পাঁচ টাকার উপরে শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) দেখিয়ে শেয়ারবাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) টাকা সংগ্রহ করা ফার কেমিক্যাল এখন লোকসান কাটাতেই হিমশিম খাচ্ছে। এরমধ্যে আবার কারখানা স্থানান্তরে বন্ধ হয়ে গেছে উৎপাদন। তবে এই স্থানান্তরের আগেই কমে এসেছে পণ্য বিক্রি। অথচ ব্যবসা বাড়ানোর জন্য শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া নিয়মিত বোনাস শেয়ার দেওয়ার মাধ্যমে রেখে দেওয়া হয় কোম্পানির মুনাফা।
শেয়ারবাজারে আসার আগে কোম্পানিগুলোর অতিরঞ্জিত মুনাফা দেখানোর অভিযোগ দীর্ঘদিনের। নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে আইপিও অনুমোদন এবং বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য এমন মুনাফা দেখানো হয়। তবে তালিকাভুক্তির পরবর্তীতে সেই মুনাফার ধারা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। কারন মুনাফার সঙ্গে লভ্যাংশ প্রদানের বাধ্যবাধকতার সর্ম্পক্য আছে। কেউ যদি ভালো মুনাফা করে লভ্যাংশ না দেয়, তাহলে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তাই আইপিও পূর্ব অতিরঞ্জিত মুনাফা দেখানো কোম্পানিগুলোর পরবর্তীতে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে পতনের চিত্র উঠে আসে।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পরে ধারাবাহিক পতনে থাকা ফার কেমিক্যালের গত অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০) ৩১ কোটি ৩৪ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছিল। যা কমে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে নেমে এসেছে ৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকায়। অর্থাৎ বিক্রি কমেছে ২৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকার বা ৮৯ শতাংশ।
এদিকে দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২১) কোম্পানিটির কোন পণ্য বিক্রি হয়নি। কিন্তু আগের অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিক্রি হয়েছিল ১৩ কোটি ১১ লাখ টাকা।
ব্যবসায় এই পতনের বিষয়ে ফার কেমিক্যালের চলতি অর্থবছরের ১ম ও ২য় প্রান্তিকের আর্থিক হিসাবে কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম ইপিজেড কুমিল্লা থেকে রুপগঞ্জে নিজস্ব জায়গায় স্থানান্তরকে উল্লেখ করা হয়েছে। এই স্থানান্তরের জন্য কোম্পানির দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোন পণ্য বিক্রি হয়নি।
তবে আগের অর্থবছরে বিক্রি স্বাভাবিক থাকলেও কোম্পানিটির ওই সময় মুনাফা করা সম্ভব হয়নি। আর এ বছর বিক্রি তলানিতে নেমে আসায় লোকসান আরও বেড়েছে।
দেখা গেছে, আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে ভালো বিক্রির পরেও ফার কেমিক্যালের নিট লোকসান হয়েছিল ৫৬ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ০.০৩ টাকা। যেটা এ বছরের প্রথমার্ধে বিক্রি ধসে বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ০.১৬ টাকা।
তবে ফার কেমিক্যালের ব্যবসা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর থেকেই ভালো যাচ্ছে না। টানা কোম্পানিটির মুনাফা কমছে। যাতে করে আইপিও পূর্ব ২০১২-১৩ অর্থবছরের ৫.০১ টাকার শেয়ারপ্রতি মুনাফা সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ০.১৬ টাকা লোকসানে নেমে এসেছে।
আরও পড়ুন….
লোকসান দেখাতে অস্বাভাবিক উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি : অন্যদের কমেছে
সাড়ে ৬ হাজার স্কয়ার ফিটের জমিতে ১৪৫০০ স্কয়ার ফিট আয়তনের ছাউনি-কাঠামো
ডিএসইর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সর্বশেষ ৫ অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ি, তালিকভুক্তির ৩য় অর্থবছরে (২০১৬-১৭) কোম্পানিটির নিট মুনাফা ২৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা বা ইপিএস ১.৭৯ টাকা হয়েছিল। এরপরে নিয়মিত কমেছে। যাতে করে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নিট মুনাফা ২৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ১.৪৮ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিট মুনাফা ২০ কোটি ৯২ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ১.০৫ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে নিট মুনাফা ৭ কোটি ২১ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ০.৩৩ টাকা হয়। তবে সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে কম হলেও মুনাফা ধরে রাখতে পারেনি। ওই অর্থবছরে কোম্পানিটির নিট ৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা বা শেয়ারপ্রতি ০.১৬ টাকা লোকসান হয়েছে।
অথচ ২০১৪ সালে ফার কেমিক্যালের মুনাফা বাড়ানোর জন্য শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করা হয়। এজন্য সাধারন বিনিয়োগকারীদের থেকে সংগ্রহ করা হয় ১২ কোটি টাকা। যা বিভিন্ন ডাইং ফ্যাক্টরীর জন্য কেমিক্যাল উৎপাদন ও রপ্তানিকারক ফার কেমিক্যালকে শেয়ারবাজারে আনতে ইস্যু ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করে ফার্স্ট সিকিউরিটিজ সার্ভিসেস লিমিটেড।
ব্যবসায় নিয়মিত পতনের পরেও ফার কেমিক্যালের পর্ষদ বোনাস শেয়ার দিয়ে অদক্ষতার প্রমাণ দিয়ে গেছেন। অথচ ব্যবসা সম্প্রসারনের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের সুযোগ থাকলে এই শেয়ার দেওয়া উচিত।
এ বিষয়ে ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বিজনেস আওয়ারকে বলেন, আপনি তখনই বোনাস শেয়ার দেবেন, যখন ব্যবসা সম্প্রসারনে সম্ভাবনা বা সুযোগ থাকবে। অন্যথায় কোম্পানির বোনাস দিয়ে মুনাফা রেখে দেওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। তবে আমাদের দেশে অধিকাংশ কোম্পানির পর্ষদ অহেতুক বোনাস শেয়ার দিয়ে মুনাফা রেখে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। অনেকটা মুনাফা সাধারন শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরন না করার নিম্ন মানসিকতা ও ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহারের জন্য এমনটি করা হয়ে থাকে। এছাড়া পর্ষদের শেয়ার ব্যবসায় টাকা কামানোর জন্য অনেকে অতিরঞ্জিত মুনাফা দেখায়। যাতে নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার সক্ষমতা থাকে না। এতে করে বোনাস শেয়ার দেয়। যা কোম্পানিটির জন্য পরবর্তীতে বাড়তি চাঁপ হয়ে দাঁড়ায়।
দেখা গেছে, আইপি পূর্বে ফার কেমিক্যালের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৭৯ কোটি ৩ লাখ টাকা। যা নিয়মিত বোনাস শেয়ারের মাধ্যমে এখন বেঁড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৮ কোটি ৯ লাখ টাকা। এই ১৩৯ কোটি ৬ লাখ টাকা বৃদ্ধি পাওয়া পরিশোধিত মূলধনের মধ্যে আইপিওর ১২ কোটি টাকা ছাড়া পুরোটাই বোনাস শেয়ার।
এ কোম্পানি কর্তৃপক্ষ আইপিও অর্থ ব্যবহার শেষ করার আগেই বোনাস শেয়ার দেওয়া শুরু করে। ২০১৪ সালের ৮ জুলাই আইপিও ফান্ড পাওয়া ফার কেমিক্যালের পর্ষদ ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ব্যবসায় ২০% বোনাস শেয়ার দেয়। এরপরে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২৫%, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২০% এবং ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০% করে বোনাস শেয়ার দেয়।
এ বিষয়ে জানতে গত ১৫ মার্চ বিকাল ৪টার দিকে ফার কেমিক্যালের কোম্পানি সচিব এবিএম গোলাম মোস্তফা বাশারকে ফোন দিলে তিনি বাহিরে আছেন উল্লেখ করে কোন মন্তব্য করেননি। এরপরে ১৬ মার্চ দুপুর ২টার দিকে ফোন দিলেও একই যুক্তি দেখান। তারপরে একইদিনে সাড়ে ৩টায় ফোন দিলে রিসিভ করেননি।
উল্লেখ্য ফার কেমিক্যালের একই গ্রুপের আর.এন স্পিনিং মিলস ও এমএল ডাইং নামের আরও দুটি কোম্পানি শেয়ারবাজারে রয়েছে। এরমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে আর.এন স্পিনিংয়ের কার্যক্রম। আর ২০১৮ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া এমএল ডাইংয়ের ব্যবসা নিম্নমূখী।
বিজনেস আওয়ার/৩১ মার্চ, ২০২২/আরএ