ঢাকা , বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রাজনীতিবিদদের প্রতি ক্ষোভে রাস্তায় নামে নেপালের তরুণরা

  • পোস্ট হয়েছে : ৪ মিনিট আগে
  • 1

বিজনেস আওয়ার ডেস্ক: নেপালের জেনারেশন জেড তরুণেরা মাত্র ৪৮ ঘণ্টার আন্দোলনে সরকার পতনে সফল হয়েছেন। কিন্তু এই বিজয়ের মূল্য ছিল ভয়াবহ। ২৪ বছর বয়সী পরিবেশকর্মী ও আন্দোলনের সংগঠক তনুজা পান্ডে বলেন, আমরা গর্বিত, কিন্তু সেই সঙ্গে বয়ে বেড়াচ্ছি মানসিক আঘাত, অনুশোচনা আর রাগ।

গত সপ্তাহের বিক্ষোভে ৭২ জন নিহত হন, যা সাম্প্রতিক দশকগুলোর মধ্যে হিমালয়ের দেশটিতে সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ। রাষ্ট্রীয় ভবন, রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি, এমনকি জুলাইতে চালু হওয়া হিলটন হোটেল পর্যন্ত আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী এখনও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।

আন্তর্জাতিক সংকট বিশ্লেষণ সংস্থার জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা আশীষ প্রধান বলেন, এই আন্দোলন ছিল নেপালের বর্তমান রাজনৈতিক শ্রেণির প্রতি পূর্ণাঙ্গ অসন্তোষ—দশকের পর দশক ধরে দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার এর বিরুদ্ধে। তবে তিনি সতর্ক করেন, সরকারি সেবায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা হয়তো ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের ক্ষতির সমতুল্য।

রাজধানী কাঠমাণ্ডু ছাড়িয়ে অন্তত ৩০০টির বেশি স্থানীয় সরকারি অফিসে হামলা হয়েছে। কাঠমাণ্ডু পোস্ট জানায়, দেশের মোট ক্ষতি প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন নেপালি রুপি (২১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), যা দেশটির মোট জিডিপির প্রায় অর্ধেক।

প্রতিবাদ শুরুর দুই দিন আগে তনুজা পান্ডে চুরে পাহাড় অঞ্চলের এক খনির ভিডিও পোস্ট করেন। লেখেন, দেশের সম্পদ রাজনীতিবিদদের প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির নয়, জনগণের। ভিডিওটি ভাইরাল হয় এবং তিনি আহ্বান জানান, দুর্নীতি ও সম্পদের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামার।

নেপালের এই আন্দোলন ছিল নেতাহীন, অনেকটা অন্য এশীয় তরুণদের আন্দোলনের মতো। সরকার যখন ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করে (স্থানীয়ভাবে নিবন্ধন না করায়), তখন ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নেপো বেবি বিতর্ক। অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিবারের সন্তানদের অপ্রকাশিত সম্পদের বিলাসী প্রদর্শন ঘৃণা উসকে দেয়।

তনুজা পান্ডে ও তার বন্ধুরা কাঠমাণ্ডুর মৈতিঘর মণ্ডলা চত্বরে বিক্ষোভে যোগ দেন। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ গান, স্লোগান, আড্ডা দিয়ে শুরু হয়। ২৬ বছর বয়সী আকৃতি ঘিমিরে বলেন, শুরুতে পরিবেশ ছিল একেবারে উৎসবমুখর।

কিন্তু দুপুর নাগাদ নতুন বনেশ্বরের দিকে জনতা অগ্রসর হলে উত্তেজনা বাড়ে। সেখানে পার্লামেন্ট ভবন অবস্থিত। তনুজা ও আকৃতি জানান, তারা দেখেছেন বয়সে বড় কিছু লোক মোটরসাইকেলে এসে জটলা করছে। অনেকেই মুখোশ পরে ছিল।

আকৃতি বলেন, আমরা বুঝতে পারছিলাম না কারা প্রকৃত প্রতিবাদকারী, আর কারা ইচ্ছাকৃতভাবে সহিংসতা করতে এসেছে। পুলিশ তখন টিয়ার গ্যাস, জলকামান ও গুলি ছোড়ে। বিদ্যালয়ের শিশুদের লক্ষ্য করেও গুলি চালানো হয়েছে, এমন অভিযোগ উঠেছে।

পরদিন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ একাধিক সরকারি স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়।

তনুজা বলেন, আমি দেখেছি কিছু লোক মোটরবাইক থেকে পেট্রোল বের করে বোতলে ভরছে। তারপর তারা সংসদে আগুন দেয়।

তনুজা কেঁদে ফেলেন সুপ্রিম কোর্টে আগুন লাগার খবর দেখে। এটা আমার কাছে এক মন্দিরের মতো। তিনি জানান, তার বন্ধুরা পানির বোতল নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে—জানত তারা ব্যর্থ হবে, তবু কিছু করার মনোবলই তাদের তাড়িত করেছিল।

বিক্ষোভের তীব্রতা ঠেকাতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় এবং কারফিউ জারি করা হয়।

পরবর্তীতে, সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুসীলা কার্কিকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, যিনি আন্দোলনকারীদের সমর্থন পেয়েছিলেন।

তবু ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ রুমেলা সেন বলেন, সেনাবাহিনীর প্রতি এই অভূতপূর্ব আস্থাই এক নতুন উদ্বেগের ইঙ্গিত দেয়।

তনুজা পান্ডে বলেন, এই আন্দোলন তাদের প্রজন্মের রাজনৈতিক জাগরণ। এটা শুধু নরম আহ্বান নয়, এটা ছিল এক সাহসী চ্যালেঞ্জ—এক এমন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যা দশকের পর দশক ধরে ক্ষমতা নিজের করে রেখেছে।

সূত্র: বিবিসি

বিজনেস আওয়ার/ ১৭ সেপ্টেম্বর / হাসান

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান:
ট্যাগ :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার মেইলে তথ্য জমা করুন

সর্বাধিক পঠিত

রাজনীতিবিদদের প্রতি ক্ষোভে রাস্তায় নামে নেপালের তরুণরা

পোস্ট হয়েছে : ৫ মিনিট আগে

বিজনেস আওয়ার ডেস্ক: নেপালের জেনারেশন জেড তরুণেরা মাত্র ৪৮ ঘণ্টার আন্দোলনে সরকার পতনে সফল হয়েছেন। কিন্তু এই বিজয়ের মূল্য ছিল ভয়াবহ। ২৪ বছর বয়সী পরিবেশকর্মী ও আন্দোলনের সংগঠক তনুজা পান্ডে বলেন, আমরা গর্বিত, কিন্তু সেই সঙ্গে বয়ে বেড়াচ্ছি মানসিক আঘাত, অনুশোচনা আর রাগ।

গত সপ্তাহের বিক্ষোভে ৭২ জন নিহত হন, যা সাম্প্রতিক দশকগুলোর মধ্যে হিমালয়ের দেশটিতে সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ। রাষ্ট্রীয় ভবন, রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি, এমনকি জুলাইতে চালু হওয়া হিলটন হোটেল পর্যন্ত আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী এখনও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।

আন্তর্জাতিক সংকট বিশ্লেষণ সংস্থার জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা আশীষ প্রধান বলেন, এই আন্দোলন ছিল নেপালের বর্তমান রাজনৈতিক শ্রেণির প্রতি পূর্ণাঙ্গ অসন্তোষ—দশকের পর দশক ধরে দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার এর বিরুদ্ধে। তবে তিনি সতর্ক করেন, সরকারি সেবায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা হয়তো ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের ক্ষতির সমতুল্য।

রাজধানী কাঠমাণ্ডু ছাড়িয়ে অন্তত ৩০০টির বেশি স্থানীয় সরকারি অফিসে হামলা হয়েছে। কাঠমাণ্ডু পোস্ট জানায়, দেশের মোট ক্ষতি প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন নেপালি রুপি (২১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), যা দেশটির মোট জিডিপির প্রায় অর্ধেক।

প্রতিবাদ শুরুর দুই দিন আগে তনুজা পান্ডে চুরে পাহাড় অঞ্চলের এক খনির ভিডিও পোস্ট করেন। লেখেন, দেশের সম্পদ রাজনীতিবিদদের প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির নয়, জনগণের। ভিডিওটি ভাইরাল হয় এবং তিনি আহ্বান জানান, দুর্নীতি ও সম্পদের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামার।

নেপালের এই আন্দোলন ছিল নেতাহীন, অনেকটা অন্য এশীয় তরুণদের আন্দোলনের মতো। সরকার যখন ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করে (স্থানীয়ভাবে নিবন্ধন না করায়), তখন ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নেপো বেবি বিতর্ক। অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিবারের সন্তানদের অপ্রকাশিত সম্পদের বিলাসী প্রদর্শন ঘৃণা উসকে দেয়।

তনুজা পান্ডে ও তার বন্ধুরা কাঠমাণ্ডুর মৈতিঘর মণ্ডলা চত্বরে বিক্ষোভে যোগ দেন। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ গান, স্লোগান, আড্ডা দিয়ে শুরু হয়। ২৬ বছর বয়সী আকৃতি ঘিমিরে বলেন, শুরুতে পরিবেশ ছিল একেবারে উৎসবমুখর।

কিন্তু দুপুর নাগাদ নতুন বনেশ্বরের দিকে জনতা অগ্রসর হলে উত্তেজনা বাড়ে। সেখানে পার্লামেন্ট ভবন অবস্থিত। তনুজা ও আকৃতি জানান, তারা দেখেছেন বয়সে বড় কিছু লোক মোটরসাইকেলে এসে জটলা করছে। অনেকেই মুখোশ পরে ছিল।

আকৃতি বলেন, আমরা বুঝতে পারছিলাম না কারা প্রকৃত প্রতিবাদকারী, আর কারা ইচ্ছাকৃতভাবে সহিংসতা করতে এসেছে। পুলিশ তখন টিয়ার গ্যাস, জলকামান ও গুলি ছোড়ে। বিদ্যালয়ের শিশুদের লক্ষ্য করেও গুলি চালানো হয়েছে, এমন অভিযোগ উঠেছে।

পরদিন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ একাধিক সরকারি স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়।

তনুজা বলেন, আমি দেখেছি কিছু লোক মোটরবাইক থেকে পেট্রোল বের করে বোতলে ভরছে। তারপর তারা সংসদে আগুন দেয়।

তনুজা কেঁদে ফেলেন সুপ্রিম কোর্টে আগুন লাগার খবর দেখে। এটা আমার কাছে এক মন্দিরের মতো। তিনি জানান, তার বন্ধুরা পানির বোতল নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে—জানত তারা ব্যর্থ হবে, তবু কিছু করার মনোবলই তাদের তাড়িত করেছিল।

বিক্ষোভের তীব্রতা ঠেকাতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় এবং কারফিউ জারি করা হয়।

পরবর্তীতে, সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুসীলা কার্কিকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, যিনি আন্দোলনকারীদের সমর্থন পেয়েছিলেন।

তবু ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ রুমেলা সেন বলেন, সেনাবাহিনীর প্রতি এই অভূতপূর্ব আস্থাই এক নতুন উদ্বেগের ইঙ্গিত দেয়।

তনুজা পান্ডে বলেন, এই আন্দোলন তাদের প্রজন্মের রাজনৈতিক জাগরণ। এটা শুধু নরম আহ্বান নয়, এটা ছিল এক সাহসী চ্যালেঞ্জ—এক এমন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যা দশকের পর দশক ধরে ক্ষমতা নিজের করে রেখেছে।

সূত্র: বিবিসি

বিজনেস আওয়ার/ ১৭ সেপ্টেম্বর / হাসান

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান: