য ‘এ’ ক্যাটাগরি ধরে রাখা কঠিন হবে। তবে প্রিমিয়াম নেওয়া কিছু কোম্পানির মধ্যে ক্যাটাগরি ধরে রাখার জন্য লভ্যাংশের পরিমাণ বাড়বে।
শেয়ারবাজারে আসার আগের সঙ্গে পরের ব্যবসায়িক পার্থক্য ও লভ্যাংশে নাজুক অবস্থার কারনে ওই ১৫টির মথ্যে ৭টির শেয়ার দর কাট-অফ প্রাইসের নিচে চলে এসেছে। এ তালিকায় রয়েছে- রানার অটোমোবাইলস, এস্কয়ার নিট কম্পোজিট, মীর আখতার হোসাইন, আমান কটন ফাইব্রাস, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন, বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার ও একমি ল্যাবরেটরিজ।
নিম্নে ২০১৫ সালের পাবলিক ইস্যু রুলসের অধীনে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রিমিয়ামে শেয়ারবাজারে আসা কোম্পানিগুলোর বিস্তারিত তুলে ধরা হল-
কোম্পানির নাম | কাট-অফ প্রাইস (টাকা) | শেয়ারপ্রতি লভ্যাংশ (টাকা) | কাট-অফ প্রাইসে লভ্যাংশের হার | শেয়ার দর (টাকা) |
বসুন্ধরা পেপার মিলস | ৮০ | ১ | ১.২৫% | ৮৭.৯০ |
রানার অটোমোবাইলস | ৭৫ | ১ | ১.৩৩% | ৪৮.৪০ |
ইনডেক্স এগ্রো | ৬২ | ১ | ১.৬১% | ১০৩.৭০ |
মীর আখতার | ৬০ | ১.২৫ | ২.০৮% | ৫০.৮০ |
*এস্কয়ার নিট | ৪৫ | ১ | ২.২২% | ৩৪.৫০ |
*আমান কটন ফাইব্রাস | ৪০ | ১ | ২.৫০% | ২৬.৫০ |
আমরা নেটওয়ার্ক | ৩৯ | ১ | ২.৫৬% | ৪৬.৫০ |
এনার্জিপ্যাক পাওয়ার | ৩৫ | ১ | ২.৮৬% | ৩৪.৫০ |
বারাকা পতেঙ্গা | ৩২ | ১ | ৩.১৩% | ২৯.৩০ |
এডিএন টেলিকম | ৩০ | ১ | ৩.৩৩% | ৯৮ |
লুব-রেফ বাংলাদেশ | ৩০ | ১ | ৩.৩৩% | ৩৫.১০ |
একমি ল্যাবরেটরিজ | ৮৫.২০ | ৩ | ৩.৫২% | ৮৫ |
জেএমআই হসপিটাল | ২৫ | ১.২৫ | ৫% | ৭৪.১০ |
ওয়ালটন হাই-টেক | ৩১৫ | ২৫ | ৭.৯৪% | ১০৪৭.৭০ |
ইউনাইটেড পাওয়ার | ৭২ | ১৭ | ২৩.৬১% | ২৩৩.৭০ |
গড় | ৬৮.৩৩ টাকা | ৩.৮৭ টাকা | ৫.৬৬% |
*এস্কয়ার নিট ও আমান কটনের পর্ষদ শুধুমাত্র সাধারন শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষনা করেছে।
এ বিষয়ে ইনডেক্স এগ্রোর সচিব আবু জাফর আলী বিজনেস আওয়ারকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সারাবিশ্বে মন্দা দেখা দিয়েছে। আগামি বছরে দূর্ভিক্ষের সম্ভাবনা নিয়েও কথা হচ্ছে। এই অবস্থায় ভবিষ্যতে সৃষ্ট ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য কম লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে কোম্পানিগুলো উচ্চ প্রিমিয়ামে অর্থ সংগ্রহের পরে মুনাফা নিম্নমূখী। ওই ১৫টি কোম্পানির মধ্যে ১০টি কোম্পানিরই শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) আইপিওকালীন সময়ের তুলনায় কমে এসেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় এনার্জিপ্যাক পাওয়ার। এই কোম্পানিটির আইপিওকালীন ৩.১৩ টাকার ইপিএস ২০২১-২২ অর্থবছরে নেমে এসেছে মাত্র ০.৩৮ টাকায়। অর্থাৎ ইপিএস কমেছে ৮৮শতাংশ।
নিম্নে বুক বিল্ডিংয়ের কোম্পানিগুলোর আইপিওকালীন ও সর্বশেষ অর্থবছরের ইপিএসের তথ্য তুলে ধরা হল-
কোম্পানির নাম | আইপিওকালীন ইপিএস (টাকা) | ২০২১-২২ অর্থবছরের ইপিএস | উত্থান-পতনের হার |
এনার্জিপ্যাক পাওয়ার | ৩.১৩ | ০.৩৮ | (৮৮%) |
আমান কটন ফাইব্রাস | ২.৪৪ (৯ মাস) | ০.৭৬ | (৭৭%) |
বারাকা পতেঙ্গা | ৩.৬০ | ১.২৫ | (৬৫%) |
রানার অটোমোবাইলস | ৪.৯০ | ২.৪০ | (৫১%) |
আমরা নেটওয়ার্ক | ২.৬২ (৯ মাস) | ১.৮৫ | (৪৭%) |
এস্কয়ার নিট | ৩.৪৪ | ২.৩৬ | (৪৬%) |
ইনডেক্স এগ্রো | ৭.০৭ | ৫.০৯ | (২৮%) |
মীর আখতার | ৩.৭৫ | ২.৯৩ | (২২%) |
লুব-রেফ বাংলাদেশ | ২.৫৬ | ২.১৩ | (১৭%) |
এডিএন টেলিকম | ২.৬৭ | ২.৫৯ | (৩%) |
বসুন্ধরা পেপার মিলস | ২.৬১ | ২.৯২ | ১২% |
জেএমআই হসপিটাল | ২.৫০ | ৩.২৫ | ৩০% |
ওয়ালটন হাই-টেক | ২৫.৫৩ | ৪০.১৬ | ৫৭% |
একমি ল্যাবরেটরিজ | ৫.৭০ | ৯.৯৮ | ৭৫% |
ইউনাইটেড পাওয়ার | ৫.৯৮ | ১৭.২১ | ১৮৮% |
বিজনেস আওয়ার/২৪ নভেম্বর, ২০২২/আরএ