ঢাকা , রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এখনো এফডিআর নির্ভর করে চলে স্টক এক্সচেঞ্জ

দেশের শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) প্রতিষ্ঠার পরে দীর্ঘ সময় পার করলেও এখনো এফডিআর এর সুদের উপর ভর করে চলছে। উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে উচ্চ বেতনে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হলেও ব্যবসায় কোন উন্নতি হচ্ছে না। তাই এফডিআর এর সুদ থেকে লভ্যাংশ নিয়েই তৃপ্ত থাকতে হচ্ছে শেয়ারহোল্ডারদের। এমনকি এফডিআর না থাকলে, অস্তিত্ব সংকটের শঙ্কায় পড়তে হতো স্টক এক্সচেঞ্জ দুটিকে।

শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বিজনেস আওয়ারকে বলেন, এরা এফডিআরেই চলবে। যেখানে তদবির করে নিয়োগ পাওয়া যায়, সেখানে ভালো কিছু আশা করা যায় না। অথচ স্টক এক্সচেঞ্জে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া উচিত। যারা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবসায় উন্নতি করতে সক্ষম। আর সিএসইতে তো লেনদেনই হয় না। এরা বসে বসে বেতন ভাতা নিতেছে। একইসঙ্গে পর্ষদের লোকজনও ভালো মিটিং ফি নিচ্ছে।

ডিএসইর ৫৪ বছর ও সিএসইর ২৫ বছরের দীর্ঘ পথচলায় উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে পরিচালনা পর্ষদ ও ম্যানেজমেন্টের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। উচ্চ বেতনে ম্যানেজমেন্টের লোকজন নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ারহোল্ডারদের ভাগ্যে পরিবর্তন হয়নি। এখনো এফডিআর থাকার কারনে স্টক এক্সচেঞ্জ দুটি মুনাফায় রয়েছে। আর ‘বি’ ক্যাটাগরির লভ্যাংশ দিতে পারছে।

২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত দেশের উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। তবে ২০১৩ সালের ২১ ডিমিউচ্যুয়ালাইজড হওয়ার মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রুপান্তরিত হয়। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জকে লভ্যাংশ বিতরন করতে হচ্ছে। তবে এর আগে লভ্যাংশ বিতরন না করায়, তা স্টক এক্সচেঞ্জেই জমা হত। তবে এখন ‘বি’ ক্যাটাগরির লভ্যাংশ দেওয়ার পরেও আর অবশিষ্ট ফান্ড থাকে না। শুরুতে ডিএসইকে ৩ বছর ১০ শতাংশ করে লভ্যাংশ দিতে গিয়ে রিজার্ভ ব্যবহার করতে হয়েছে। তারপরেও ব্যবসায় কোন উন্নতি না হওয়ায় পরবর্তী ২ অর্থবছরে লভ্যাংশ ৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।

তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের ব্যবসায় আরও খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়েছে স্টক এক্সচেঞ্জ দুটি। এই অর্থবছরের পুরোটা সময়ই লেনদেনে ছিল মন্দা। তারপরেও আবার করোনাভাইরাসের কারনে ৬৬দিন লেনদেন বন্ধ ছিল। এছাড়া আইপিওতে আসা নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তির ফি স্টক এক্সচেঞ্জের আয়ের অন্যতম উৎস হলেও সেখানে রয়েছে ভাটা। এই আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানির তালিকাভুক্তির ফি থেকে ডিএসইর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয় হয় ৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা। যার পরিমাণ সিএসইতে হয় ৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

স্টক এক্সচেঞ্জের আয়ের প্রধান উৎস লেনদেন হলেও সুদজনিত আয়ই বেশি হয়। এই অবস্থায় নিজেদের স্বার্থেই স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন বাড়ানো উচিত। কিন্তু কম হওয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে বিএসইসিকে দোষারোপ করা হয়। অথচ নিজেদের স্বার্থেই এটা বাড়ানোর দায়িত্ব স্টক এক্সচেঞ্জের। লেনদেন বেশি হলে স্টক এক্সচেঞ্জ কমিশন পাবে। এর সাথে বিএসইসির কোন ব্যবসা নেই। তারপরেও লেনদেন বাড়ানোর জন্য বিএসইসিকে যতটা ভূমিকা রাখতে দেখা যায়, তা স্টক এক্সচেঞ্জের ক্ষেত্রে চোখে পড়ে না।

স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবসায় উন্নতি না হলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে কম ব্যয় হয় না। উচ্চ বেতনে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হলেও ব্যবসা হয় গতানুগতিক।

বিএসইসি শেয়ারবাজারের প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা হলেও স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তাদের বেতন অনেক বেশি। বিএসইসির সর্বোচ্চ কর্মকর্তা মাসে পৌনে ২ লাখ টাকা বেতন পেলেও ডিএসইর এমডির পেছনে ব্যয় হয় ১২ লাখ টাকা। আর সিএসইর এমডির পেছনে ব্যয় ৬ লাখ টাকা। এমনকি সিএসইর মাসিক গড়ে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে ব্যয় হয় ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা করে। যার পরিমাণ ডিএসইতে ৯২ হাজার টাকা। এছাড়া উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে পরিচালকদের পেছনে ফিবাবদ ব্যয়ের পরিমাণও কম না।

সিএসইর ৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেছনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ১৩ কোটি ২ লাখ টাকা। যা গড়ে প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য মাসে ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা করে ব্যয় হয়েছে। আর ১৩ পরিচালকের পেছনে বোর্ড মিটিং ও কমিটি মিটিং ফি বা সম্মানিবাবাদ ১৭ লাখ ১৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি পরিচালক পেয়েছেন ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা বা মাসিক হিসাবে ১১ হাজার টাকা।

অপরদিকে ডিএসইর ৩৫৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীরর পেছনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ৩৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। যা গড়ে প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য মাসে ৯২ হাজার টাকা করে ব্যয় হয়েছে। আর ১৩ পরিচালকের পেছনে বোর্ড মিটিং ও কমিটি মিটিং ফি বা সম্মানিবাবদ ৫৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি পরিচালক পেয়েছেন ৪ লাখ ১১ হাজার টাকা বা মাসিক হিসাবে ৩৪ হাজার টাকা।

এমন উচ্চ বেতন এবং শ্রমিক না থাকা সত্ত্বেও স্টক এক্সচেঞ্জ দুটিতে গার্মেন্টসের শ্রমিকদের ন্যায় ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিউপিপিএফ) গঠন করা হয়। এজন্য উভয় স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার ফান্ড গঠন করতে হয়। এই ফান্ড থেকে স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে অর্থ পান, তা পুরো বছর কাজ করেও পান না গার্মেন্টসসহ অন্যান্য খাতের শ্রমিকরা। তবে শ্রমিক কাজ না করায় বাংলাদেশ ব্যাংক এক নির্দেশনার মাধ্যমে ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানিতে শ্রমিক ফান্ড গঠন থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।

ডিএসইতে মুনাফার ৫ শতাংশ হারে গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬ কোটি ৫১ লাখ টাকার ফান্ড গঠন করা হয়। যা ডিএসইর ১২ লাখ টাকা সম্মানির এমডিসহ ৩৫৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সবাই পাবেন। অর্থাৎ গড়ে এই ফান্ড থেকে সবাই ১ লাখ ৮১ হাজার করে টাকা পাবেন। আর সিএসইতে গঠন করা ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ফান্ড ৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সবাই গড়ে ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা পাবেন।

এছাড়া স্টক এক্সচেঞ্জে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের ঘটনাও ঘটে। এমনও আছে বিশেষ ব্যক্তির প্রভাবে অনর্থকভাবে মাসিক ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে একজন ডাক্তার নিয়োগ দিয়ে রেখেছে ডিএসই। বেতনের সঙ্গে তার পেছনে আরও আনুষাঙ্গিক ব্যয় আছে। যিনি মাত্র ১ ঘন্টা ডিএসইতে দায়িত্ব পালন করেন। তবে ডিএসই এখন নিকুঞ্জে চলে গেলেও তিনি এখনো মতিঝিলেই ১ ঘন্টা সময় দেন। তবে এই সময়টা কাদের পেছনে দেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

ব্যাংকের এফডিআর থাকায় এখনো টিকে রয়েছে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ। স্টক এক্সচেঞ্জ ২টির মধ্যে ডিএসইর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিট মুনাফা হয়েছে ৯৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বা ইপিএস ৫৪ পয়সা। আর সিএসইর হয়েছে ৩৯ কোটি ৭ লাখ টাকা বা ইপিএস ০.৬২ টাকা। তবে আগামি অর্থবছর (২০২০-২১) থেকে কর সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে এবং পূর্ণ হারে প্রদান করতে হবে। যা স্টক এক্সচেঞ্জের মুনাফায় বড় ধাক্কা দেবে।

আরও পড়ুন…..
ডিএসইর এক ব্রোকারের থেকেও সিএসইর লেনদেন কম

ডিএসইর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট আয় হয়েছে ২১৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এরমধ্যে পরিচালন বা ব্যবসা থেকে আয় হয়েছে ১০৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আর এফডিআর ও বন্ড থেকে সুদজনিত আয় হয়েছে ৯৩ কোটি ৭ লাখ টাকা ও সিডিবিএল থেকে ২৫ শতাংশ হারে ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা লভ্যাংশ আয় হয়েছে। এছাড়া নানাবিধ আয় আছে ১৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।

এই স্টক এক্সচেঞ্জটির পরিচালন ব্যয় হয়েছে ৮১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। যাতে পরিচালন মুনাফা হয়েছে ২৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।

এদিকে সিএসইর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যবসা পরিচালনার থেকে সুদজনিত আয় বেশি হয়েছে। এ স্টক এক্সচেঞ্জটির ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পরিচালন আয় হয়েছে ৩৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর সুদজনিত আয় হয়েছে ৪৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর পরিচালন আয় থেকে পরিচালন মুনাফা হয়েছে মাত্র ৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।

২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে ডিএসইর এফডিআর রয়েছে ৬৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া বন্ডে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করেছে ৯৪ কোটি টাকা, সিডিবিএলে বিনিয়োগ ৮১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ও বন্ডে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ ৮ কোটি টাকা। এছাড়া ক্লিয়ারিং ও সেটেলমেন্টের জন্য নবনিবন্ধিত সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ লিমিটেডে (সিসিবিএল) ৪৫ শতাংশ মালিকানায় ১৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।

সিএসইর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শেষে এফডিআর রয়েছে ৪৪৬ কোটি টাকা। এছাড়া সিডিবিএলে বিনিয়োগ ৬১ কোটি ২৬ লাখ টাকা, সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ লিমিটেডে (সিসিবিএল) ৬০ কোটি টাকা ও বন্ডে ৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে।

১ হাজার ৮০৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের ডিএসইতে নিট ১ হাজার ৯২০ কোটি ৮৪ লাখ টাকার নিট সম্পদ রয়েছে। যা শেয়ারপ্রতি বিবেচনায় রয়েছে (এনএভিপিএস) ১০.৬৫ টাকা। আর ৬৩৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের সিএসইতে নিট সম্পদ রয়েছে ৭৪৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকার বা এনএভিপিএস ১১.৮০ টাকা।

এ বিষয়ে সিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন-উর-রশীদ বিজনেস আওয়ারকে বলেন, অনেকটা এফডিআরের উপর চলতে হচ্ছে, এ কথা সত্য। ডিএসইর লেনদেন ১ হাজার কোটি টাকা না হলে ব্রেক ইভেনে পৌছাতে পারে না। আমাদের ক্ষেত্রেও একটি নির্দিষ্ট লেনদেন না হলে ব্রেক ইভেন হয় না। যদি না এফডিআর বিবেচনা করি। এই এফডিআরের সুদের উপর স্টক এক্সচেঞ্জ কতদিন নির্ভর করে চলবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মানুষ যদি শেয়ার কিনতে না চায়, তাহলে কি করার যাবে। তারপরেও বন্ড ও ডেরিভেটিবস মার্কেট উন্নয়নের কাজ চলছে। এখন এগুলোতো আমরা করতে পারি না। এগুলোর জন্য নীতি সহযোগিতা প্রয়োজন।

একই বিষয়ে জানতে ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সানাউল হকের ব্যক্তিগত ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এছাড়া ম্যাসেজ দিলেও তিনি প্রতিউত্তর করেননি।

বিজনেস আওয়ার/২১ জুন, ২০২০/আরএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান:
ট্যাগ :

8 thoughts on “এখনো এফডিআর নির্ভর করে চলে স্টক এক্সচেঞ্জ

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার মেইলে তথ্য জমা করুন

এখনো এফডিআর নির্ভর করে চলে স্টক এক্সচেঞ্জ

পোস্ট হয়েছে : ১১:০৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২১ জুন ২০২০

দেশের শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) প্রতিষ্ঠার পরে দীর্ঘ সময় পার করলেও এখনো এফডিআর এর সুদের উপর ভর করে চলছে। উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে উচ্চ বেতনে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হলেও ব্যবসায় কোন উন্নতি হচ্ছে না। তাই এফডিআর এর সুদ থেকে লভ্যাংশ নিয়েই তৃপ্ত থাকতে হচ্ছে শেয়ারহোল্ডারদের। এমনকি এফডিআর না থাকলে, অস্তিত্ব সংকটের শঙ্কায় পড়তে হতো স্টক এক্সচেঞ্জ দুটিকে।

শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বিজনেস আওয়ারকে বলেন, এরা এফডিআরেই চলবে। যেখানে তদবির করে নিয়োগ পাওয়া যায়, সেখানে ভালো কিছু আশা করা যায় না। অথচ স্টক এক্সচেঞ্জে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া উচিত। যারা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবসায় উন্নতি করতে সক্ষম। আর সিএসইতে তো লেনদেনই হয় না। এরা বসে বসে বেতন ভাতা নিতেছে। একইসঙ্গে পর্ষদের লোকজনও ভালো মিটিং ফি নিচ্ছে।

ডিএসইর ৫৪ বছর ও সিএসইর ২৫ বছরের দীর্ঘ পথচলায় উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে পরিচালনা পর্ষদ ও ম্যানেজমেন্টের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। উচ্চ বেতনে ম্যানেজমেন্টের লোকজন নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ারহোল্ডারদের ভাগ্যে পরিবর্তন হয়নি। এখনো এফডিআর থাকার কারনে স্টক এক্সচেঞ্জ দুটি মুনাফায় রয়েছে। আর ‘বি’ ক্যাটাগরির লভ্যাংশ দিতে পারছে।

২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত দেশের উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। তবে ২০১৩ সালের ২১ ডিমিউচ্যুয়ালাইজড হওয়ার মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রুপান্তরিত হয়। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জকে লভ্যাংশ বিতরন করতে হচ্ছে। তবে এর আগে লভ্যাংশ বিতরন না করায়, তা স্টক এক্সচেঞ্জেই জমা হত। তবে এখন ‘বি’ ক্যাটাগরির লভ্যাংশ দেওয়ার পরেও আর অবশিষ্ট ফান্ড থাকে না। শুরুতে ডিএসইকে ৩ বছর ১০ শতাংশ করে লভ্যাংশ দিতে গিয়ে রিজার্ভ ব্যবহার করতে হয়েছে। তারপরেও ব্যবসায় কোন উন্নতি না হওয়ায় পরবর্তী ২ অর্থবছরে লভ্যাংশ ৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।

তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের ব্যবসায় আরও খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়েছে স্টক এক্সচেঞ্জ দুটি। এই অর্থবছরের পুরোটা সময়ই লেনদেনে ছিল মন্দা। তারপরেও আবার করোনাভাইরাসের কারনে ৬৬দিন লেনদেন বন্ধ ছিল। এছাড়া আইপিওতে আসা নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তির ফি স্টক এক্সচেঞ্জের আয়ের অন্যতম উৎস হলেও সেখানে রয়েছে ভাটা। এই আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানির তালিকাভুক্তির ফি থেকে ডিএসইর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয় হয় ৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা। যার পরিমাণ সিএসইতে হয় ৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

স্টক এক্সচেঞ্জের আয়ের প্রধান উৎস লেনদেন হলেও সুদজনিত আয়ই বেশি হয়। এই অবস্থায় নিজেদের স্বার্থেই স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন বাড়ানো উচিত। কিন্তু কম হওয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে বিএসইসিকে দোষারোপ করা হয়। অথচ নিজেদের স্বার্থেই এটা বাড়ানোর দায়িত্ব স্টক এক্সচেঞ্জের। লেনদেন বেশি হলে স্টক এক্সচেঞ্জ কমিশন পাবে। এর সাথে বিএসইসির কোন ব্যবসা নেই। তারপরেও লেনদেন বাড়ানোর জন্য বিএসইসিকে যতটা ভূমিকা রাখতে দেখা যায়, তা স্টক এক্সচেঞ্জের ক্ষেত্রে চোখে পড়ে না।

স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবসায় উন্নতি না হলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে কম ব্যয় হয় না। উচ্চ বেতনে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হলেও ব্যবসা হয় গতানুগতিক।

বিএসইসি শেয়ারবাজারের প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা হলেও স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তাদের বেতন অনেক বেশি। বিএসইসির সর্বোচ্চ কর্মকর্তা মাসে পৌনে ২ লাখ টাকা বেতন পেলেও ডিএসইর এমডির পেছনে ব্যয় হয় ১২ লাখ টাকা। আর সিএসইর এমডির পেছনে ব্যয় ৬ লাখ টাকা। এমনকি সিএসইর মাসিক গড়ে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে ব্যয় হয় ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা করে। যার পরিমাণ ডিএসইতে ৯২ হাজার টাকা। এছাড়া উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে পরিচালকদের পেছনে ফিবাবদ ব্যয়ের পরিমাণও কম না।

সিএসইর ৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেছনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ১৩ কোটি ২ লাখ টাকা। যা গড়ে প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য মাসে ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা করে ব্যয় হয়েছে। আর ১৩ পরিচালকের পেছনে বোর্ড মিটিং ও কমিটি মিটিং ফি বা সম্মানিবাবাদ ১৭ লাখ ১৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি পরিচালক পেয়েছেন ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা বা মাসিক হিসাবে ১১ হাজার টাকা।

অপরদিকে ডিএসইর ৩৫৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীরর পেছনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ৩৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। যা গড়ে প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য মাসে ৯২ হাজার টাকা করে ব্যয় হয়েছে। আর ১৩ পরিচালকের পেছনে বোর্ড মিটিং ও কমিটি মিটিং ফি বা সম্মানিবাবদ ৫৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি পরিচালক পেয়েছেন ৪ লাখ ১১ হাজার টাকা বা মাসিক হিসাবে ৩৪ হাজার টাকা।

এমন উচ্চ বেতন এবং শ্রমিক না থাকা সত্ত্বেও স্টক এক্সচেঞ্জ দুটিতে গার্মেন্টসের শ্রমিকদের ন্যায় ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিউপিপিএফ) গঠন করা হয়। এজন্য উভয় স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার ফান্ড গঠন করতে হয়। এই ফান্ড থেকে স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে অর্থ পান, তা পুরো বছর কাজ করেও পান না গার্মেন্টসসহ অন্যান্য খাতের শ্রমিকরা। তবে শ্রমিক কাজ না করায় বাংলাদেশ ব্যাংক এক নির্দেশনার মাধ্যমে ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানিতে শ্রমিক ফান্ড গঠন থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।

ডিএসইতে মুনাফার ৫ শতাংশ হারে গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬ কোটি ৫১ লাখ টাকার ফান্ড গঠন করা হয়। যা ডিএসইর ১২ লাখ টাকা সম্মানির এমডিসহ ৩৫৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সবাই পাবেন। অর্থাৎ গড়ে এই ফান্ড থেকে সবাই ১ লাখ ৮১ হাজার করে টাকা পাবেন। আর সিএসইতে গঠন করা ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ফান্ড ৮৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সবাই গড়ে ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা পাবেন।

এছাড়া স্টক এক্সচেঞ্জে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের ঘটনাও ঘটে। এমনও আছে বিশেষ ব্যক্তির প্রভাবে অনর্থকভাবে মাসিক ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে একজন ডাক্তার নিয়োগ দিয়ে রেখেছে ডিএসই। বেতনের সঙ্গে তার পেছনে আরও আনুষাঙ্গিক ব্যয় আছে। যিনি মাত্র ১ ঘন্টা ডিএসইতে দায়িত্ব পালন করেন। তবে ডিএসই এখন নিকুঞ্জে চলে গেলেও তিনি এখনো মতিঝিলেই ১ ঘন্টা সময় দেন। তবে এই সময়টা কাদের পেছনে দেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

ব্যাংকের এফডিআর থাকায় এখনো টিকে রয়েছে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ। স্টক এক্সচেঞ্জ ২টির মধ্যে ডিএসইর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিট মুনাফা হয়েছে ৯৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বা ইপিএস ৫৪ পয়সা। আর সিএসইর হয়েছে ৩৯ কোটি ৭ লাখ টাকা বা ইপিএস ০.৬২ টাকা। তবে আগামি অর্থবছর (২০২০-২১) থেকে কর সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে এবং পূর্ণ হারে প্রদান করতে হবে। যা স্টক এক্সচেঞ্জের মুনাফায় বড় ধাক্কা দেবে।

আরও পড়ুন…..
ডিএসইর এক ব্রোকারের থেকেও সিএসইর লেনদেন কম

ডিএসইর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট আয় হয়েছে ২১৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এরমধ্যে পরিচালন বা ব্যবসা থেকে আয় হয়েছে ১০৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আর এফডিআর ও বন্ড থেকে সুদজনিত আয় হয়েছে ৯৩ কোটি ৭ লাখ টাকা ও সিডিবিএল থেকে ২৫ শতাংশ হারে ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা লভ্যাংশ আয় হয়েছে। এছাড়া নানাবিধ আয় আছে ১৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।

এই স্টক এক্সচেঞ্জটির পরিচালন ব্যয় হয়েছে ৮১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। যাতে পরিচালন মুনাফা হয়েছে ২৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।

এদিকে সিএসইর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যবসা পরিচালনার থেকে সুদজনিত আয় বেশি হয়েছে। এ স্টক এক্সচেঞ্জটির ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পরিচালন আয় হয়েছে ৩৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর সুদজনিত আয় হয়েছে ৪৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর পরিচালন আয় থেকে পরিচালন মুনাফা হয়েছে মাত্র ৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।

২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে ডিএসইর এফডিআর রয়েছে ৬৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া বন্ডে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করেছে ৯৪ কোটি টাকা, সিডিবিএলে বিনিয়োগ ৮১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ও বন্ডে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ ৮ কোটি টাকা। এছাড়া ক্লিয়ারিং ও সেটেলমেন্টের জন্য নবনিবন্ধিত সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ লিমিটেডে (সিসিবিএল) ৪৫ শতাংশ মালিকানায় ১৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।

সিএসইর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শেষে এফডিআর রয়েছে ৪৪৬ কোটি টাকা। এছাড়া সিডিবিএলে বিনিয়োগ ৬১ কোটি ২৬ লাখ টাকা, সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ লিমিটেডে (সিসিবিএল) ৬০ কোটি টাকা ও বন্ডে ৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে।

১ হাজার ৮০৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের ডিএসইতে নিট ১ হাজার ৯২০ কোটি ৮৪ লাখ টাকার নিট সম্পদ রয়েছে। যা শেয়ারপ্রতি বিবেচনায় রয়েছে (এনএভিপিএস) ১০.৬৫ টাকা। আর ৬৩৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের সিএসইতে নিট সম্পদ রয়েছে ৭৪৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকার বা এনএভিপিএস ১১.৮০ টাকা।

এ বিষয়ে সিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন-উর-রশীদ বিজনেস আওয়ারকে বলেন, অনেকটা এফডিআরের উপর চলতে হচ্ছে, এ কথা সত্য। ডিএসইর লেনদেন ১ হাজার কোটি টাকা না হলে ব্রেক ইভেনে পৌছাতে পারে না। আমাদের ক্ষেত্রেও একটি নির্দিষ্ট লেনদেন না হলে ব্রেক ইভেন হয় না। যদি না এফডিআর বিবেচনা করি। এই এফডিআরের সুদের উপর স্টক এক্সচেঞ্জ কতদিন নির্ভর করে চলবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মানুষ যদি শেয়ার কিনতে না চায়, তাহলে কি করার যাবে। তারপরেও বন্ড ও ডেরিভেটিবস মার্কেট উন্নয়নের কাজ চলছে। এখন এগুলোতো আমরা করতে পারি না। এগুলোর জন্য নীতি সহযোগিতা প্রয়োজন।

একই বিষয়ে জানতে ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সানাউল হকের ব্যক্তিগত ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এছাড়া ম্যাসেজ দিলেও তিনি প্রতিউত্তর করেননি।

বিজনেস আওয়ার/২১ জুন, ২০২০/আরএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান: