মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান : বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা, কারসাজি, রেগুলেটরদের খামখেয়ালি সহ বেশকিছু সমস্যার কারনে শেয়ারবাজার চলছে মন্দা। এসব সমস্যার সমাধান না হওয়া পযর্ন্ত শেয়ারবাজার কখনোই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরবে না বলে জানিয়েছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।
মন্দায়ও শেয়ার দর কারসাজি থেমে নেই জানিয়ে তারা বলছেন, শেয়ারবাজারে চলছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম অস্থিরতা। এরও মাঝে চলছে কারসাজি। দেখেও না দেখার ভানে রয়েছে নিয়ন্ত্রকরা। এছাড়া সামনে বড় মন্দা হবে, এ ধরনের খবর সিকিউরিটিজ হাউজগুলোতে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এ কাজে হাউজের অসাধু কর্মকর্তারা জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। অনেকেই ক্ষেত্রে দেখা যায়, হাউজের কর্মকর্তারা পরামর্শ দিচ্ছে, কোনটা কিনবে। কোনটা কিনবে না।
রেগুলেটরদের প্রসঙ্গে তারা বলেন, মন্দা শেয়ারবাজরে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মনগড়া সিন্ধান্তে রয়েছে অটল। শেয়ার কারসাজিতে তাদের (বিএসইসির) স্বজন প্রীতির অভিযোগ আছে। সব মিলিয়ে শেয়ারবাজার দিন দিন মন্দায় তলিয়ে যাচ্ছে।
লেনদেন গতি কমা প্রসঙ্গে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাইফুর রহমান বলেন, সুনিদ্দিষ্ট কিছু কারনে শেয়াবাজার লেনদেন মন্দা চলছে। শেয়ারবাজারের উন্নয়ন স্বার্থে এইগুলো শিগগিরই দূর করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা জানিয়ে সাইফুর রহমান বলেন, দিন দিন শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগকারী কমছে। আবার অনেকে বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ না করে পর্যবেক্ষন করছে। ফলে পূর্বের চেয়ে লেনদেন গতি কমেছে।
বিশ্বে অর্থনীতির মন্দা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেই মন্দা প্রভাব আমাদের শেয়ারবাজারে পড়েছে। এছাড়া রেগুলেটরদের বেঁধে দেওয়া ফ্লোর প্রাইসও আমাদের মন্দা কারন হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই শিগগিরই ফ্লোর প্রাইস বন্ধ জরুরী জানিয়ে এমডি বলেন, আমরা এটি বন্ধের ব্যপারে বিএসইসিকে পরামর্শ সহ অনুরোধ করেছি। এ ব্যপারে গত মাসে লিখিত চিঠিও দিয়েছি। কিন্তু বিএসইসি তা কর্নপাত করছে না। তারা (বিএসইসি) বলছে, সময় হলে ফ্লোর প্রাইজ তুলে নিবে। কিন্তু কবে তুলবে, সেই বিযয়ে নেই দিক নির্দেশনা।
সময় হলে ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়ে বিএসইসি নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ফ্লোর প্রাইজের কারণে বর্তমানে লেনদেন কম হচ্ছে সত্যি। তবে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার কারণে ফ্লোর প্রাইজ দেওয়া হয়েছে। তাই শেয়ারবাজার ভাল হলে আমরা ফ্লোর প্লাইজ তুলে নিবো। একই প্রসঙ্গে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামও বলেন, শেয়ারবাজারে স্বার্থে ফ্লোর প্রাইজ দেওয়া হয়েছে। মন্দা কাটলে, এটা তুলে নেওয়া হবে।
সব খানেই কারসাজি হচ্ছে এমন মন্তব্যে করে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, গোটা বিশ্বে শেয়ারবাজারে কারসাজি হয়। সুতরাং কারসাজি একেবারে বন্ধ হবে, সেটা বলা যাবে না। কারণ কারসাজির এক পথ বন্ধ করলে, তারা নতুন নতুন পথে বের করে। নতুন পথে বিভিন্ন কৌশল তারা কারসাজি করে। তবে অটোমেশন হলে জালিয়াতি ও কারসাজি কমে আসবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
লেনদেন গতি নেই জানিয়ে লঙ্কাবাংলা সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী আবিদ হাসান বলেন, শেয়ারবাজারে মন্দায় বর্তমানে ২৮ শতাংশ পুঁজি নেই। সামনে শেয়ারবাজার আরও মন্দা হবে এমন আশঙ্কায়, ভয়ে যে যেভাবে পারছে শেয়ার বিক্রি করছে। বড় লোকসান থেকে বাঁচতে এ পথ বেছে নিচ্ছে। মন্দায় ৩০ শতাংশ পুঁজি হারিয়েছি জানিয়ে শাকিল রিজভী সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী কাউসার আহমেদ বলেন, সময়ে পালাক্রমে সেই ক্ষুয়ানোর বৃত্ত বড় হচ্ছে। আবার ফ্লোর প্রাইজে কারনে ধারন করা শেয়ারে নেই ক্রেতা। বিক্রি করতে চাইলেও ক্রেতা পাচ্ছি না।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলেন, ফ্লোর প্রাইজের কারনের বৃহস্পতিবারও ডিএসইতে বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার দর অপরিবর্তিত ছিল। বিক্রেতার চাপ বহুগুন বেশি ছিল। ডিএসইতে কোম্পানির শেয়ার দর উত্থানের তুলনায় পতন ২১ দশমিক ৪২ গুন বেশি। অপরদিকে সিএসইতেও কোম্পানির শেয়ার দর উত্থানের তুলনায় পতন ১১ দশমিক ২০ গুন বেশি।
আরও বলেন, সরকারের নতুন সময় সূচির প্রথম কার্যদিবস ডিএসইতে গত ২৪ আগস্ট পতন হয়েছিল। যা আগের টানা ছয় কার্যদিবস উত্থানের পর এই মন্দা। পতন পরের দুই কার্যদিবস (বৃহস্পতিবার ও রবিবার) উত্থানে ছিল পুঁজিবাজার। ওইসময় লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছিলো। পরের দিন সোমবার লেনদেনে ভাটা পড়ে। সেখান থেকে পরের দুই কার্যদিবস লেনদেন কিছুটা বাড়ে।
পরেরদিন লেনদেন আবারো কমে। এরপরের কার্যদিবস লেনদেন বেড়ে ২৩শ কোটি টাকায় ওঠেছিল। পরে জোয়ার-ভাটায় চলে পুঁজিবাজারের লেনদেন। গত ২০ সেপ্টেম্বর লেনদেন বছরের সেরা রেকর্ড করেছিলো। ওইদিন লেনদেন ২৮শ কোটি টাকা এসেছিলো। পরে ফের জোয়ার-ভাটায় পড়ে লেনদেন। এরই ধারায় বৃহস্পতিবারও ভাটা পড়ে লেনদেন। ফলে আগের কার্যদিবস থেকে কমে লেনদেন ২২২ কোটি টাকায় চলে এসেছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) সব ধরনের সূচক পতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। লেনদেন পরিমাণ কমেছে। লেনদেন ২শ কোটি টাকার ঘরে চলে এসেছে। এদিন ডিএসইতে ২২২ কোটি ৯৯ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। আগের কার্যদিবস বুধবার ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ২৫৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকার শেয়ার। এদিন ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৩ দশমিক ১৮ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২০৫ দশমিক ১১ পয়েন্টে। এছাড়া ডিএসই-৩০ সূচক দশমিক ৩৮ পয়েন্ট এবং ডিএসইএস সূচক ৩ দশমিক ৩৮ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ২ হাজার ২২১ দশমিক ৩৩ পয়েন্টে এবং ১ হাজার ৩৫৫ দশমিক ৮৫ পয়েন্টে। এদিন ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ৩১১টি কোম্পানির মধ্যে শেয়ার ও ইউনিটের দর বেড়েছে ৭টি এবং কমেছে ১৫০টির। শেয়ার পরিবর্তন হয়নি ১৫৪টির।
অপরদিকে, অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) বৃহস্পতিবার লেনদেন হয়েছে ৭ কোটি ১০ লাখ টাকা শেয়ার। আগের কার্যদিবস বুধবার ৪৬ কোটি ৯১ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল। এদিন সিএসইতে লেনদেন হওয়া ১১৮টি কোম্পানির মধ্যে শেয়ার ও ইউনিট দর বেড়েছে ৫টি, কমেছে ৫৬টি এবং পরিবর্তন হয়নি ৫৭টির। কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর উত্থানের চেয়ে পতন ১১ দশমিক ২০ গুন বেশি।
এদিন সিএসইর প্রধান সূচক সিএএসপিআই ২৫ দশমিক ৬৫ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩৩৪ দশমিক ৮৪ পয়েন্টে। এছাড়া সিএসই-৫০ সূচক দশমিক ১৭ পয়েন্ট, সিএসই-৩০ সূচক ৬ দশমিক ৯৭ পয়েন্ট, সিএসসিএক্স সূচক ১৫ দশমিক ৪১ পয়েন্ট এবং সিএসআই সূচক ২ দশমিক ৮১ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ৩২৫ দশমিক ৩৪ পয়েন্টে, ১৩ হাজার ২৯৮ দশমিক ২৩ পয়েন্টে, ১০ হাজার ৯৯০ দশমিক ১৭ পয়েন্টে এবং ১ হাজার ১৫৭ দশমিক ৪৫ পয়েন্টে।
বিজনেস আওয়ার/২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩/এমএজেড