করোনাভাইরাস মহামারী গোটা বিশ্বকে সঙ্কটে ফেলে দেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের রেমিটেন্সেও পড়েছে তার প্রভাব। গত মার্চ থেকে রেমিটেন্স কমে যাওয়া দেখে খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু ঈদের মাস মে’তে প্রথম ১৪ দিনেই ৮০ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে, যা পুরো এপ্রিল মাসের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক কাজী ছাইদুর রহমান বলেন, মহামারীর কারণে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সঙ্কট চলছে। আমরা ভেবেছিলাম রেমিটেন্সের পরিমাণ একেবারে তলানিতে নেমে আসবে। তবে তা হয়নি। প্রতিবারের মত এবারও ঈদে পরিবার-পরিজনের জন্য বেশি রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।
অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সত্যি কথা বলতে কি, আমরা ভেবেছিলাম রপ্তানি আয়ের মতো রেমিটেন্সও একেবারে তলনিতে নেমে আসবে। কিন্তু তা হয়নি।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশে থাকা কোটি বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ। জিডিপিতে এই রেমিটেন্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো।
প্রতি বছরই ঈদের আগে রেমিটেন্সে গতি আসে। গত বছরের রোজার ঈদের আগে মে মাসে ১৭৪ কোটি ৮২ লাখ ডলারের রেকর্ড রেমিটেন্স এসেছিল। প্রথম ১৪ দিনে এসেছিল ৮৭ কোটি ১০ লাখ ডলার।
এবার করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে অনেক প্রবাসী শ্রমিককে দেশে ফিরতে হওয়ায় এবং যারা রয়েছেন, তাদেরও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণে তেমন রেমিটেন্স আশা করা হচ্ছিল না। মার্চ থেকে বৈশ্বিক পরিস্থিতি ওলটপালট হয়ে যাওয়া ওই নিরাশার দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছিল। গত মার্চে ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের রেমিটেন্স এসেছিল, যা গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম।
পরের মাস এপ্রিলে রেমিটেন্স আরও কমে ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলারে আসে, তাও গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ কম। কিন্তু মে মাসে চিত্র পাল্টাতে থাকে। প্রথম ১১ দিনে ৫১ কোটি ২০ লাখ ডলার রেমিটেন্স আসে, ১৩ মে পর্যন্ত আসে ৬৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ১৪ মে তা ৮০ কোটি ডলারে গেল। ১৪ মে বৃহস্পতিবার একদিনেই আসে ১১ কোটি ২০ লাখ ডলার।
গত বছরের স্বাভাবিক মে মাসের প্রথম ১৮ দিনে যে পরিমাণ রেমিটেন্স এসেছিল, এই বছরের সেই সময়ে তা কমেনি। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে এক হাজার ৩৩০ কোটি ৩২ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছিল। চলতি অর্থবছরের ১৪ মে পর্যন্ত এসেছে ১ হাজার ৫৬৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
ঈদের পাশাপাশি রেমিটেন্সে ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনার শর্ত শিথিল করার প্রভাবও এতে পড়ছে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা ছাইদুর।
তিনি আরও বলেন, ঈদের আগে যেহেতু এক সপ্তাহের বেশি সময় হাতে আছে, সেহেতু রেমিটেন্স আরও বাড়বে। সব মিলিয়ে এপ্রিল মাসের চেয়ে মে মাসে বেশি রেমিটেন্স দেশে আসবে বলে আশা করছি।
তবে আহসান মনসুর বলেন, একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, এখন উপার্জন বা কাজের টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন না তারা (প্রবাসী)। জমানো টাকা যেটা ছিল সেখান থেকেই অথবা অন্য কারও কাছ থেকে ধার করে পরিবারের-পরিজনের বিপদের দিনে কিছু পাঠাচ্ছেন। সেটা ফুরিয়ে গেলে আর পাঠাতে পারবেন না।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এবারও রেমিটেন্স ২০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি নিয়েই অর্থবছর শেষ হত বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের রেমিটেন্সের বড় অংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। জ্বালানি তেলের দাম একেবারে কমে আসায় তেলনির্ভর অর্থনীতির ওই দেশগুলোতেও দেখা দিয়েছে বড় সঙ্কট। ফলে সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলোতে রেমিটেন্সের জন্য খুব ভালো খবর আসবে তার মনে হয় না। তবে এরপরও রেমিটেন্সে ১১/১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হবে বলে মনে করেন তিনি।
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল আরও বেশি; ১৭ দশমিক ৩২ শতাংশ।
বর্তমান রিজার্ভ ৩২.৮৪ বিলিয়ন ডলার
ঈদের আগে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ায় রপ্তানি আয় কমার পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে।
রোববার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ২৮৪ কোটি ৩৯ লাখ(৩২.৮৪ বিলিয়ন) ডলার।
তবে আমদানি ব্যয় কমার কারণে রিজার্ভ কমেনি বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহে রিজার্ভ ৩৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মাসের আমদানি বিল পরিশোধের পর তা কমে আসে।