মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ারবাজারের হরের রকম তথ্য আদান প্রদান হচ্ছে। এতে শেয়ারবাজারে কোন কোম্পানির শেয়ার বাড়বে বা কমবে তা খুব সহজেই জানা যাচ্ছে। এছাড়া একে অপরের শেয়ার বিক্রি করে অর্থ লুটসহ শেয়ারবাজারের রেগুলেটরদের অজানা তথ্য প্রতিনিয়ত আসছে। কার কতো সম্পদের পাহার- এমন তথ্য ঘুরপাক করছে ফেইসবুকে। একটি মহলের এসব এলোমেলো তথ্যে নেমে এসেছে শেয়ারবাজার অস্থিরতা। হারাচ্ছে শেয়ারাবাজারের ভারসাম্য। তাই বিনিয়োগকারীদেরকে এসব তথ্য থেকে নিরাপদে থাকতে বললেন বিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া ৯০ শতাংশ তথ্য ভিত্তিহীন বলে বেরিয়ে এসেছে। অনুসন্ধানে, এসব তথ্যে কান দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন নিরীহ বিনিয়োগকারীরা। মান সন্মান হারাচ্ছেন শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রকরা। ছাড় পাচ্ছে না প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও। অবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে সিকিউরিটিজ হাউজ প্রতি। এসব ভিত্তিহীন তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করছে একটি মহল। এই মহলটির হোতারা শেয়ারাবাজারের সংশ্লিষ্ট কাজে নিযুক্ত রয়েছে। মানে বিএসইসি, স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে শুরু করে বিনিয়োগকারী পর্ষন্ত তাদের লোকজন রয়েছে। তাদের হাত শক্ত। মহলটির স্বার্থে যেকোন সময় শেয়াবাজারে বানোয়াট তথ্য ছড়িয়ে খেলছে। আর এই খেলার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে তারা ফেইসবুককে বেছে নিয়েছে। ফলে এদের কারণে গতিহীন দেশের শেয়ারবাজার।
গত কয়েকটি ভূল ইস্যুকে কেন্দ্র করে শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক ভারসাম্য হারাচ্ছে জানিয়ে বিএসইসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এর মধ্যে একটি হলো ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ওয়েবসাইট হ্যাকড। আরেকটি হলো বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান পদ থেকে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের পদত্যাগের তথ্য। এরও আগে ঢাকা স্টক একচেঞ্জে ওয়েবসাইটের প্রযুক্তিগত ক্রটি। রয়েছে একে অপরের শেয়ার লুট করার মতো ঘটনা। এসব ছড়িয়ে যাচ্ছে ফেসবুকে। এতে শেয়ারবাজার মন্দার কবলে পড়েছে। ফলে হাজার কোটি টাকার লেনদেন বর্তমানে তিনশ কোটি টাকার ঘরে চলে এসেছে। কমেছে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার দরসহ সূচক।
নিজের পদত্যাগ বিষয়ে বিজনেস আওয়ারকে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, এটা সম্পূর্ণ গুজব। আরও বলেন, গত বুধবার দুপুরে আমি জার্মান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করছি, ঠিক তখনি আমাকে ফোন করে কয়েকজন বলে, আপনি নাকি পদত্যাগ করছেন? আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি পদত্যাগ করছি। আমি জানি না। স্বার্থবাদী মহল পদত্যাগ বানোয়াট তথ্যটি ছড়িয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, একটি মহল আছে, যারা শেয়ারবাজারের ভালো চায় না। নিজেদের স্বার্থে ফেইসবুকে এসব ভূল তথ্য প্রচার করে। এদের কাছ থেকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
অপরদিকে আইসিবি অফিসিয়াল ওয়েবসাইট হ্যাকড প্রসঙ্গে বিজনেস আওয়ারকে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল হোসেন বলেন, আমাদের ওয়েবসাইট হ্যাকড হয়নি। কোন ঝামেলা নেই। আমাদের কর্মকর্তারা প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিকভাবেই ঢুকছে, তাদের কাজ করছেন। এতে ভয় পাবার কোন কারন নেই। বিনিয়োগ তথ্য নিরাপদে রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ওয়েবসাইটে প্রবেশ ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রত্যেকের পরিচয় চেক করা হচ্ছে। যাচাই বাছায়ের পর প্রবেশ অনুমতি মিলছে। এই কারনে ওয়েবসাইটের কাজ ধীরগতি।
এদিকে ৬ আগস্ট ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লেনদেন শেষদিকে প্রযুক্তিগত ত্রুটি (ওএমএস বা অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) দেখা দিয়েছিল। এরপর ডিএসইর সংশ্লিষ্ট টিমের নিরলস চেষ্টায় ভোর রাতেই (সাড়ে ৩টা) সেই ত্রুটির সমাধান করে। ফলে পরেরদিনে লেনদেনে বিনিয়োগকারীদের কোন বাধার মুখে পড়েনি, এমনটি জানালেন ডিএসইর কর্তৃপক্ষ। তবে কোন কারনে প্রযুক্তিগত ত্রুটি হলো এবং পরবর্তীতে কোন জটিলতা হবে কি না- সেইসব বিষয়েও মুখ খুলেননি ডিএসই। ফলে এখনও বিনিয়োগকারীরা ত্রুটি জটিলতা নিয়ে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে। এছাড়া ফাস্ট ক্যাপিটাল সিকিউরিটিজ হাউজের বিনিয়োগকারী উম্মে হাবিবার শেয়ার বিক্রি করে কোটি টাকার ওপরে লুট করেছে একটি চক্র। অবশ্য এবিষয়ে একে অপরকে দোষারোপ করছেন তারা।
এসব তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে প্রচার হচ্ছে জানিয়ে বিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা বলেন, আমাদের শেয়ারবাজার চলছে তারল্য সঙ্কট সহ ব্যাংকগুলোর খরা অবস্থা। এগুলো সবাই জানে। দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের সাথে শেয়ারবাজার তাল মিলিয়ে চলছে না। সবার নিরলস পরিশ্রমে অর্থনীতি সামনে দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই তুলনায় শেয়ারবাজার অনেক পিছিয়ে, এটা সত্যি। কিন্তু ফেইসবুকে অর্থনীতি ও শেয়ারবাজার এমনভাবে প্রচার হচ্ছে, যা খুবই নেগেটিভ অর্থে। এতে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ক্ষেত্রে ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা মোটেও কাম্য না।
আবার অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইবার আক্রমন, শেয়ার কারসাজি, জালিয়াতি করে অর্থ উত্তোলন, কৃত্রিমভাবে শেয়ারবাজারকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা, অনিয়মতান্ত্রিক ফ্লোর প্রাইস আরোপ, শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, শীর্ষ ব্যবসায়ীর উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও সম্পদ জব্দ ইত্যাদি। এসব তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব তথ্য বানোয়াট, অবশ্য এসব তথ্যের যোক্তিক ব্যাখা দিচ্ছে না রেগুলেটরা। এসব কারনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ। রেগুলেটরা পরিস্কার না করায় বাড়িয়ে দিয়েছে গুজব।
অবশ্য গুজবে কান দেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার ভূমিকা রয়েছে জানিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, পরিস্থিতি যদি হয় অনিশ্চিত, মনের মধ্যে উদ্বেগ কাজ করে, সঠিক সত্য পাওয়া থেকে মানুষ বঞ্চিত থাকে তখনই গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা বলছেন, আমাদের শেয়ারবাজারে এক অনিশ্চিত ভবিয্যৎ পাড় করছে । আরও বলছেন, হাতাশায় থাকলে বিনিয়োগকারীরা গুজবে কান দিবে, এটাই স্বাভাবিক। গুজব প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, গুজবের কারণে শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। তাই গুজব বন্ধ করে পুঁজিবাজারকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট আইন শক্তিশালী করা হবে।
সিকিউরিটিজ হাউজ কর্মকর্তাদের মতে, ভিত্তিহীন তথ্যে কান দেওয়ার কারণেই বাজারে কাঙ্খিত স্বাভাবিক গতির ধারা আসছে না। এদিক কান কথায় বিনিয়োগ রোধ এড়াতে বিনিয়োগকারীদের জন্য ডিএসই ‘হেল্প ডেক্স’ থাকলেও তা তাদের কোন মঙ্গল বয়ে আনছে না এমনও অভিযোগ করেছে। তাদের মতে, কান কথায় বাজার লেনদেনে এক ধরনের অস্বাভাবিক আচরন থাকে। এতো বেশি যে এ বিযয়ে অভিযোগ রেগুলেটরাও কেউ মাথা ঘামায় না। অবশ্য হেল্প ডেক্স প্রসঙ্গে ডিএসইর কর্তৃপক্ষের রয়েছে উল্টো সুর। তারা বলছে, সব ধরনের সেবা দিচ্ছে হেল্প ডেক্স। কোন সমস্যা হলে অতি দ্রুততার সাথে সমাধা করা হচ্ছে। কিন্তু বিনিয়োগকারী বলছে, এসব মুখস্ত কথা। বাস্তবে কথার সাথে কাজে মিল নেই ডিএসইর।
হাউজ কর্মকর্তারা আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএসইসির একটি পেইজ আছে। সেই পেইজ থেকে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তথ্য দেওয়া হয়। এর বাইরে অন্য গ্রুপ বা পেইজে যেসব তথ্য দেওয়া হয়, সেগুলো বিভ্রান্তিকর, গুজব। কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন তথ্য ডিএসইর ওয়েবসাইটে থাকে। আর ফেসবুক গ্রুপ পেইজে ঘুরিয়ে পেঁছিয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রচার করা হয়। ইতিমধ্যে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে মামলা এবং গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের আরো সতর্ক হওয়া উচিৎ। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নজরদারি আরও বৃদ্ধি করা।
এবিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম সাইফুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডিএসইর নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন তথ্য প্রচার করলেও আমরা বিষয়টি সেভাবে ভেবে দেখিনি। তবে আপনি যেসব বিষয়ে অবগত করেছেন, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট যে কোন তথ্য আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে থাকি। ডিএসইর ফেসবুক পেইজ থাকলেও সেটি অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। অন্যকোন গ্রুপ বা পেইজকে তথ্য সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আমরা এখন বিষয়টি দেখবো।
একই বিষয়েবিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বিএসইসি সবসময় কঠোর অবস্থানে রয়েছে। সম্প্রতি কমিশনের দায়ের করা মামলায় একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম ডিভিশন। বিএসইসি সবসময়ই সোশ্যাল মিডিয়া পর্যবেক্ষণ করছে। ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে, কমিশন প্রয়োজনে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনবে।
বিজনেস আওয়ার/২০ আগস্ট, ২০২৩/এমএজেড