বাংলাদেশের শেয়ারবাজার দীর্ঘদিন থেকে তারল্য বা নগদ অর্থের সংকটে রয়েছে। যা সমাধানে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) প্রধামন্ত্রীর দারস্থ পর্যন্ত হতে হয়েছে। সেই তারল্য সংকটের শেয়ারবাজার থেকেই এফডিআর করার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে যাচ্ছে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স।
শেয়ারবাজারে তারল্য সংকটের কারনে ব্যাংকগুলোকে বিভিন্নভাবে বিনিয়োগে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এরইমধ্যে বিএসইসির চেষ্টা ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য সহজ শর্তে ২০০ কোটি টাকা করে দেওয়ার সার্কুলার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরেও ব্যাংকগুলো এখনো উল্লেখ করার মতো এগিয়ে আসেনি। এরমধ্যেই করোনাভাইরাসের কারনে শেয়ারবাজারে তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারন করেছে।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বিজনেস আওয়ারকে বলেন, বীমা কোম্পানিগুলোর প্রফেশনালিজমের অনেক ঘাটতি রয়েছে। তারা অর্থের সঠিক ব্যবহার করতে পারে না। এছাড়া বর্তমানে শেয়ারবাজারে তারল্য সংকট রয়েছে। সেখানে এফডিআর করতে শেয়ারবাজারের চলমান মন্দাবস্থায় বীমা কোম্পানির অর্থ উত্তোলন কতটা সঠিক হবে, তা বোধগম্য নয়। বরং আমি হলে এফডিআর ভেঙ্গে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার জন্য বলতাম। এখন অনেক কোম্পানির শেয়ার বিনিয়োগ করার মতো অবস্থায় রয়েছে।
চলমান তারল্য সংকটের মধ্যেই অযৌক্তিক কারনে শেয়ারবাজার থেকে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স ২৬ কোটি ৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা সংগ্রহ করবে। যে কোম্পানির শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তিতে উপকার নেই। বরং তারল্য সংকটের সৃষ্টি করবে। বিনিয়োগকারীরা নিজেরাই যেখানে বিনিয়োগ করতে পারে, সেখানে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বড় অংশ ব্যাংকে এফডিআর করবে। আর কিছু অংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করবে। যা বিনিয়োগকারীরা নিজেরাই করতে সক্ষম। এছাড়া এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের রেকর্ড ভালো না।
এ কোম্পানিটিকে বিএসইসি আগামি ১৪ জুন থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের জন্য সময় নির্ধারন করে দিয়েছে।
কোম্পানিটি শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে ক্যাপিটাল মার্কেটে বিনিয়োগ করবে ৫ কোটি ২১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। এরমধ্যে সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করবে ২ কোটি টাকা। আর মিউচ্যুয়াল ফান্ডে ১ কোটি টাকা ও ‘এ’ ক্যাটাগরির কোম্পানিতে ২ কোটি ২১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা বিনিয়োগ করবে।
তবে শেয়ারবাজার থেকে উত্তোলিত টাকার ১৯ কোটি ৩৬ লাখ ৩২ হাজার টাকা বা ৭৪.২৫ শতাংশ এফডিআর করবে। বাকি ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা আইপিওতে ব্যয় হবে। অথচ এই কোম্পানির হাতেই ৫৪ কোটি ১২ লাখ টাকা নগদ রয়েছে। এরমধ্যে ৪৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা এফডিআর, ব্যাংক হিসাবে ৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা, ব্রোকারেজ হাউজে নগদ ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা ও কোম্পানিতে নগদ ২১ লাখ টাকা রয়েছে।
এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স শেয়ার ব্যবসায় দূর্বল। আর এই কোম্পানিকেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার জন্যও আইপিও দেওয়া হয়েছে। যে কোম্পানির ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ৫ কোটি ২ লাখ টাকার বিনিয়োগ ৩ কোটি ৬ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাৎ বিনিয়োগ নাই হয়ে গেছে ১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বা ৩৯ শতাংশ। সেই বিনিয়োগ শেয়ারবাজারের ২০১৯ ও ২০২০ সাদলের মন্দাবস্থায় কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা অনুমেয়।
এই অবস্থায় কোম্পানিটিকে আইপিওর শর্ত থেকে অব্যাহতি বা ছাড় দিয়ে আইপিও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পাবলিক ইস্যু বিধিমালা ২০১৫ এর বিধি ৩(৩)সি পরিপালনের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দিয়ে আইপিও অনুমোদন দেওয়া হয়।
এর আগে গত ৯ বছরে বীমা খাতের পদ্মা ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স ও সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স তালিকাভুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স ও সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স আইপিওর পুরোটাই এফডিআর এবং ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করেছে। আর পদ্মা ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্স পরিশোধ করেছে ঋণ। অথচ সেই ৩ বীমা কোম্পানির মধ্যে ২০১২ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া পদ্মা ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও ২০১৩ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স এখন ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে। আর ২০১৬ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স ‘এ’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের সচিব লিয়াকত আলী খান বিজনেস আওয়ারকে বলেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) অবগতি ছাড়া কোন মন্তব্য করার এখতিয়ার নেই। আর এমডি অফিসে না আসায় অবগত করা যাচ্ছে না।
পরবর্তীতে প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা (সিইও) কেএম সাইদুর রহমান বিজনেস আওয়ারকে বলেন, শেয়ারবাজারে আসার আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে। আমরা আসতে চাই না। কিন্তু ব্যাংক, বীমা ও লিজিং কোম্পানিকে ৩ বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে আসা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সুশাসনের স্বার্থে, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে এই আইন করা হয়েছে। এ কারনেই শেয়ারবাজারে আসা।
তিনি বলেন, শেয়ার ব্যবসায় ২০১০ সালে ৫ কোটি টাকা লাভ করেছি। ওই লাভটা দিয়ে শেয়ার কিনেছি। এরপরে মার্কেট খারাপ হওয়ার কারনে কোন শেয়ার কিনিও নাই, বেচিও নাই। তাই লাভের কিংবা দূর্বলতার প্রশ্ন আসে না। লাভের টাকা হারাইছি। একইসঙ্গে ২০১৮ সালে শেয়ারবাজার স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও ৯৯.৯ শতাংশ কোম্পানি পোর্টফোলিওতে লোকসান করেছে বলে তিনি দাবি করেছেন।
এখন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার সময় উল্লেখ করে সাইদুর রহমান বলেন, আমরা আইপিও ফান্ডের কিছু অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করব। এটাকে ভালো বলে দাবি করেছেন তিনি। এছাড়া শেয়ারবাজার থেকে প্রায় ২৭ কোটি টাকা নিয়ে ৫ কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ করার মাধ্যমে তারল্য সংকটের মধ্যে কিছু টাকা শেয়ারবাজারে ঢুকবে বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে আইডিআরএ’র অনুমোদন নিয়ে আরও কিছু টাকা বিনিয়োগ করবেন বলে মনে করছেন তারা।
তিনি দাবি করেছেন, ডিএসই, সিএসই ও বিনিয়োগকারীরা এখন ইস্যু বা আইপিও চাচ্ছে। স্টক এক্সচেঞ্জের এক্সপার্টরা আরও ইস্যু আনার জন্য বলেছে। আবার তিনিই দাবি করেছেন গত কয়েক বছরের মধ্যে একমাত্র এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের আইপিও’র বিষয়ে ডিএসই আপত্তি তোলেনি।
বিজনেস আওয়ার/০৩ জুন, ২০২০/আরএ
2 thoughts on “তারল্য সংকটের শেয়ারবাজার থেকে অর্থ নিয়ে এফডিআর করবে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স”