বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক : রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীকে আত্মহত্যার প্ররোচনা মামলা দুই বছরেও শেষ হয়নি বিচার। এই মামলাটির কার্যক্রম করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। তবে রাষ্ট্রপক্ষের প্রত্যাশা, দ্রুত এই মামলায় রায় আসবে।
অরিত্রী ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে স্কুলে চলমান বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছিল। পরীক্ষার হলে মোবাইল নেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ২ ডিসেম্বর সে মোবাইল নিয়ে যায়। মোবাইল থেকে নকল করার অভিযোগে তাকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়।পরদিন ৩ ডিসেম্বর স্কুলে গেলেও তাকে পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হয়নি।
পরে অরিত্রীর মা-বাবাকে স্কুলে তলব করে জানানো হয়, নকল করার অভিযোগে অরিত্রীকে টিসি দেওয়া হবে। স্কুল থেকে ফিরে অরিত্রী নিজের ঘর বন্ধ করে গলায় ফাঁস দেয়। দুপুরে তাদের শান্তিনগরের বাসা থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় পরদিন ৪ ডিসেম্বর পল্টন থানায় তার বাবা দিলীপ অধিকারী বাদী হয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা দায়ের করেন।
বর্তমানে মামলাটি ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রবিউল আলমের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। সবশেষ গত ৫ জানুয়ারি অরিত্রীর মা বিউটি অধিকারীকে জেরা করা হয়েছে। এর বাইরে মামলাটিতে এখন পর্যন্ত তিন জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী তারিখ ৮ ফেব্রুয়ারি।
এর আগে, ২০১৯ সালের ২০ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক কাজী কামরুল ইসলাম মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও শাখাপ্রধান জিনাত আক্তারকে মামলার আসামি করা হয়।
অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় শ্রেণিশিক্ষিক হাসনা হেনাকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয় অভিযোগপত্রে। ওই বছরেরই ১০ জুলাই ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রবিউল আলম অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত দুই আসামির বিরুদ্ধে অবিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
মামলাটির বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাবিনা আক্তার (দিপা) বলেন, মামলাটির বিচারকাজ শেষ করতে আমরা তৎপর রয়েছি। মামলাটিতে তিন জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। অরিত্রীর মায়ের জেরা শেষ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সাক্ষী এনে মামলাটির বিচারকাজ দ্রুত এগিয়ে নেব। মামলাটির বিচার যেন দ্রুত শেষ হয় এবং ভুক্তভোগীরা যেন ন্যায় বিচার পায়, আমরা এজন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।
অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী বলেন, মেয়েকে তো আর ফিরে পাব না। তবে যাদের জন্য তাকে অকালে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার জন্য আইনি লড়াই লড়ে যাব। আর কোনো মা-বাবাকে যেন আমাদের পরিণতি বরণ করতে না হয়। মেয়ের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ লড়ে যাব।
তিনি বলেন, আমার মেয়ে আমার ঘর আনন্দে ভরিয়ে রাখত। তারা তো মেয়েটাকে বাঁচতে দিলো না। প্রতিটা জায়গায় তার স্মৃতি রয়ে গেছে। ও যে ঘরে ছিল, সেই ঘরটা এখনো আগের মতোই রয়েছে। শুধু অরিত্রী নেই। আর সইতে পারি না। মেয়েটা চলে গেছে, কিছুই করতে পারিনি। এখন বাসাটাও ছেড়ে দেবো। যদি ক্ষণিকের জন্যও তার স্মৃতি ভুলে থাকতে পারি, কষ্টটা একটু হালকা হয়।
অরিত্রীর মা বিউটি অধিকারীর বলেন, দুইটা বছর মেয়েটাকে আর দেখি না। ওকে ছাড়া ভীষণ কষ্টে দিন কাটছে। হাঁটতে-চলতে ওর কথা মনে পড়ে। রান্নাঘর বা বারান্দায় যখন দাঁড়িয়ে থাকি, কোনো মেয়েকে স্কুল ড্রেস যেতে দেখলেই মনের ভেতর হাহাকার শুরু হয়। তখন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারি না।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর পরীক্ষা চলাকালে অরিত্রীর কাছে মোবাইল ফোন পান শিক্ষক। মোবাইল ফোনে নকল করেছে— এমন অভিযোগে অরিত্রীর মা-বাবাকে নিয়ে পরদিন স্কুলে যেতে বলা হয়। দিলীপ অধিকারী তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে স্কুলে গেলে ভাইস প্রিন্সিপাল তাদের অপমান করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন।
অধ্যক্ষের কক্ষে গেলে তিনিও একই রকম আচরণ করেন। এ সময় অরিত্রী দ্রুত অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। পরে তারা বাসায় গিয়ে দেখেন, অরিত্রী তার কক্ষে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়নায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় ঝুলছে। এ ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্কুল কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় স্কুলের অধ্যক্ষসহ তিন শিক্ষকেকে বরখাস্ত করা হয়।
বিজনেস আওয়ার/০৯ জানুয়ারি, ২০২০/এ