বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক : ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি সৈয়দ রেজাউর রহমান ও কতিপয় সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাদের অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। এসব অভিযোগে তাদের পদত্যাগের দাবিতে ক্লাস বর্জন সহ কর্মবিরতি ঘোষণা দিয়েছেন তারা। সেই সঙ্গে অনিয়মের অভিযোগে এনে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে কলেজ প্রাঙ্গণে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
রবিবার সকালে কলেজ ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলনে এসব ঘোষণা দেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়েন কলেজের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম। এসময় শিক্ষকরা জানান, যতক্ষণ পর্যন্ত গভর্নিং বডির সভাপতি ও তাদের দোসররা পদত্যাগ না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কলেজে কোনো ক্লাস বা কোনো ধরনের কার্যক্রম চলতে দেওয়া হবে না।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের গভর্নিং বডির বর্তমান সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান। তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। প্রায় ১৪ বছর যাবৎ তিনি এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছেন। গভর্নিং বডিতে অন্য সব পদে কিছুটা পরিবর্তন এলেও সভাপতির পদে এত বছরেও কোনো পরিবর্তন আসেনি।
কিছুদিন আগে বিভিন্ন অনিয়ম মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন খাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেন সাবেক অধ্যক্ষ জসিম উদ্দীন আহম্মেদ, মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক তৌফিক আজিজ চৌধুরী ও বাংলা বিভাগের শিক্ষক তরুণ কুমার গাঙ্গুলী। এর মাধ্যমে ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের সুনাম চরমভাবে নষ্ট করেছেন তারা। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি ও কতিপয় সদস্য প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। সে কারণে এগুলো কখনোই প্রকাশিত হয়নি ও এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত অধ্যক্ষ ও অপর দুই শিক্ষকের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ প্রাথমিক তদন্ত হয়। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক তদন্তের জন্য কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া দীর্ঘ প্রায় পাঁচ মাস ধরে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ও আইনগত জটিলতায় আটকে আছে। এ তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত করতে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন, যেখানে অন্য আরও ছয়জনের পাশাপাশি কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতিকে প্রতিপক্ষ করা হয়। কিন্তু অজানা কারণে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বর্তমান গভর্নিং বডি বাতিল করে নতুন গভর্নিং বডি গঠনের ব্যবস্থা নিতে জোর দাবি জানান শিক্ষকরা। তাদের সংঘটিত অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
সম্মেলনে গভর্নিং বডির অনিয়ম-দুর্নীতির একটি তালিকা তুলে ধরেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। ওই তালিকার যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা হলো:- গভর্নিং বডির সভাপতি পদে সৈয়দ রেজাউর রহমান দীর্ঘ ১৪ বছর যাবত দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সভাপতি পদে দুই মেয়াদে দুই বছর করে সর্বোচ্চ চার বছর দায়িত্ব পালন করা যায়। গভর্নিং বডির সভাপতি বয়োজ্যৈষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় গভর্নিং বডির সভায় কোনো বিষয়ের সিদ্ধান্তে তার মতের বিরুদ্ধাচরণ করার কেউ সাহস দেখান না অর্থাৎ অন্য সদস্যদের মতামত খুব বেশি প্রাধান্য পায় না; গভর্নিং বডির প্রতি সভায় কিছু সদস্যের বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও সভায় উপস্থিত সদস্যরা সিটিং ভাতা হিসাবে ১০ হাজার টাকা গ্রহণ করেন। সমাজসেবা মূলক দায়িত্ব পালনে এরুপ ভাতা গ্রহণ যুক্তিযুক্ত নয়; গভর্নিং বডির যোগসাজশে ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালে একাধিকবার অধ্যক্ষ নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে পূর্ববতী দুই কলেজে অন্যায়-অনিয়মের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অধ্যক্ষ হিসাবে জসীম উদ্দিন আহম্মেদকে নিয়োগ প্রদান করা হয়; গভর্নিং বডির সভাপতি ও কতিপয় সদস্যদের সাথে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে ২০১৫ সালে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে নিয়োগ বোর্ডের সুপারিশ ছাড়া উপাধ্যক্ষ হিসাবে মো. মুজিবর রহমানকে নিয়োগ প্রদান করা হয়; অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে সাময়িক বরখাস্তকৃত অধ্যক্ষ ও অপর দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে;
গভর্নিং বডির কতিপয় সদস্যরা তাদের অফিস ও বাড়িতে গভর্নিং বডির সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই সাময়িক বরখাস্তকৃত অধ্যক্ষ ও অপর দুই শিক্ষকদের সাথে বসে প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের বিরোধী বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের পছন্দ মতো সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয় এবং পরবর্তীতে সভায় শুধু আনুষ্ঠানিকতা করা হয়; অনিয়ম করে গভর্নিং বডির সভাপতি ও কতিপয় সদস্যদের সাথে আর্থিক লেনদেনে অপ্রয়োজনীয় বিপুল সংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে; শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকুরী স্থায়ীকরন ও পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও গভর্নিং বডির কতিপয় সদস্যদের সাথে আর্থিক লেনদেন করা হয়েছে; শিক্ষক কর্মচারীদের ভয়ভীতির মধ্যে রাখার জন্য ২০১৮ সালে তৎকালীন অধ্যক্ষ ও তৎকালীন গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধিদের প্ররোচনায় কলেজ গভর্নিং বডির মাধ্যমে চারজন শিক্ষককে বিনা নোটিশে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছিল। সভাপতি প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় ব্যক্তিগতভাবে তখন এটি ম্যানেজ করেছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আপিল নিস্পত্তিতে এটি অবৈধ ঘোষণা করা হয়; গভর্নিং বডির কতিপয় সদস্যরা অধ্যক্ষের প্রশাসনিক ক্ষমতার বাইরে সময় সময় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিক্ষক-কর্মচারীদের উচ্চস্বরে বকাঝকা করা, তাদের চাকুরিচ্যুতির হুমকি প্রদর্শন, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ইত্যাদি বলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে থাকেন। গভর্নিং বডির সদস্যদের কোন প্রশাসনিক ক্ষমতা বা এ ধরণের আচরণ দেখানোর সুযোগ নাই;
গভর্নিং বডির প্রত্যক্ষ মদদে প্রতি বছরে উপাধ্যক্ষকে কমিটির আহবায়ক করে বিনা রশিদে ও ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে শিক্ষার্থীদের ইউনিফরমের নিম্নমানের কাপড় ও জুতা সরবরাহ করে মুনাফা হিসাবে প্রাপ্ত ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা গভর্নিং বডির কতিপয় সদস্য ও কতিপয় দুর্নীতিবাজ শিক্ষকদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করা হয়; গভর্নিং বডির সভাপতির কাছে প্রতিষ্ঠানের কোন অনিয়ম-দুর্নীতি লিখিত বা মৌখিকভাবে তুলে ধরা হলেও তিনি তা আমলে নেন না বরং যে বা যারা বিষয়গুলো সম্পর্কে কথা বলেন বা তাকে জানান তাদেরকে প্রতিষ্ঠান বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন। এভাবেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দূর্নীতিবাজদের তিনি সহযোগিতা করেন; করোনাকালীন সময়ে ২০২০ সালে গভর্নিং বডির মাধ্যমে কলেজের ফান্ড ভেঙ্গে এগার কোটি টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়নি; সাময়িক বরখাস্তকৃত অধ্যক্ষ ও অপর দুই শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক বছরে বোর্ডের ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় বিনা রশিদে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। গভর্নিং বডি এ সম্পর্কে জেনেও কোন ব্যবস্থা নেননি; উপাধ্যক্ষের নেতৃত্বে বিভিন্ন কমিটিতে নগদ টাকা উত্তোলন করে খরচের সঠিক হিসাব ছাড়াই গভর্নিং বডির অর্থ কমিটিতে ও নিয়মিত সভায় বিনা বাধায় অনুমোদন করা হয়েছে। এ ধরণের দুর্নীতিতে প্রত্যক্ষভাবে গভর্নিং বডির সদস্যরা জড়িত আছেন; অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার নামে লাখ লাখ টাকা শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে কলেজে নগদ টাকায় গ্রহণ করে এর আয়-ব্যয়ে কোন সামঞ্জস্যতা নেই। এধরণের দুর্নীতিও গভর্নিং বডির সদস্যদের ম্যানেজ করে সংঘটিত হয়েছে; বিভিন্ন ক্রয়, সংস্কার ও উন্নয়নমূলক কাজ দরপত্র বিহীন, বিল ভাউচার বিহীন বা জাল দরপত্র ও জাল বিল-ভাউচারের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে সম্পন্ন করা হয়েছে। এ ধরণের দুর্নীতিতে প্রত্যক্ষভাবে গভর্নিং বডির সদস্যরা জড়িত আছেন।
বিজনেস আওয়ার/৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩/এমএজেড