মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান : মাথা উঁচু করে ঢাকার মাটিতে সন্মানের সাথে দাঁড়িয়ে আছে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস পিএলসি। সব ধরনের ঝুঁকি মোকাবেলা করে আধুনিক সেবা দিয়ে সেরা অবস্থান ধরে রাখবে এমনটিই দাবি করেছেন কোম্পানির সচিব মো. শরীফ হাসান। আরও বলেন, ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস বর্তমানে গুলশানে অবস্থিত দি ওয়েস্টিন ঢাকা দিয়ে ব্যবসা কার্যক্রম শুরু করে সুনামের সাথে পরিচালন করে আসছে ২০০৭ সাল থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন উত্তরায় সার্ভিস এ্যাপার্টমেন্ট হানসা। পরে চালু করা হয় বনানীতে অন্যতম বিলাসবহুল চেইন হোটেল শেরাটন ঢাকা। এই খাতের পাশাপাশি অবদান রাখতে চায় দেশের বিদ্যুৎ খাতে। পরিকল্পনা করছে গড়ে তুলবে সোনারগাঁও ইকনোমিক জোন।
ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি) এর ফেলো সদস্য মো. শরীফ হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স অফ বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন (এমবিএ) এবং ব্যাচেলর অব বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বিবিএ) ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্টার্ল ল কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করেন। ইউনিক হোটেল কোম্পানির সচিব হিসাবে ২০১৫ সালের শুরুর দিকে শরীফ হাসান যোগদান করেন। এখানে যোগদানের পূর্বে পূবালী ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের গুরুত্বপূর্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০১৯ সাল থেকে কাউন্সিল সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন এবং কর্পোরেট ল রিভিউ সাব কমিটির চেয়ারম্যান।
তার কর্মজীবনের যাত্রায় তিনি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে ব্যাংকিং ও ক্যাপিটাল মার্কেট, কর্পোরেট গভর্নেন্স, শ্রম আইন, আইএফআরএস, ক্যারিয়ার ম্যানেজমেন্ট প্রভূতি বিষয়ে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী কাজ নিয়ে নিজেকে জড়িত আছেন তিনি। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য। অন্য হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেডের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি।
সম্প্রতি বিজনেস আওয়ারের প্রতিনিধির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতে তিনি নানা বিষয়ে কথা বলেন। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান। সাক্ষাতের চৌম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
বিজনেস আওয়ার : ইউনিক হোটেল এ্যান্ড রিসোর্টসের সম্পর্কে বলুন?
মো. শরীফ হাসান : হোটেল সেবায় দেশের বেস্ট স্থানে রয়েছে ইউনিক হোটেল। এখানে আর্ন্তজাতিক মানের সব ধরনের সর্বোচ্চ সেবা পেয়ে থাকে গ্রাহক। দেশি বিদেশি রুচিশীল ও মানসম্মত গ্রাহক আমাদের। গ্রাহকদের নিরাপদ আবাস, স্বাস্থ্যসম্মত খাবারসহ ব্যবসায়ীক সভা ও সেমিনার করার সব ধরনের সুযোগ সুবিধা রয়েছে এখানে। ভোজন রসিকদের কথা চিন্তা করে রাখা হয়েছে পছন্দমতো বিভিন্ন দেশের জনপ্রিয় খাবার। এছাড়া রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক হল। এক কথায় আর্ন্তজাতিক মানের সব সেবায় আমাদের হোটেলে রয়েছে। ফলে দেশি বিদেশিদের কাছে পছন্দের সেরা তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ইউনিক হোটেল। ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস ২০১২ সালের ১৪ জুন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত হয়। এর আগে একই বছরের ৫ জুন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) তালিকাভুক্ত হয়।
বিজনেস আওয়ার : কোম্পানিটির হোটেলগুলোর প্রসঙ্গে যদি বলতেন?
মো. শরীফ হাসান : রাজধানীতে অভিজাত তিনটি হোটেলের মাধ্যমে গ্রাহকদের সেবা দিয়ে আসছে ইউনিক হোটেল। প্রথমটি হলো “গুলশানের দ্য ওয়েস্টিন ঢাকা”। দিত্বীয়টি উত্তরায় চালু হয় সার্ভিস এ্যাপার্টমেন্ট “হানসা”। তৃতীয়টি বনানীতে “শেরাটন ঢাকা”। সবগুলোই ফাইভ স্টারের সব ধরনের আধুনিক সুবিধা রয়েছে। দি ওয়েস্টিন ঢাকা আমাদের প্রথম হোটেল। অন্য হোটেল তুলনায় এটা গ্রাহকদের চাহিদার শীর্ষে রয়েছে। আবার উত্তরায় সার্ভিস এ্যাপার্টমেন্ট হানসা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। বিদেশিদের পছন্দের তালিকায় এটার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এছাড়া বনানীতে বেড়ে ওঠেছে শেরাটন ঢাকা। এটিও দাপটের সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। সবগুলোতেই সেবা ও মান বৃদ্ধিতে ইউনিক হোটেলের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীরা নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
বিজনেস আওয়ার : হোটেল ব্যবসার ঝুঁকি হিসেবে কি দেখছেন? ঝুঁকি মোকাবেলায় আপনাদের করনীয় বিষয়ে যদি বলতেন?
মো. শরীফ হাসান : ইউনিক হোটেল মূলত বিদেশি ব্যবসায়ী, বহুজাতীক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা, পর্যটকরা সেবা এবং দেশী বিদেশী সবাই রুচিসম্মত ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহন করে থাকেন। বিশ্বমানের উন্নত হোটেল সেবা পেতে এখানে আসে তারা। আমাদের কাছে আসা সেবা গ্রাহকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিয়ে থাকি। একই সঙ্গে তাদের পছন্দের খাবারের বিষয়টি আমরা বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাদের পছন্দের খাবারের জন্য আমাদের হোটেলগুলোতে বিভিন্ন দেশের জনপ্রিয় খাবার পরিবেশন করা হয়ে থাকে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থেকে আসা গ্রাহকরা সবার আগে আমাদের হোটেলগুলোতে রিজার্ভ করে। কিন্তু সমস্যা হয়, যখন দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। যেমন জঙ্গি তৎপরতা ও উত্থান, রাজনৈতিক বিশৃংঙ্খলা, দেশে বিভিন্ন ইস্যুতে হানাহানি ইত্যাদি। ধরুন হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা। এতে আমাদের হোটেল ব্যবসা ব্যপক ক্ষতি হয়েছিল। তখন আমাদের হোটেল ব্যবসার মন্দায় রুপ নিয়েছিল। কারন আমাদের বেশিরভাগ গ্রাহক বিদেশি। জঙ্গি হামলার কারনে সেই সময় বিদেশিরা আসতে অনিরাপদ মনে করেছিল আমাদের দেশে বিশেষ করে গুলশান এলাকার হোটেলগুলোতে। ফলে তাদের আনাগোনা একেবারেই কমে আসে। পরবর্তীতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীতে পূনরায় হসপিটালিটি ব্যবসা মন্দা অবস্থা দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক বিমান ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায় ও জনগনের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা লকডাউনের জন্য।
বিজনেস আওয়ার : করোনা মোকাবেলা করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, সেই বিষয়ে বলুন?
মো. শরীফ হাসান : করোনার (কোভিড ১৯) সময় সারাবিশ্ব তথা দেশের হোটেল ব্যবসায় মন্দাবস্থায় দেখা গিয়েছিলো। মন্দার প্রভাব ইউনিক হোটেলও পড়েছিল। সেই সময় আমাদের গ্রাহক অপ্রত্যাশিতভাবে কমেছিল। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ পর্যটকদের অবাধ চলাচলে নিষেধ থাকায় হোটেলগুলো গ্রাহক শূন্যতে চলে আসে। সময়ে পালাক্রমে বিশ্বজুড়ে করোনা পরিস্থিতি উন্নতির সাথে সাথে সেই অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং আমাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) নূর আলী স্যারের দক্ষতায়। ইউনিক হোটেল তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, ডায়নামিক দিক নির্দেশনা ও নিরলস চেষ্টায় আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আমরা গ্রাহকদের নিশ্চিত করেছি, আমাদের হোটেলগুলোর রুম ও খাবার সর্ম্পূণ স্বাস্থ্য সম্মত ও নিরাপদ। রয়েছে করোনা প্রতিরোধের সকল ব্যবস্থা। জীবানুমুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশের মাধ্যমে এখন আমাদের সবগুলো হোটেল বেশ ভালভাবে চলেছে এবং আমাদের হোটেলগুলো নাম্বার ওয়ান সেবা দিচ্ছে। বেস্ট সেবার মাধ্যমে দেশের মানও বৃদ্ধি করেছে।
বিজনেস আওয়ার : ইউনিক হোটেলের মুনাফা ও ব্যবসার পরিধি বাড়াতে ভবিয্যত কর্ম পরিকল্পনা?
মো. শরীফ হাসান : করোনার আগে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) আমাদের মুনাফা ছিল ৫৯ কোটি টাকা। সেই সময় শেয়ার প্রতি মুনাফা (ইপিএস) ছিল ২ দশমিক ৩০ টাকা। সেই মুনাফা ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ২৮ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। কারন ২০১৯ সাথে শেষদিকে করোনার ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। পরবর্তীতে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৪১ কোটি টাকায় ফিরে। ওইসময় ইপিএস দাঁড়িয়েছিল ১ দশমিক ৪১ টাকা। কিন্তু সর্বশেষ ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ইপিএস দাঁড়ায় ৩ দশমিক ২০ টাকা। মুনাফা কমা বৃত্ত থেকে এখন বেরিয়ে এসেছি। দিনদিন আমাদের ব্যবসার পরিধি বাড়ছে। আমাদের ব্যবসায় যোগ হয়েছে হানসা ও শেরাটন ঢাকা। দ্য ওয়েস্টিন ঢাকা আমাদের পুরানো লাভবান হোটেল। সব মিলিয়ে আমাদের মুনাফার বৃত্ত এখন অনেক বড়। বেড়েছে সেবার মান। সমান তালে বেড়েছে জনবল। বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে আপনারা জেনে থাকবেন যে যৌথ উদ্যোগে আমাদের আরো নতুন দুই প্রজেক্ট হাতে চলমান। মেঘনাঘাট পাওয়ার ও সোনারগাঁও ইকনোমিক জোন। ইতিমধ্যে কোয়াকাটায় জমি কেনা হয়েছে। ঢাকা শহরে ও শহরের বাহিরে নতুন চেইন হোটেল করা ও ব্যবসা সম্প্রসারনের পরিকল্পনা রয়েছে কোম্পানীর।
বিজনেস আওয়ার : শেয়ার দর সম্পদ মূল্যের নিচে অবস্থান করছে, এটাকে কিভাবে দেখছেন?
মো. শরীফ হাসান : দেখুন পাবলিক লিস্টেড কোম্পানীর শেয়ার দর নির্ধারিত হয় বিনিয়োগকারী তথা শেয়ারহোল্ডারদের মাধ্যমে। ২০১০ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারন সূচক ছিলো সাড়ে ৮ হাজার পয়েন্টের ওপরে। বর্তমানে সেই সূচক ৬ হাজার ২০০ পয়েন্টের মতো। ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল তথা এক যুগেরও বেশি সময়ে অনেক নতুন নতুন ইস্যু শেয়ারবাজারে নিবন্ধিত হয়েছে। এসময় সাধারন সূচক কমেছে ২ হাজার ৩০০ পয়েন্টের মতো। যেখানে নতুন ইস্যু আসার কারনে সূচক বৃদ্ধির কথা, কিন্তু সেখানে উল্টো সূচক কমেছে। আমরা যদি ২০১০ সালের শেয়ার মূল্যের সাথে তুলনা করি, তাহলে শেয়ারবাজারের মূল্য এক-তৃতীয়াংশে থাকার কথা ছিল, তাহলে আপনি কিভাবে বলবেন যে, ইউনিক হোটেলের শেয়ার দর কম? আসলে শেয়ার দর কম বা বেশি এটা কোম্পানি নির্ধারন করে না। এটি নির্ধারিত হয় বাজারের চাহিদা জোগানের ভারসাম্যের উপর। কোন পার্টিকুলার শেয়ার দর নির্ধারিত হয় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সিন্ধান্তের মাধ্যমে। বর্তমানে শেয়ার দর পড়ার অন্যতম কারন বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ প্রবনতা কমে যাওয়া। ইউনিক হোটেল এ ক্যাটাগরির একটি ব্লু চিপ শেয়ার। যা স্টক এক্সচেঞ্জে যুক্ত হওয়া থেকে ভালোহারে নগদ লভ্যাংশ প্রদান করে আসছে। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে কোম্পানিটি সুশাসন, সততা, জবাবদিহিতা এবং আইন কানুন সঠিক ও যথাসময়ে পরিপালন করে আসছে। এই কোম্পানি ভবিয্যতে আরো ভালো করবে। পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডারদের অধিক রিটার্ন দিতে পারবে।
বিজনেস আওয়ার/৪ মে, ২০২৩/এমএজেড