বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক : বৈশ্বিক কহামারি করোনার প্রথম ধাক্কায় দেশের অর্থনীতি ঠিকঠাক ছিল বলেই জানিয়েছিল সরকার। তবে করোনার দ্বিতীয় ধাপে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি খাত রফতানি ও রেমিট্যান্স নিয়ে বেশ উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। রেমিট্যান্স এখন পর্যন্ত স্থিতিশীল হলেও রফতানি কমছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী কয়েক মাসে রফতানি ও রেমিট্যান্সে আঘাত লাগার আশঙ্কা বেশি। কারণ, দেশে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির অবনতি না হলেও ইউরোপজুড়ে এখনও করোনা তাণ্ডব চলছে। এর আঘাত যদি রফতানি ও রেমিট্যান্স খাতে লাগে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো দেশের অর্থনীতি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, মনে হচ্ছে করোনার দ্বিতীয় ধাপের প্রভাবে ইউরোপের রফতানি বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একইভাবে ইউরোপের দেশগুলো থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সেও আঘাত লাগতে পারে। যুক্তরাজ্যে নতুন ধরনের করোনাভাইরাস নতুন আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে।
তিনি মনে করেন, যদি এটার প্রভাব রফতানি ও রেমিট্যান্স খাতে পড়ে, তাহলে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে আমাদের দেশে যেহেতু করোনার আঘাত কম, সেহেতু অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির চাকা সচল থাকলে ধাক্কাটা সামাল দেওয়া সহজ হবে।
করোনাভাইরাস মহামারির শুরুর ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা লেগেছে রফতানি খাতে। অবশ্য দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স খাতে এখনও তেজিভাব দেখা যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স।
রেমিট্যান্সের কারণে ব্যাংকে তারল্যের সংকট দূর হয়েছে। এই রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার ফলে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা সহজ হয়েছে। রেমিট্যান্সের টাকায় ছোট ছোট হাজার হাজার উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে। এই রেমিট্যান্সে ভর করে বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর এই ছয় মাসে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, ডিসেম্বর মাসে ২০৫ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল ১৫৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার। মহামারির মধ্যেই চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দুই দশমিক ছয় বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ইউরোপজুড়ে যে তাণ্ডব চলছে, তাতে রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহে ধাক্কা লাগতে পারে। এরইমধ্যে রফতানি শ্লথ হয়ে পড়েছে। আবার এতদিন রেমিট্যান্স যেভাবে এসেছে, সেটার ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতিতে।
প্রসঙ্গত, মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে গত মার্চ থেকে কয়েক ধাপে ৬৬ দিনের ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সে সময় অর্থনীতির চাকা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলেও একমাত্র প্রবাসী আয় বাড়তে থাকে।
এদিকে করোনাভাইরাস মহামারির অভিঘাতে তৈরি পোশাক রফতানি এবং রেমিট্যান্স কমে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদন ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের’ জানুয়ারি সংখ্যায় এই ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ রফতানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এদিকে ঘুরে দাঁড়ানো রফতানি আয়ে ফের ধাক্কা লাগতে শুরু করেছে। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে আবার হোঁচট খেয়েছে রফতানি। করোনা মহামারিকালে বিদায়ী বছরের শেষ মাসে পণ্য রফতানি থেকে ৩৩১ কোটি ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের চেয়ে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ।
ডিসেম্বরের এই ধসের ধাক্কা ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেও (জুলাই-ডিসেম্বর) লেগেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে এই অর্থবছরে একই সময়ে রফতানি কমেছে শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ। যদিও অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে অর্থাৎ জুলাই-নভেম্বর সময়ে ১ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয় রফতানি আয়ে।
এ প্রসঙ্গে নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে এসেছে। এখন নতুন আদেশ খুব বেশি আসছে না। আগামী কয়েক মাস পরিস্থিতি খারাপ যাবে।
তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে অনিশ্চয়তা আর শঙ্কায় আমরা বিপর্যস্ত। করোনার টিকার প্রাপ্যতা এখনও নিশ্চিত হয়নি। আমাদের শঙ্কা, পোশাক রফতানির নিম্নমুখী প্রবণতা আগামী এপ্রিল পর্যন্ত থাকতে পারে।
এদিকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে তৈরি পোশাক রফতানি থেকে আয় হয়েছে এক হাজার ৫৫৪ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে তিন শতাংশ কম। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম চার দশমিক ১২ শতাংশ।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) পণ্য রফতানি থেকে বাংলাদেশ এক হাজার ৯২৩ কোটি ৩৪ লাখ (১৯ দশমিক ২৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে। এই ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল এক হাজার ৯৬৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল এক হাজার ৯৩০ কোটি ২১ লাখ ডলার।
বিজনেস আওয়ার/১২ জানুয়ারি, ২০২০/এ