বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে পাবলিক কোম্পানি এবং তার অধীনস্থ কোম্পানিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনে কিছু নির্দেশনা দেওয়া আছে। যা পরিপালন না করেই স্টার অ্যাডহেসিভে এমডির দায়িত্ব পালন করছেন আজিজ আল কায়সার। যিনি আইনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পাবলিক কোম্পানি স্টার অ্যাডহেসিভের পাশাপাশি আরও ৯ কোম্পানিতে একই পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া কোম্পানিটিতে শ্রম আইনেরও ব্যত্যয় ঘটেছে।
১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ১০৯ ধারায় বলা আছে, এই আইন প্রবর্তনের পর কোনো পাবলিক কোম্পানি এবং তার অধীনস্থ কোনো প্রাইভেট কোম্পানি কোন ব্যক্তিকে এমডি পদে নিয়োগ করিবে না, যদি তিনি অন্তত্বপক্ষে অপর একটি কোম্পানির এমডি বা ম্যানেজার পদে থাকেন।
তবে আজিজ আল কায়সার পাবলিক কোম্পানি স্টার অ্যাডহেসিভে এমডি পদে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আরও ৯ কোম্পানিতে একই পদে রয়েছেন।
প্রসপেক্টাসের ৬৫ অনুযায়ি, আজিজ আল কায়সার স্টার পার্টিকল বোর্ড মিলস, পারটেক্স ফার্নিচার ইন্ডাস্ট্রিজ, পারটেক্স লামিনেটস, পারটেক্স পিভিসি ইন্ডাস্ট্রিজ, স্টার জিপসাম বোর্ড মিলস, কর্ভি মারিটাইম, পারটেক্স কেবলস, পারটেক্স বিল্ডার্স ও পারটেক্স এরোমেরিন লজিস্টিকসে এমডি পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট নোমান মাহমুদ বিজনেস আওয়ারকে বলেন, একজন ব্যক্তি কোন পাবলিক কোম্পানি বা তার অধীনস্থ কোম্পানিতে এমডি পদে নিয়োগ পাবেন না, যদি তিনি অন্য যেকোন কোম্পানিতে এমডি বা ম্যানেজার পদে থাকেন। অর্থাৎ সে যেই কোম্পানিতেই এমডি বা ম্যানেজার পদে থাকুক না কেনো, সে কোন পাবলিক এবং তার অধীনস্থ কোম্পানিতে এমডি পদে নিয়োগ পাবে না। সেটা পাবলিক কোম্পানির এমডি অধীনস্থ কোম্পানিতে হোক বা অধীনস্থ কোম্পানির এমডি পাবলিক কোম্পানিতে হোক। এছাড়াও অন্য যেকোন কোম্পানির এমডি বা ম্যানেজার পাবলিক এবং তার অধীনস্থ কোম্পানির এমডি হতে পারবে না। তবে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষ হতে পারবে।
আরও পড়ুন…..
শেয়ারবাজারে আসার আগে আড়াই মাসে ২০ লাখ টাকার স্টার অ্যাডহেসিভ ১৫ কোটি
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত ২২ মার্চ স্টার অ্যাডহেসিভের অফিসে কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মো. জুলফিকার আলী, কোম্পানি সচিব আসলাম মিয়া ও পারটেক্স স্টার গ্রুপের হেড অব বিজনেস ডেভেলপমেন্টের মো. শিব্বির হোসাইন বক্তব্য দেন। তারা বলেন, প্যারেন্ট বা হোল্ডিং কোম্পানির এমডি সাবসিডিয়ারির এমডি হতে পারবে না। একইভাবে সাবসিডিয়ারির এমডি প্যারেন্ট বা হোল্ডিং কোম্পানির এমডি হতে পারবে না। তবে আজিজ আল কায়সার স্টার অ্যাডহেসিভে এমডি পদে থাকলেও তিনি ওই কোম্পানির কোন সাবসিডিয়ারি বা প্যারেন্ট কোম্পানিতে একইপদে নেই। তাই তিনি এর বাহিরে অন্যসব কোম্পানিতে এমডি পদে থাকলেও সেক্ষেত্রে আইনে বাধা নেই।
কিন্তু সাবসিডিয়ারি বা প্যারেন্ট কোম্পানি ছাড়াও অন্য কোম্পানিতে এমডির দায়িত্ব পালনের জন্য বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলীহুসাইন আকবারআলীকে সরকারের অনুমোদন নিতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলসের প্রসপেক্টাস অনুযায়ি, আলীহুসাইন আকবারআলী বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলসের পাশাপাশি তিনি আরও ৬ কোম্পানিতে এমডি পদে দায়িত্ব পালন করেন। যেগুলো সাবসিডিয়ারি বা প্যারেন্ট কোম্পানি না।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সাবেক প্রধান নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা (সিআরও) মোহাম্মদ সামসুর রহমান (এফসিএমএ) বিজনেস আওয়ারকে বলেন, কোন কোম্পানির এমডি বা ম্যানেজার পাবলিক কোম্পানিতে বা তার অধীনস্থ কোম্পানিতে এমডি পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এটা আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে। এর আলোকেই স্টক এক্সচেঞ্জ কাজ করে। যাতে করে গত কয়েক বছর শেয়ারবাজারে আসা কোম্পানিগুলোর এমডিকে অন্য কোন কোম্পানিতে একইপদে দেখা যায়নি। কেউ যদি শেয়ারবাজারে আসার আগে একাধিক কোম্পানিতে এমডি পদে থেকেও থাকে, তাহলে আইপিওতে ফাইল সাবমিট করার আগে অন্যসব প্রতিষ্ঠানে এমডির দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আসে।
এছাড়া যেসব তালিকাভুক্ত কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা আগে থেকে বিভিন্ন কোম্পানিতে একই পদে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন, তাদেরকে সংশোধনের জন্য সিএসইর পক্ষ থেকে বলা হয় বলে জানান সিএসইর এই সাবেক সিআরও। যার ধারাবাহিকতায় অনেক তালিকাভুক্ত কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিষয়টি সমাধান করেছেন। কেউ সরকার থেকে অনুমোদন নিয়ে, আবার কেউ অন্যসব কোম্পানির এমডির দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে।
এদিকে শ্রম আইনেরও ব্যত্যয় ঘটেছে স্টার অ্যাডহেসিভ। এ কোম্পানিটিতে ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডে (ডব্লিউপিপিএফ) ২৫ লাখ ৬৭ হাজার টাকা রয়েছে। এরমধ্যে আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) ৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা অন্তর্ভূক্ত আছে। কিন্তু আইনে নির্ধারিত সময়ে বিতরন করেনি।
২০০৬ সালের শ্রম আইনের ২৩২ ধারা অনুযায়ি, অর্থবছর শেষ হওয়ার ৯ মাসের মধ্যে ফান্ড বিতরনের বিধান রয়েছে। এ হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের ডব্লিউপিপিএফ ফান্ড ২০২১ সালের মার্চের মধ্যে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ওই ফান্ড কর্মীদের মধ্যে বিতরন না করে তাদেরকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন স্টার অ্যাডহেসিভ কর্তৃপক্ষ।
প্রসপেক্টাসের ৬ পৃষ্টা অনুযায়ি, স্টার অ্যাডহেসিভের উদ্যোক্তা (প্রোমোটর) আজিজ আল কায়সার ও আজিজ আল মাহমুদ। কিন্তু ১৫৪ পৃষ্টায় তাবাসসুম কায়সারকে স্পন্সর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যে ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর আজিজ আল কায়সারের থেকে হস্তান্তরের মাধ্যমে শেয়ার পেয়ে প্রথম মালিকানায় আসে। যার নাম সাবস্ক্রাইবার টু দ্য মেমোরেন্ডাম ও আর্টিক্যালস অব এসোসিয়েশনে নেই। কিন্তু বিএসইসির আইনে বলা হয়েছে, স্পন্সর মানে যার নাম সাবস্ক্রাইবার টু দ্য মেমোরেন্ডাম ও আর্টিক্যালস অব এসোসিয়েশনে আছে।
সাবস্ক্রাইবার টু দ্য মেমোরেন্ডাম ও আর্টিক্যালস অব এসোসিয়েশনে নাম না থাকা সত্ত্বেও তাবাসসুম কায়সারের উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়ে তারা বলেন, তিনি উত্তরাধিকারী হিসাবে কোম্পানির প্রমোটর ও এমডির থেকে শেয়ার পেয়েছেন। যারা প্রমোটরের থেকে উত্তরাধীকারী সূত্রে শেয়ার পায়, তারা উদ্যোক্তা হিসাবে গণ্য হয়।
বিএসইসির পাবলিক ইস্যু রুলসের স্পন্সরের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যাদের নাম সাবস্ক্রাইবার টু দ্য মেমোরেন্ডাম ও আর্টিক্যালস অব এসোসিয়েশনে নাম, তারা স্পন্সর।
এদিকে স্টার অ্যাডহেসিভের প্রসপেক্টাসের ১৫৯ পৃষ্টায়, ডাইলুটেড ইপিএস বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জের নির্দেশনা অনুযায়ি সব কোম্পানি ডাইলুটেড বলে বর্তমান শেয়ার দিয়ে অতিতের ইপিএস গণনা করলেও স্টার অ্যাডহেসিভে তা করা হয়নি। এ কোম্পানি কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট অর্থবছরের ডাইলুটেড ইপিএস গণনায় ওই বছরের শেষ যে পরিমাণ শেয়ার ছিল, তা দিয়ে গণনা করেছে।
এ বিষয়ে সিএসইর সাবেক সিআরও সামসুর রহমান বলেন, আসলে ডাইলুটেড ইপিএস ভিন্ন জিনিস। আমাদের দেশে ডাইলুটেড ইপিএস গণনার সুযোগ নেই বলা যায়। তবে শেয়ারবাজারে আসতে চাওয়া কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে সর্বশেষ বিদ্যমান শেয়ার দিয়ে বিগত বছরের ইপিএস গণনা করে দেখাতে বলা হয়। যেমন ২০২০-২১ অর্থবছরের শেষের শেয়ার দিয়ে বিগত অর্থবছরের নিট মুনাফাকে ভাগ করে ইপিএস গণনা করা। যেটাকে অনেকে ডাইলুটেড ইপিএস বলে। এমন না যে বিগত বছরের ইপিএস গণনায় শুধু সংশ্লিষ্ট বছরের শেয়ার দিয়ে ওই বছরের ইপিএস গণনা করা।
সম্প্রতি শেয়ারবাজারে আসা কৃষিবিদ ফিডেও তেমনটিই দেখা গেছে। এই কোম্পানিটির ডাইলুটেড ইপিএস বলে প্রসপেক্টাসে প্রকাশিত সর্বশেষ ২০২০ সালের ৩০ জুনের ২ কোটি ৭৫ লাখ শেয়ার দিয়ে বিগত বছরগুলোর ইপিএস গণনা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে স্টার অ্যাডহেসিভের কর্মকর্তারা বলেন, বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জর নির্দেশনার আলোকেই ডাইলুটেড ইপিএস দেখানো হয়েছে। তারা ডাইলুটেড বলতে নির্দিষ্ট বছরের শেয়ার দিয়ে ওই বছরের মুনাফাকে ভাগ করে ডাইলুটেড ইপিএস গণনা করতে বলেছেন। আর আইনে বেধেঁ দেওয়া সময়ে শ্রমিক ফান্ডের টাকা বিতরন না করার বিষয়ে স্টার অ্যাডহেসিভের ওই ৩ কর্মকর্তা জানান, ওই সময়ের মধ্যে না দিলেও ২০২১ সালের জুলাই মাসের দিকে বিতরন করা হয়েছে।
বিজনেস আওয়ার/২৪ মার্চ, ২০২২/আরএ
2 thoughts on “স্টার অ্যাডহেসিভে আজিজ আল কায়সারের নিয়োগে আইনের ব্যত্যয়”