ঢাকা , শনিবার, ০৭ জুন ২০২৫, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

উৎসবের সিনেমায় এত নৃশংসতা কেন

  • পোস্ট হয়েছে : ০৩:৪৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ জুন ২০২৫
  • 5

বিনোদন ডেস্ক: কেবল ট্রেলার দেখে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না যে, সিনেমাগুলো নৃশংস। তবে নৃশংসতার বিজ্ঞাপন দেখিয়ে যখন হলে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, ধরে নেওয়া যায়, সিনেমাগুলো চরম নৃশংসতায় পূর্ণ। কিন্তু এগুলো তো উৎসবের সিনেমা, এগুলোতে এত নৃশংসতা কেন? সরল উত্তর হতে পারে, কুরবানির ঈদ মানেই রক্তারক্তি ব্যাপার-স্যাপার, এ কারণে।

চটকদার, অভিনব, বেকায়দা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এরই মধ্যে মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে নতুন সিনেমাগুলোর খবর। পবিত্র ঈদুল আজহায় মুক্তি পাচ্ছে ছয়টি সিনেমা — ‘তাণ্ডব’, ‘ইনসাফ’, ‘টগর’, ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’, ‘নীলচক্র’ ও ‘উৎসব’। প্রত্যেকটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন পরীক্ষিত সব তারকাশিল্পী। এসবের যারা পরিচালক, তারাও এরই মধ্যে তাদের কাজের কারণে প্রশংসিত। রইলো বাকি একটি পক্ষ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ, সিনেমার প্রাণভ্রমরা— প্রযোজক। তার মনে এই প্রশ্নের উদয় হওয়া প্রয়োজন যে, উৎসবে আসলে কী রকম সিনেমা দর্শকদের উপহার দেওয়া উচিত?

সিনেমা নিয়ে এ রকম প্রশ্ন কেন?

সময়টা লক্ষ্য করতে হবে। একটা গণ-অভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশ এটা, কেউ কেউ বলছেন বিপ্লব। চারপাশে তাকালেই দেখা যাচ্ছে ক্ষুব্ধ-বিরক্ত-প্রতিবাদী-ধ্বংসোন্মুখ মানুষ। গত বছরের ঠিক এই সময়ে একটা রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল। জীবন বাজি ধরে ছাত্রজনতা এক ভয়ানক স্বৈরশাসকের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। নিহতর রক্তের দাগ, আহতর ক্ষত এখনো শুকায়নি। পতিত শাসক ও তার দোসরদের ষড়যন্ত্র এখনো সক্রিয়ভাবে চাপ অব্যাহত রেখেছে। শান্তিকামী মানুষের ওপর চেপে বসার পাঁয়তারা করছে অন্য একটি পক্ষ। শাসক বদলের মুহূর্তে আরেকটি পক্ষ জিম্মি করছে জনতাকে। এ রকম সময়ে আমাদের দরকার শান্তি। এ রকম সময়ে আমাদের দরকার আশা, দিকনির্দেশনা, অনুপ্রেরণা, প্রেম, সহযোগিতার গল্প, নিকটবর্তী সমৃদ্ধ দেশের স্বপ্ন। অথচ অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে আমাদের এখনো দেখতে হবে তাণ্ডব, মৃত্যু, ধ্বংস, প্রতিহিংসার লেলিহান শিখা।

ঈদুল আজহার সিনেমা তালিকাটি দেখুন। ছয়টির মধ্যে প্রথম চারটি সিনেমা ‘তাণ্ডব’, ‘ইনসাফ’, ‘টগর’, ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’। সবগুলোর পোস্টার, টিজার, ট্রেলার বলছে ছবিগুলো অ্যাকশন ঘরানার, এবং ভয়াবহ নৃশংস। চমক হিসেবে আছে ছোটপর্দার অভিনেত্রীদের বড়পর্দায় উপস্থাপন। পুরোনো দিনের জনপ্রিয় ও লোকগানের ম্যাশাপ, ভারতীয় কোরিওগ্রাফি। ডালে-চালে খিচুরি বানিয়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে দর্শকের পাতে। আদতে টাকা রোল হওয়া ছাড়া এই সিনেমা বিক্রি করে নির্মাতার লাভ কতটা হচ্ছে একমাত্র তারাই বলতে পারবেন।

বাংলাদেশে এখনো নায়কের নামে সিনেমা চলে। আড়াই মাস আগে ঈদুল ফিতরে ‘বরবাদ’ সিনেমায় মানুষ দেখেছেন নৃশংস শাকিব খানকে। সে সিনেমার গল্প, দৃশ্য, কোরিওগ্রাফিতে নতুনত্ব ছিল না। ব্যাকডোরে কথা উঠেছিল, ভারতীয় প্যাকেজ দিয়ে বানালে নতুনত্ব আসবে কীভাবে? সেই প্রশ্নটি কি নির্মাতাদের মাথায় আসা প্রয়োজন নয়? ছবির দুনিয়া এখন এমনই উন্মুক্ত যে, মোবাইল ডাটা কিনে যে কেউ বাংলায় ডাবিং করা দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা দেখতে পারছেন, যে কোনো জায়গায় বসে। সিনেমা হলের টিকিটের থেকেও কম খরচে। সেই একই রঙ, দৃশ্য, নৃত্যভঙ্গি, নৃশংসতা দেখতে মানুষকে হলে আমন্ত্রণ জানানো কি যৌক্তিক? নির্মাতারা জবাব দিতে পারেন, সার্টিফিকেশন বোর্ড এগুলো সিনেমাকেই ছাড়পত্র দিয়েছে!

সত্যি বলতে সার্টিফিকেশন বোর্ড সিনেমার কেউ না। জাতিকে কী দেখতে ডাকবেন, প্রযোজকই সেই সিদ্ধান্তের মহারাজা। বেদম তালে যত্রতত্র টাকা ছড়ানোর পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্বও থাকে তাদের। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, সেই দায়িত্বের কথা কেউ তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে না। তাই ঈদের পর ঈদ আসছে, ভারতীয় সিনেমার আদলে তারা বানিয়েই যাচ্ছেন নৃশংস সব সিনেমা। কেবল দর্শক এসব ‘খায়’ বলে? নাকি তারা এর চেয়ে সৃজনশীল হতে পারছেন না বলে?

জনতাকে শান্তি ও শিক্ষা দেওয়ার জন্য ভালো সিনেমা জরুরি, এ কথা যে কেউ স্বীকার করবেন। দলবেঁধে হলে সময় কাটিয়ে আসাটা যেন অর্থপূর্ণ হয়, সেই চিন্তাটা আরও গভীরভাবে করার সময় চলে যাচ্ছে। মানুষকে কিছুটা স্বস্তি, কিছুটা শান্তি দেওয়ার দরকার আছে। এই ভাবনাটা হয়তো কোনো কোনো প্রযোজক ভেবেছেনও। সেই চিন্তার কিছুটা ছাপ পাওয়া গেছে ‘নীলচক্র’ ও ‘উৎসব’ সিনেমা দুটোর ট্রেলারে। ঈদের ছয় সিনেমার মধ্যে অন্তত পাঁচটি সিনেমা যদি স্বস্তি ও শান্তির হতো, বোধকরি জাতির জন্য সেটা বেশি মঙ্গলজনক হতো।

বিজনেস আওয়ার/ ০৬ জুন / রানা

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান:
ট্যাগ :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার মেইলে তথ্য জমা করুন

উৎসবের সিনেমায় এত নৃশংসতা কেন

পোস্ট হয়েছে : ০৩:৪৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ জুন ২০২৫

বিনোদন ডেস্ক: কেবল ট্রেলার দেখে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না যে, সিনেমাগুলো নৃশংস। তবে নৃশংসতার বিজ্ঞাপন দেখিয়ে যখন হলে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, ধরে নেওয়া যায়, সিনেমাগুলো চরম নৃশংসতায় পূর্ণ। কিন্তু এগুলো তো উৎসবের সিনেমা, এগুলোতে এত নৃশংসতা কেন? সরল উত্তর হতে পারে, কুরবানির ঈদ মানেই রক্তারক্তি ব্যাপার-স্যাপার, এ কারণে।

চটকদার, অভিনব, বেকায়দা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এরই মধ্যে মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে নতুন সিনেমাগুলোর খবর। পবিত্র ঈদুল আজহায় মুক্তি পাচ্ছে ছয়টি সিনেমা — ‘তাণ্ডব’, ‘ইনসাফ’, ‘টগর’, ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’, ‘নীলচক্র’ ও ‘উৎসব’। প্রত্যেকটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন পরীক্ষিত সব তারকাশিল্পী। এসবের যারা পরিচালক, তারাও এরই মধ্যে তাদের কাজের কারণে প্রশংসিত। রইলো বাকি একটি পক্ষ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ, সিনেমার প্রাণভ্রমরা— প্রযোজক। তার মনে এই প্রশ্নের উদয় হওয়া প্রয়োজন যে, উৎসবে আসলে কী রকম সিনেমা দর্শকদের উপহার দেওয়া উচিত?

সিনেমা নিয়ে এ রকম প্রশ্ন কেন?

সময়টা লক্ষ্য করতে হবে। একটা গণ-অভ্যুত্থানের পরের বাংলাদেশ এটা, কেউ কেউ বলছেন বিপ্লব। চারপাশে তাকালেই দেখা যাচ্ছে ক্ষুব্ধ-বিরক্ত-প্রতিবাদী-ধ্বংসোন্মুখ মানুষ। গত বছরের ঠিক এই সময়ে একটা রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল। জীবন বাজি ধরে ছাত্রজনতা এক ভয়ানক স্বৈরশাসকের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। নিহতর রক্তের দাগ, আহতর ক্ষত এখনো শুকায়নি। পতিত শাসক ও তার দোসরদের ষড়যন্ত্র এখনো সক্রিয়ভাবে চাপ অব্যাহত রেখেছে। শান্তিকামী মানুষের ওপর চেপে বসার পাঁয়তারা করছে অন্য একটি পক্ষ। শাসক বদলের মুহূর্তে আরেকটি পক্ষ জিম্মি করছে জনতাকে। এ রকম সময়ে আমাদের দরকার শান্তি। এ রকম সময়ে আমাদের দরকার আশা, দিকনির্দেশনা, অনুপ্রেরণা, প্রেম, সহযোগিতার গল্প, নিকটবর্তী সমৃদ্ধ দেশের স্বপ্ন। অথচ অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে আমাদের এখনো দেখতে হবে তাণ্ডব, মৃত্যু, ধ্বংস, প্রতিহিংসার লেলিহান শিখা।

ঈদুল আজহার সিনেমা তালিকাটি দেখুন। ছয়টির মধ্যে প্রথম চারটি সিনেমা ‘তাণ্ডব’, ‘ইনসাফ’, ‘টগর’, ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’। সবগুলোর পোস্টার, টিজার, ট্রেলার বলছে ছবিগুলো অ্যাকশন ঘরানার, এবং ভয়াবহ নৃশংস। চমক হিসেবে আছে ছোটপর্দার অভিনেত্রীদের বড়পর্দায় উপস্থাপন। পুরোনো দিনের জনপ্রিয় ও লোকগানের ম্যাশাপ, ভারতীয় কোরিওগ্রাফি। ডালে-চালে খিচুরি বানিয়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে দর্শকের পাতে। আদতে টাকা রোল হওয়া ছাড়া এই সিনেমা বিক্রি করে নির্মাতার লাভ কতটা হচ্ছে একমাত্র তারাই বলতে পারবেন।

বাংলাদেশে এখনো নায়কের নামে সিনেমা চলে। আড়াই মাস আগে ঈদুল ফিতরে ‘বরবাদ’ সিনেমায় মানুষ দেখেছেন নৃশংস শাকিব খানকে। সে সিনেমার গল্প, দৃশ্য, কোরিওগ্রাফিতে নতুনত্ব ছিল না। ব্যাকডোরে কথা উঠেছিল, ভারতীয় প্যাকেজ দিয়ে বানালে নতুনত্ব আসবে কীভাবে? সেই প্রশ্নটি কি নির্মাতাদের মাথায় আসা প্রয়োজন নয়? ছবির দুনিয়া এখন এমনই উন্মুক্ত যে, মোবাইল ডাটা কিনে যে কেউ বাংলায় ডাবিং করা দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা দেখতে পারছেন, যে কোনো জায়গায় বসে। সিনেমা হলের টিকিটের থেকেও কম খরচে। সেই একই রঙ, দৃশ্য, নৃত্যভঙ্গি, নৃশংসতা দেখতে মানুষকে হলে আমন্ত্রণ জানানো কি যৌক্তিক? নির্মাতারা জবাব দিতে পারেন, সার্টিফিকেশন বোর্ড এগুলো সিনেমাকেই ছাড়পত্র দিয়েছে!

সত্যি বলতে সার্টিফিকেশন বোর্ড সিনেমার কেউ না। জাতিকে কী দেখতে ডাকবেন, প্রযোজকই সেই সিদ্ধান্তের মহারাজা। বেদম তালে যত্রতত্র টাকা ছড়ানোর পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্বও থাকে তাদের। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, সেই দায়িত্বের কথা কেউ তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে না। তাই ঈদের পর ঈদ আসছে, ভারতীয় সিনেমার আদলে তারা বানিয়েই যাচ্ছেন নৃশংস সব সিনেমা। কেবল দর্শক এসব ‘খায়’ বলে? নাকি তারা এর চেয়ে সৃজনশীল হতে পারছেন না বলে?

জনতাকে শান্তি ও শিক্ষা দেওয়ার জন্য ভালো সিনেমা জরুরি, এ কথা যে কেউ স্বীকার করবেন। দলবেঁধে হলে সময় কাটিয়ে আসাটা যেন অর্থপূর্ণ হয়, সেই চিন্তাটা আরও গভীরভাবে করার সময় চলে যাচ্ছে। মানুষকে কিছুটা স্বস্তি, কিছুটা শান্তি দেওয়ার দরকার আছে। এই ভাবনাটা হয়তো কোনো কোনো প্রযোজক ভেবেছেনও। সেই চিন্তার কিছুটা ছাপ পাওয়া গেছে ‘নীলচক্র’ ও ‘উৎসব’ সিনেমা দুটোর ট্রেলারে। ঈদের ছয় সিনেমার মধ্যে অন্তত পাঁচটি সিনেমা যদি স্বস্তি ও শান্তির হতো, বোধকরি জাতির জন্য সেটা বেশি মঙ্গলজনক হতো।

বিজনেস আওয়ার/ ০৬ জুন / রানা

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান: