ঢাকা , মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পীরের নির্দেশে ৫৪ বছর ধরে ভোট দেন না ইউনিয়নের নারীরা

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নে দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে ভোট দেন না নারীরা। ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক প্রথার কারণে এই ইউনিয়নের নারী ভোটাররা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত রয়েছেন।

চাঁদপুর-৪ আসনের অন্তর্ভুক্ত ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১৬ নম্বর রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নে মোট ভোটার সংখ্যা ২১ হাজার ৬৯৫ জন। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক নারী ভোটার।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৯ সালে ভারতের জৈনপুর থেকে আগত পীর মওদুদল হাসান কলেরা মহামারির সময় নারীদের পর্দা মানা ও ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেসময় এই নির্দেশ মানার ফলে মহামারি থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে- এমন বিশ্বাস থেকেই হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব ধর্মের নারীরা আজও ভোট দেওয়া থেকে বিরত রয়েছেন।

যদিও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রতিবছর সচেতনতামূলক সভা-সমাবেশ ও প্রচার চালানো হয়, কিন্তু নারীদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে তারা প্রয়োগ করছেন না তাদের এই সাংবিধানিক অধিকার।

স্থানীয়ভাবে দেখা যায়, ভোট না দিলেও নারীরা নিয়মিত বাজার, মার্কেটসহ দৈনন্দিন নানা কাজে বাইরে যাচ্ছেন। শিক্ষাসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করছেন সমানভাবে। কিন্তু ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে এখনো এক ধরনের ভীতি ও প্রথাগত বাধা কাজ করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই দীর্ঘদিনের প্রথা ভাঙতে উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন ও ইউনিয়ন পরিষদ। নারীদের ভোটকেন্দ্রে আনতে আলাদা সচেতনতামূলক কার্যক্রম, স্থানীয় প্রতিনিধি ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা এবং নিরাপত্তা জোরদারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। দীর্ঘদিনের এই সামাজিক বাস্তবতা বদলে নারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যাবে কি না সেদিকেই এখন তাকিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা।

নারী ভোটার রুজিনা আক্তার বলেন, আমাদের পরিবারের কোনো নারী কখনো ভোট দেয় না। কারণ হুজুর বলে গেছেন ভোট না দিতে, তাই আমরা তার আদেশ মানছি। হুজুর ছিলেন সত্যি এবং সত্যবাদী। ভবিষ্যতে যদি মানুষের মন পরিবর্তন হয়, তাহলে নারীরা ভোট দিতেও পারে। এখন যার ইচ্ছে সে ভোট দিবে, যার ইচ্ছে হবে না সে ভোট দিবে না।

১৬ নম্বর রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদে আসা আফরোজা বলেন, আমার বয়স অনুযায়ী আমাদের গ্রামের কোনো নারী ভোটকেন্দ্রে যায় না। জৈনপুর হুজুরের কথা সবাই মানে। বাজার মার্কেটে আসতে কোনো বাধা নেই। কারণ হুজুর এসবের জন্য নিষেধ করেননি।

স্থানীয় ভোটার রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নে স্থানীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচনে নারীরা ভোট প্রদান করে না। তবে বিগত বছরগুলোতে দলীয় কিছু নারী নেতাকর্মী ভোট কেন্দ্রে আসেন। আবার অনেকে ভোটকেন্দ্রে এলেও ভোট প্রয়োগ করে না। ভোটের আগে প্রশাসন থেকে এখানে সচেতনতামূলক সভাও হয়, কিন্তু ফলাফল তেমন পাওয়া যায় না।

রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মহসিন হাসান বলেন, নারী ভোটারদের উপস্থিতি বাড়াতে বেশ কয়েকবার স্কুল-কলেজসহ বাড়ি বাড়ি উঠান বৈঠক করেছি। তবে আগের তুলনায় নারী ভোটাররা সচেতন হচ্ছে। আমরা আশা করি নারী ভোটাররা ভবিষ্যতে সচেতন হবে এবং ভোট দিবে।

চাঁদপুর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান খলিফা বলেন, আমি এখানে যোগদানের পরই জানতে পারি, রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নের নারী ভোটাররা ভোট দেন না। অতীতে কয়েকবার তাদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসার চেষ্টা করেও ফলপ্রসূ হয়নি। আমাদের এখনো চেষ্টা রয়েছে নারী ভোটারদের উপস্থিতি বাড়ানোর। বিশেষ করে প্রার্থীদের মাধ্যমে হলেও নারীদের কেন্দ্রমুখী করা এবং ভোট প্রদানে উদ্বুদ্ধ করার। যাতে নারীরা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।

জেলা রিটানিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মো. নাজমুল ইসলাম সরকার বলেন, আমি চাঁদপুরে আসার পর আপনার (প্রতিবেদক) মাধ্যমেই বিষয়টি অবগত হয়েছি। বিষয়টি জানার পর আমি বেশ অবাক হয়েছি এবং আমার মাঝে আগ্রহ জেগেছে তাদের নিয়ে কাজ করার। যত দ্রুত সম্ভব আমি ওই ইউনিয়নে যাব এবং নারীদের সঙ্গে কথা বলবো। ভোট গণতান্ত্রিক অধিকার। আমাদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে নারীদের সচেতন করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা।

বিজনেস আওয়ার/ ৩০ ডিসেম্বর / মাহাদি

ট্যাগস

পীরের নির্দেশে ৫৪ বছর ধরে ভোট দেন না ইউনিয়নের নারীরা

আপডেট সময় ২ ঘন্টা আগে

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নে দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে ভোট দেন না নারীরা। ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক প্রথার কারণে এই ইউনিয়নের নারী ভোটাররা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত রয়েছেন।

চাঁদপুর-৪ আসনের অন্তর্ভুক্ত ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১৬ নম্বর রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নে মোট ভোটার সংখ্যা ২১ হাজার ৬৯৫ জন। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক নারী ভোটার।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৯ সালে ভারতের জৈনপুর থেকে আগত পীর মওদুদল হাসান কলেরা মহামারির সময় নারীদের পর্দা মানা ও ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেসময় এই নির্দেশ মানার ফলে মহামারি থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে- এমন বিশ্বাস থেকেই হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব ধর্মের নারীরা আজও ভোট দেওয়া থেকে বিরত রয়েছেন।

যদিও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রতিবছর সচেতনতামূলক সভা-সমাবেশ ও প্রচার চালানো হয়, কিন্তু নারীদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে তারা প্রয়োগ করছেন না তাদের এই সাংবিধানিক অধিকার।

স্থানীয়ভাবে দেখা যায়, ভোট না দিলেও নারীরা নিয়মিত বাজার, মার্কেটসহ দৈনন্দিন নানা কাজে বাইরে যাচ্ছেন। শিক্ষাসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করছেন সমানভাবে। কিন্তু ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে এখনো এক ধরনের ভীতি ও প্রথাগত বাধা কাজ করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই দীর্ঘদিনের প্রথা ভাঙতে উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন ও ইউনিয়ন পরিষদ। নারীদের ভোটকেন্দ্রে আনতে আলাদা সচেতনতামূলক কার্যক্রম, স্থানীয় প্রতিনিধি ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা এবং নিরাপত্তা জোরদারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। দীর্ঘদিনের এই সামাজিক বাস্তবতা বদলে নারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যাবে কি না সেদিকেই এখন তাকিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা।

নারী ভোটার রুজিনা আক্তার বলেন, আমাদের পরিবারের কোনো নারী কখনো ভোট দেয় না। কারণ হুজুর বলে গেছেন ভোট না দিতে, তাই আমরা তার আদেশ মানছি। হুজুর ছিলেন সত্যি এবং সত্যবাদী। ভবিষ্যতে যদি মানুষের মন পরিবর্তন হয়, তাহলে নারীরা ভোট দিতেও পারে। এখন যার ইচ্ছে সে ভোট দিবে, যার ইচ্ছে হবে না সে ভোট দিবে না।

১৬ নম্বর রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদে আসা আফরোজা বলেন, আমার বয়স অনুযায়ী আমাদের গ্রামের কোনো নারী ভোটকেন্দ্রে যায় না। জৈনপুর হুজুরের কথা সবাই মানে। বাজার মার্কেটে আসতে কোনো বাধা নেই। কারণ হুজুর এসবের জন্য নিষেধ করেননি।

স্থানীয় ভোটার রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নে স্থানীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচনে নারীরা ভোট প্রদান করে না। তবে বিগত বছরগুলোতে দলীয় কিছু নারী নেতাকর্মী ভোট কেন্দ্রে আসেন। আবার অনেকে ভোটকেন্দ্রে এলেও ভোট প্রয়োগ করে না। ভোটের আগে প্রশাসন থেকে এখানে সচেতনতামূলক সভাও হয়, কিন্তু ফলাফল তেমন পাওয়া যায় না।

রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মহসিন হাসান বলেন, নারী ভোটারদের উপস্থিতি বাড়াতে বেশ কয়েকবার স্কুল-কলেজসহ বাড়ি বাড়ি উঠান বৈঠক করেছি। তবে আগের তুলনায় নারী ভোটাররা সচেতন হচ্ছে। আমরা আশা করি নারী ভোটাররা ভবিষ্যতে সচেতন হবে এবং ভোট দিবে।

চাঁদপুর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান খলিফা বলেন, আমি এখানে যোগদানের পরই জানতে পারি, রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নের নারী ভোটাররা ভোট দেন না। অতীতে কয়েকবার তাদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসার চেষ্টা করেও ফলপ্রসূ হয়নি। আমাদের এখনো চেষ্টা রয়েছে নারী ভোটারদের উপস্থিতি বাড়ানোর। বিশেষ করে প্রার্থীদের মাধ্যমে হলেও নারীদের কেন্দ্রমুখী করা এবং ভোট প্রদানে উদ্বুদ্ধ করার। যাতে নারীরা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।

জেলা রিটানিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মো. নাজমুল ইসলাম সরকার বলেন, আমি চাঁদপুরে আসার পর আপনার (প্রতিবেদক) মাধ্যমেই বিষয়টি অবগত হয়েছি। বিষয়টি জানার পর আমি বেশ অবাক হয়েছি এবং আমার মাঝে আগ্রহ জেগেছে তাদের নিয়ে কাজ করার। যত দ্রুত সম্ভব আমি ওই ইউনিয়নে যাব এবং নারীদের সঙ্গে কথা বলবো। ভোট গণতান্ত্রিক অধিকার। আমাদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে নারীদের সচেতন করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা।

বিজনেস আওয়ার/ ৩০ ডিসেম্বর / মাহাদি