স্পোর্টস ডেস্ক : খেলোয়াড়ি জীবনে কতজনকে বোল্ড আউট করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। এবার সেই আশিক করোনাকেও হারিয়ে দিলেন। প্রচণ্ড মানসিক জোর, খাদ্য আর শৃঙ্খলা- সবকিছু মিলিয়েই করোনাকে জয় করেছেন তিনি। মানুষের সেবা করতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বিসিবির কোচ আশিকুর রহমান। করোনামুক্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন দু’দিন হলয়। চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকবেন বাসায়।
আশিক তার হাসপাতালের ডায়েরি তুলে ধরেন এভাবেই-
১২ মে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হই। ১২১৫ নম্বর কেবিন দেওয়া হয় আমাকে। নিঃসঙ্গ একা মনে হচ্ছিল শুরুতে। স্বামী বিবেকানন্দের বই পড়ে আর ধ্যান করে সময় কাটত। আড়াই বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি অসুখের সময় ধ্যান খুব কাজে দেয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর সেটা আরও বুঝলাম। ১২১৫ নম্বর কেবিনের দিনগুলো আমার জীবনের জন্য দারুণ এক শিক্ষা।
কাজকর্ম না করায় সুগার লেভেল ও কোলেস্টেরল বেড়ে গিয়েছিল। বাঁচার জন্য তীব্র সংগ্রামে লিপ্ত হই। কোয়াবের পক্ষ থেকে আমির আমাকে কেটলি ও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দেয়। কেটলিতে গরম পানি করতাম, ভেষজ সিদ্ধ করে খেতাম চার বেলা। গারগল করতাম নিয়মিত। ক্রিকেট বোর্ডের আমির খুব সাহায্য করেছে। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তাকে ফোন দিতাম। সে আমাকে এবং আমার পরিবারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে।
মাগরিবের নামাজ পড়ে ইয়োগা, ধ্যান ও শ্বাসের ব্যায়াম করতাম। এক দিন স্বামীজির কথা মনে পড়ে গেল, হাসপাতালেও মানুষের সেবা করতে হবে। চিকিৎসক ও হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাবের (সাবের হোসেন চৌধুরী) ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে রোগীদের শ্বাসের ব্যায়াম ও ধ্যান করাতে শুরু করি। রোগীরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে ধন্যবাদ দিয়ে যেত। অসুখের দিনগুলোতেও মানুষের জন্য কিছু করতে পেরে ভালো লাগছিল।
একটা বড় অভিজ্ঞতা হয়েছে হাসপাতালে- রোগীদের সঙ্গে আক্রান্ত নন এমন আত্মীয়স্বজনও থাকতেন। ভাইরাস আক্রান্ত মামার সেবা করতে দেখেছি ভাগ্নিকে। স্বামীর পাশে দেখেছি স্ত্রীকে। এই মানুষগুলো জানে তারা আক্রান্ত হতে পারে, তবুও প্রিয়জনের সেবা করে গেছে। কৌতূহল থেকে সুস্থ দু’জন নারীর কাছে জানতে চাই তারা কেন এভাবে ঝুঁকি নিয়ে রোগীর সেবা করছেন। তারা বলেছিলেন, কেউ রোগীকে দেখার নেই। তাই তারা সেবা করছেন। বুঝলাম মনের জোরই আসল।
বিসিবির কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। সিইও সুজন স্যার অনেক সাপোর্ট দিয়ে গেছেন। দুর্জয় ভাই, সুজন ভাই, দেবু দ্য সাপোর্ট দিয়েছেন কোয়াবের পক্ষ থেকে। আমির ছিল আমার অবলম্বন। এই করোনাভাইরাসের মধ্যেও আশরাফুল দেখা করতে গেছে কেবিনে। ইমরান স্যার, ওয়াহিদুল গনি স্যার নিয়মিত ফোন করতেন। কুমিল্লা থেকে ফোন করে মানুষ জানিয়েছে আমার সুস্থতা কামনা করে মিলাদ দিয়েছেন তারা। অন্যদের কথা বলতে পারব না।
তবে আমি মানুষের কাছ থেকে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। কৃতজ্ঞ সৃষ্টিকর্তার কাছে, নতুন জীবন দিয়েছেন আমাকে। যেদিন জানলাম করোনামুক্ত, অবিশ্বাস্য লাগছিল। বিশাল এক স্বস্তি নিয়ে বাসায় ফিরলাম। আসলে আমি যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারি ভাবতেও পারিনি। কোথা থেকে যে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলাম জানি না।
আমি সব সময় স্বামী বিবেকানন্দের দর্শন পড়ি। ‘জীবে দয়া করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’। এই দার্শনিক বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষের সেবায় লিপ্ত হয়েছিলাম। যেখানে থাকি দেখলাম পাশের গলিতে মানুষ খুব কষ্টে আছে। এক দিন এক নারী কান্না করে বলছিলেন, দুই কেজি ত্রাণের চাল বিক্রি করবেন ছেলের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে। ঘটনাটা আমার মনকে খুব নাড়া দেয়। পরিবারকে জানাই আমি সশরীরে মানুষের সেবা করব।
আমার স্ত্রী নিষেধ করেছিল। তখন তাকে বলেছিলাম, সবাই তো ফোনে ফোনে কাজ সারে, আমি সরাসরি মানুষের পাশে থাকতে চাই। সেই থেকে মানুষের বাসায় বাসায় খাদ্য পৌঁছে দিতাম। কুকুরদের খাবার দিতাম। হঠাৎ এক দিন জ্বর আসে। বুঝতে পারি আমার করোনাভাইরাসে আক্রমণ করেছে। জ্বর না মেপে সোজা হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে যাই। মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম যেন রিপোর্ট নেগেটিভ আসে।
যখন রিপোর্ট পজিটিভ এলো, তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। চোখের সামনে ভেসে উঠল স্ত্রী ও দুই সন্তানের চেহারা। কান্না পাচ্ছিল আমি মরে গেলে ওদের কী হবে! আমার স্ত্রী খুব সাহস দিয়ে বলল, ‘আমরা সাহস রাখছি, তুমি সাহস রাখ।’ এই সাহসের জোরেই বোধহয় আবার দেখা হলো আমাদের।
বিজনেস আওয়ার/৩১ মে, ২০২০/এ