প্রাণঘাতি করোনার আঘাতে বিশ্ব পুঁজিবাজারে বড় আঘাত হানলেও প্রযুক্তির সহায়তায় সামলে উঠছে। সাময়িক বন্ধের পর প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘরে বসে এসব দেশের পুঁজিবাজারে লেনদেন চলছে। কিন্তু পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের সব কিছুতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগলেও আধুনিক হতে পারেনি স্টক এক্সচেঞ্জ। যার কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে পুঁজিবাজারের লেনদেন।
করোনা শঙ্কার মধ্যেও আগামী ১০ মে থেকে পুঁজিবাজারে লেনদেন চালুর বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদ। করোনায় লকডাউন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে লেনদেন চালু ও ক্ষতিগ্রস্ত পুঁজিবাজারে করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক ও মিউওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রকিবুর রহমান।
বিনিয়োগকারী, স্টক এক্সচেঞ্জ ও ব্রোকারেজ হাউসের স্বার্থেই এখন পুঁজিবাজার খুলে দেওয়া উচিত। করোনা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশকেও ক্ষতির মধ্যে ফেলেছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো করোনার শঙ্কা কাটিয়ে পুঁজিবাজার খুলে দিয়েছে। লেনদেন চলছে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাজারকে খুব বেশি প্রণোদনা ও সহায়তা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে মোবাইলে অ্যাপসের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে। শেয়ার লেনদেনে বিনিয়োগকারীদের ব্রোকারেজ হাউসে আসতে হয় না। তারা সম্পূর্ণরূপে ডিজিটাইজড। টেলিফোনে অর্ডার দেয়, লেনদেন সম্পন্ন হয়ে যায়; কিন্তু আমরা এখনো প্রযুক্তিনির্ভর করতে পারেনি। সেটা করা খুব জরুরি। আগামী ছয় মাসের মধ্যেই পুঁজিবাজারে শেয়ার লেনদেন প্রক্রিয়া ডিজিটাইজড করতে হবে।
করোনার সময় অস্থির হয়ে ওঠে পুঁজিবাজার। ক্রমাগত বিক্রির চাপে বাজার পড়তে থাকে। সেই সময় সরকারের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হয়। শেয়ারের একটা নির্দিষ্ট দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ওই দামের নিচে শেয়ার দাম নামতে পারবে না। বেঁধে দেওয়া সীমার ওপরেই লেনদেন হবে। এতে বিনিয়োগকারী বেঁচে গেছে। যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে; কিন্তু আরো ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকগুলোকে ২০০ কোটি টাকা করে পাঁচ বছরের জন্য বিশেষ ফান্ড গঠনের সুযোগ দিয়েছে। এই ফান্ডের বিপরীতে ব্যাংককে কোনো প্রভিশন রাখতে হবে না। পুঁজিবাজারে ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সুযোগ পেয়েছে। বিনিয়োগকারীর স্বার্থে ব্যাংকগুলোকে নগদ ও বোনাস লভ্যাংশ দিতে উৎসাহিত করা হয়েছে। যার ফলে অনেক ব্যাংক ভালো লভ্যাংশ দিয়েছে।
পুঁজিবাজার বন্ধ থাকায় কেউ ভালো নেই। বিনিয়োগকারী, ব্রোকারেজ হাউস সবাই অস্বস্তিতে রয়েছে। ধরেন পুঁজিবাজারে একজন বিনিয়োগকারীর দুই-তিন লাখ টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। সংকটকালে এই টাকা তার খুব প্রয়োজন। সে এখন কী করবে? চাইলেও টাকা তুলতে পারছে না। কিন্তু তার টাকার খুব প্রয়োজন। গার্মেন্ট শিল্প ও স্বাস্থ্য খাত, কৃষিতে জরুরি সেবা হিসেবে খোলা রাখা আছে। সেদিক বিবেচনা করে পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট সবাই মনে করি, পুঁজিবাজার চালু করা প্রয়োজন। ডিএসইর বোর্ডও মনে করে পুঁজিবাজার চালু হওয়া উচিত। এ জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই পুঁজিবাজার চালু করা সম্ভব। স্বাস্থ্যগত কোনো ঝুঁকিতে পড়বে না কেউ। ফোনে অর্ডার নেওয়া হবে। মুঠোফোনে অর্ডারের রেকর্ড থাকবে।
পুঁজিবাজার বন্ধ থাকলে বৈশ্বিক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সব দেশ পুঁজিবাজার চালু করেছে, আমরা করতে পারিনি, সেটার কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পুঁজিবাজারের বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও নেতিবাচক হিসেবে দেখবে।
পুঁজিবাজারে লেনদেন চালু করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সার্ভেইল্যান্স, সিডিবিএল সার্ভেইল্যান্স, স্টক এক্সচেঞ্জের আইটি আর ব্রোকারেজ হাউসের কমকর্তার অংশগ্রহণ প্রয়োজন। লেনদেনের জন্য ব্যাংক খুব প্রয়োজন। ব্যাংকে এখন সীমিত পরিসরে লেনদেন চলছে।
আমার হাউসে টাকা নেওয়ার জন্য কোনো বিনিয়োগকারীকে আসতে হয় না। বিনিয়োগকারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, লেনদেন শেষে ওই অ্যাকাউন্টে টাকা চলে যায়। নগদ লেনদেনের জন্যও আসতে হয় না। আমার ব্রোকারেজ হাউসের ছয়টা ব্যাংক হিসাব আছে। যেন গ্রাহক টাকা দিতে গিয়ে ব্যর্থ না হয়। একটি ব্যাংক বন্ধ থাকলে অন্যটি খোলা থাকে।
অন্যান্য দেশে অ্যাপসের মাধ্যমে লেনদেনেরে সুযোগ থাকলেও আমাদের নেই। অ্যাপস সচল নয়। আগামী ছয় মাসের মধ্যে ডিজিটাইজড করা হোক। চীনের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের কৌশলগত অংশীদার কারিগরি সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছে। আশা করি এ বিষয়টিতে জোর দিতে হবে।
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য মার্জিন ঋণের ক্ষেত্রে আগামী ছয় মাস সুদ স্থগিত করতে হবে। সরকার করোনায় ক্ষতির কথা বিবেচনা করে শিল্পোদোক্তাদের জন্য সুদ স্থগিত করেছে। পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর জন্যও সেটা করতে হবে। পাশাপাশি ৫ শতাংশ সুদহারে ঋণ দিতে হবে।
ব্রোকারেজ হাউসগুলো প্রায় দেড় মাস বন্ধ। লেনদেন চালু না হলে আরো বন্ধ থাকবে। ব্রোকারেজ হাউসগুলো এখন ক্ষতির মুখে পড়েছে। প্রত্যেকের জন্য আগামী ছয় মাসে কর্মচারীদের জন্য বেতন, ভাড়া ও মেইনটেন্যান্স খরচের ক্ষেত্রে সুবিধা দেওয়া হোক। স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হোক। বিনা মূল্যে চাচ্ছি না, ছয় মাসের ৫ শতাংশ সুদে ঋণ সুবিধা দেওয়া হোক। ব্রোকারেজ হাউসের মালিকরা সবাই ভালো ঋণগ্রহীতা। কারো বিরুদ্ধে খেলাপির কোনো অভিযোগ নেই।
পুঁজিবাজার খোলার বিষয়ে অনেকে বলছে এই পরিস্থিতিতে লেনদেন বেশি হবে না। কিন্তু ওয়ারেন বাফেট বিনিয়োগের বিষয়ে বলেছেন, পুঁজিবাজার থেকে যখন সবাই বেরিয়ে যায় তখন তিনি ঢোকেন, শেয়ার কেনেন। আবার সবাই যখন বাজারে ঢোকে তখন তিনি বাজার থেকে বেরিয়ে যান। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো। বাজার যখন বাড়ে তখন আমরা ঢুকি, একটু খারাপ হলে বেরিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অনেক কম্পানি আছে, যারা করোনা পরিস্থিতি পার হলেই ভালো করবে। সেই শেয়ার কিনে রাখলে ভালো মুনাফার সম্ভাবনা রয়েছে। সম্ভাবনাময় শেয়ার কিনতে বিনিয়োগকারীকে সুযোগ দিতে হবে। স্বল্প পরিমাণ লেনদেন হলেও তো লাভ! এখন সব কিছু বন্ধ রয়েছে। যা লেনদেন হবে তাতেও তো খরচের কিছুটা সমাধান হবে। স্টক এক্সচেঞ্জেরও লাভ হবে। বিনিয়োগকারী মূলধন উত্তোলনের সুযোগ পাবে।