বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক: শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সকে আগামী ৩ বছরে গ্রাহকদের বীমা দাবি পরিশোধ করতে হবে ৫ হাজার ৪৬৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। বিপরীতে কোম্পানিটির সম্পদ রয়েছে ১ হাজার ৯২৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানির সব সম্পদ বিক্রি করলেও মেয়াদ উত্তীর্ণ বীমা দাবির বাকী ৩ হাজার ৬৮০ কোটি ১৫ লাখ টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।
আবার সব সম্পদ বিক্রিও নতুন করে যে প্রিমিয়াম আসছে তা দিয়ে গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করা হলে নতুন গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধ নিয়েও তৈরি হবে আরেক অনিশ্চয়তা। এমতাবস্থায় নতুন পুরাতন সব গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধ নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। এরইমধ্যে মেয়াদ শেষের পাওনা টাকা আদায়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন গ্রাহকরা। যার প্রভাবে দেশের বীমা খাতে গ্রাহকের অনাস্থা দূর করার সকল উদ্যোগই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের ২০২২ ও ২০২৩ সালের বীমা দাবি পরিশোধ, লাইফ ফান্ডের পরিমাণ ও আয়-ব্যয় বাদ দিয়ে উদ্বৃত্তের হিসাব পর্যালোচনা করে কোম্পানিটির ১ হাজার ৫৮ কোটি ২০ লাখ টাকা কোথায় বা কোন খাতে খরচ করা হয়েছে তার হিসাব মেলেনি।
এরইমধ্যে বীমা কোম্পানিটির সব স্থাবর সম্পদ দ্রুত বিক্রি করে গ্রাহকদের বীমা দাবি পরিশোধের নির্দেশনা দিয়েছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। একইসঙ্গে নতুনভাবে অর্থের যোগানের বিষয়টি পরিচালকদেরকে বিবেচনা করতে বলা হয়েছে।
অপরদিকে ফারইস্ট লাইফের আর্থিক সংকট থেকে উত্তোরণের জন্য সরকার থেকে প্রণোদনা দেয়ার বিষয়টি পর্যালোচনার দাবি করেন কোম্পানিটির বর্তমান চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন। গত ১১ সেপ্টেম্বর ফারইস্ট ইসলামী লাইফের পরিচালনা পর্ষদের সাথে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের বৈঠকে এই দাবি করা হয়।
সর্বশেষ তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ফারইস্ট ইসলামী লাইফের নবায়ন প্রিমিয়াম আয়সহ মোট প্রিমিয়াম আয় কমে গেছে। ব্যয় বেশি হওয়ায় কমে গেছে কোম্পানিটির উদ্বৃত্ত টাকার পরিমাণ। আবার গেল দুই বছরে কোম্পানিটির মালিকানা পরিবর্তন ও পরিচালনা পর্ষদে পুনর্গঠন করেও কোম্পানিটির তহবিল তছরুপের কোন টাকাই আদায় হয়নি। ফলে চরম আর্থিক সংকটের দিকে যাচ্ছে বীমা কোম্পানিটি।
অপরদিকে গ্রাহকের মেয়াদ উত্তীর্ণ বীমা দাবির পরিমাণ বাড়ছে প্রতি বছরই। সেই সাথে বাড়ছে নতুন গ্রাহকদের জমাকৃত প্রিমিয়ামের দায়ও। এই অবস্থায় ব্যবসা করতে না পারায় একদিকে আর্থিক সংকটে পড়ছে, অন্যদিকে গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ নিয়ে তৈরি হচ্ছে চরম অনিশ্চয়তা।
এই পরিস্থিতিতেও গেলো বছর ২০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ। আইন অনুসারে এই ব্যয় অবৈধ। উচ্চহারে বেতন-ভাতা ও আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন কোম্পানির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাদের জন্য বেতন-ভাতা খাতেই গেল বছর খরচ হয়েছে ৪৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। শুধু মুখ্য নির্বাহীর বেতনই দেয়া হয়েছে মাসে ৬ লাখ টাকা; সঙ্গে রয়েছে তার গাড়ি-জ্বালানিসহ অন্যান্য আর্থিক সুবিধা। এর বাইরে রয়েছে উন্নয়ন কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা। সর্বশেষ হিসাব সমাপনী বছরে উন্নয়ন কর্মকর্তাদের বেতন দেয়া হয়েছে ১৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
কোম্পানির তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনিস্পন্ন মেয়াদোত্তীর্ণ দাবির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৮০ কোটি ৩১ লাখ টাকা। ২০২৩ সালে মেয়াদ উত্তীর্ণ দাবির পরিমাণ ৬১৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০২৩ সালে অনিস্পন্ন দাবি ও নতুন মেয়াদ উত্তীর্ণ দাবির পরিমাণ ২ হাজার ৭৯৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
এর মধ্যে কোম্পানির ওয়েব সাইটের তথ্য অনুসারে ২০২৩ সালে দাবি পরিশোধ করা হয়েছে ৪৬৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। অর্থাৎ অনিষ্পন্ন দাবির পরিমাণ ২ হাজার ৩৩০ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আর ২০২৪ সাল থেকে ২০২৬ সালে নতুন করে মেয়াদউত্তীর্ণ দাবি উত্থাপিত হবে ৩ হাজার ১৩৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
অর্থাৎ আগামী ৩ বছরে মোট মেয়াদ উত্তীর্ণ দাবি পরিশোধ করতে হবে ৫ হাজার ৪৬৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। নিয়ন্ত্রক সংস্থায় দাখিল করা কোম্পানিটির অনিষ্পন্ন ও মেয়াদোত্তর বীমা দাবির হিসাব পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে ২০২৩ সালে ব্যবসা সমাপনীর সাময়িক হিসাব অনুসারে, ফারইস্ট ইসলামী লাইফের প্রিমিয়াম আয়ের হার কমে গেছে। ২০২৩ সালে কোম্পানিটি মোট প্রিমিয়াম আয় করেছে ৬০২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। যা আগের বছর ছিল ৬৩৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় প্রিমিয়াম আয় কমে গেছে ৩৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। বা ৬ শতাংশ।
আবার কোম্পানির উদ্বৃত্তের হারও কমে গেছে। ২০২৩ সালে প্রিমিয়াম আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে উদ্বৃত্ত দাঁড়ায় ৪৬৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। যা ২০২২ সালে ছিল ৪৮৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় উদ্বৃত্ত কমেছে ২০ কোটি ৩১ লাখ বা ৪ শতাংশ।
বার্ষিক হিসাব সমাপনী সাময়িক হিসাবের তথ্য অনুসারে ২০২৩ সালে মোট প্রিমিয়াম আয় করেছে ৬০২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। যার মধ্যে ব্যয় হয়েছে ১৩৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। প্রিমিয়াম আয় থেকে ব্যয় বাদ দিলে উদ্বৃত্ত দাঁড়ায় ৪৬৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।
আবার ২০২২ সালে মোট প্রিমিয়াম আয় ছিল ৬৩৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আর ব্যয় হয়েছে ১৫২ কোটি ৬৮লাখ। প্রিমিয়াম আয় থেকে ব্যয় বাদ দিলে ২০২২ সালের উদ্বৃত্ত ৪৮৬ কোটি ১০ লাখ।
অপরদিকে উদ্বৃত্ত এই টাকা লাইফ ফান্ডে যুক্ত হয়ে লাইফ ফান্ড বাড়ার কথা। অথচ ২০২৩ সালে লাইফ ফান্ড কমে গেছে ৩১১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বছর শেষে লাইফ ফান্ড দাঁড়িয়েছে ১৫৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ২০২২ সালের শুরুতে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ড ছিল ১ হাজার ৭২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। এই এক বছরেই লাইফ ফান্ড কমে গেছে ১ হাজার ২৫৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। বছর শেষে লাইফ ফান্ড দাঁড়ায় ৪৬৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
আবার ২০২৩ সালে বিনিয়োগ কমে গেছে ২১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ২০২৩ সাল শেষে মোট বিনিয়োগ রয়েছে ১ হাজার ৯২৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা। যার মধ্যে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে রয়েছে ৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।
আগের বছর ২০২২ সালে কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগ ছিল ১ হাজার ৯৪৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর ২০২২ সালে বিনিয়োগ কমে গেছে ৫৫২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ২০২১ সাল শেষে বিনিয়োগ ছিল ২ হাজার ৪৯৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
বিজনেস আওয়ার/বিএইচ