মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান : সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিতে অনেকেই ই-টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) করেছেন। এসব ই-টিআইএন ধারীদের অধিকাংশই নিয়মিত আয়কর রির্টান দাখিল করছেন না। তাদের ধরতে এবার পাঠে নেমেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরই ধারায় এনবিআর নতুন নিয়ম চালু করতে যাচ্ছে। তা হলো- করযোগ্য আয় না থাকলেও আগামী অর্থবছর থেকে রাজস্ব দিতে হবে। রিটার্ন জমার স্লিপ বা প্রাপ্তি স্বীকারপত্র পেতে শূন্য আয়ের ব্যক্তিদেরও গুনতে হবে দুই হাজার টাকা।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, প্রতি অর্থবছরেই এনবিআর আয়করের ঘাটতি টানছে। নানা পরিকল্পনার পরও কোন ভাবেই কাঙ্খিত কর আহরন করতে পাচ্ছে না। তাই কাঙ্খিত কর আহরন লক্ষে শূন্য আয়কর রিটার্ন জমাকারীদের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা আহরন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা আগামী অর্থবছর থেকে কার্যকর হতে পারে।
আয়কর রিটার্ন জমা প্রসঙ্গে এনবিআরের একাধিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, রাজস্ব অফিস থেকে রিটার্ন জমার স্লিপ না নিলে আগামী অর্থবছর থেকে ৩৮ ধরনের সরকারি-বেসরকারি সেবা পাওয়া যাবে না, এমন নিয়ম হতে যাচ্ছে। আবার যাদের ই-টিআইএন রয়েছে কিন্তু রির্টার্ন জমা দিবে না, আগামীতে তাদের জন্য দুসংবাদও রয়েছে। সেটা হলো, রিটার্ন জমা না দিলে ই-টিআইএন বাতিল হয়ে যাবে, এমন নিয়মও হতে যাচ্ছে।
তারা আরও বলেন, বর্তমানে ৮৬ লাখ ই-টিআইএনধারী রয়েছে। এর মধ্যে নিয়মিত রিটার্ন জমা দেয় প্রায় ২৮ লাখ করদাতা। বাকি করদাতারা রিটার্ন কেন দিচ্ছে না, সেটার আলোচনা চলছে। তাই প্রকৃত করদাতাদের চিহ্নিত করতে বেশকিছু নিয়মনীতি করতে যাচ্ছে এনবিআর।
সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, শূন্য রিটার্ন জমাতে দুই হাজার টাকা আহরনে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হতে পারে। সরকারি-বেসরকারি সেবা পেতে যারা স্লিপের জন্য রিটার্ন জমা দেবেন, তারা নিশ্চয় সাধারণ মানুষ। দুই হাজার টাকা কর দিতে গিয়ে তাদের পাঁচ হাজার টাকার হয়রানি হতে পারে। এই নিয়ম চালু করার আগে কর ব্যবস্থার সম্পূর্ন অটোমেশন গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে করদাতার জন্য রিটার্ন ফরম আরো সহজ করা জরুরী।
বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতার ক্ষেত্রে পুরুষ করদাতার বার্ষিক আয় তিন লাখ টাকা, মহিলা বা ৬৫ বছরের বেশি পুরুষ করদাতার ক্ষেত্রে সাড়ে তিন লাখ টাকা, প্রতিবন্ধী করদাতার ক্ষেত্রে সাড়ে চার লাখ টাকা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার বার্ষিক আয় চার লাখ ৭৫ হাজার টাকা আয়করমুক্ত। এই সীমার নিচে আয় থাকলে করদাতা এতোদিন শূন্য আয় দেখিয়ে রিটার্ন জমা দিতে পারতেন। এক্ষেত্রে কোনো অর্থ (কর) গুনতে হয়নি।
কিন্তু নতুন নিয়মে, আগামীতে রিটার্ন জমার স্লিপ বা প্রাপ্তি স্বীকারপত্র পেতে শূন্য আয়ের ব্যক্তিদের দুই হাজার টাকা দিতে হবে। এছাড়া ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত আয়করদাতার ন্যূনতম করের হার পাঁচ হাজার টাকা। অন্যদিকে ব্যক্তিশ্রেণি করদাতাদের নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করলে নির্ধারিত হারে আয়কর দিতে হবে। সিটি করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত করদাতার ন্যূনতম করের হার চার হাজার টাকা। সিটি করপোরেশন ছাড়া অন্যান্য এলাকায় অবস্থিত করদাতার ন্যূনতম করের হার তিন হাজার টাকা। আগামী বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের এই প্রস্তাব দেওয়ার কথা শুনা যাচ্ছে।
বর্তমানে ৩৮টি সরকারি-বেসরকারি সেবা পেতে রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক। এইগুলো হচ্ছে- ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পাঁচ লাখ টাকা বেশি ঋণ নিলে, কোম্পানি পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার হলে, আমদানি-রপ্তানি নিবন্ধন সনদ (আইআরসি-ইআরসি) নিতে, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে, সমবায় সমিতি নিবন্ধন নিতে, বিমা কোম্পানির সার্ভেয়ার হতে, ১০ লাখ টাকা বেশি মূল্যের জমি-ফ্ল্যাটের দলিল করতে, ক্রেডিট কার্ড নিতে, পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যপদ নিতে, ড্রাগ লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র, বিএসটিআই লাইসেন্স ও ছাড়পত্র পেতে, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ছেলে-মেয়েদের ভর্তি করতে, কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটরশিপ নিতে, অস্ত্রের লাইসেন্স নিতে, ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে, ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে, নির্বাচনে অংশ নিতে, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ১৬ হাজার টাকা হলে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ১৬ হাজার টাকার বেশি বেতন পেলে, পণ্য আমদানি-রপ্তানির বিল অফ এন্ট্রি জমা দিতে রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক। আগামী অর্থবছরে এসব সেবার সাথে আরো নতুন বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা যুক্ত হবে। এসব সেবা পেতে আগামীতে ই-টিআইএন ধারীদের অবশ্য রিটার্ন জমার স্লিপ গ্রহন করতে হবে।
রিটার্ন জমার স্লিপ বা প্রাপ্তি স্বীকারপত্র পেতে শূন্য আয়ের ব্যক্তিদেরও অর্থ গুনতে হবে এই বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, আমিও শুনেছি। কিন্তু শুনেই কিছু বলা যাবে না। ভাল-মন্দ কোন ধরনের মন্তব্যও করা যাবে না। তবে এটা বলতে পারি, সরকার রাজস্ব বাড়ানো চেষ্টা করছে। কোন নিয়মে রাজস্ব আহরন বাড়াবে, এটা নিয়ম মেনেই করবে সরকার। তবে করযোগ্য আয় থাকা সত্ত্বেও অনেকে রিটার্ন জমা দিচ্ছে না। তাদের করজালে আনতে এই উদ্যোগ যথাযথ বলে মনে করছি।
আয়কর যোগ্যদের কর প্রদানের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, করের অর্থ দেশের কাজে ব্যয় হয়। তাই আমাদের করযোগ্যদের কর প্রদানে উৎসাহ দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, কর আহরন করতে যেন সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার না হয়।
বিজনেস আওয়ার/২৩ মে, ২০২৩/এমএজেড