বিজনেস আওয়ার প্রতিবেদক : ঈদের আনন্দ কাছের মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য সেই আবহমান কাল থেকে ঢাকার বাসিন্দারা নাড়ির টানে গ্রামে ছোটে। আর ঢাকায় থেকে যাওয়া মানুষগুলো পরস্পরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, শুভেচ্ছা বিনিময়, স্বজনদের বাসায় ঢুঁ মারা, বৈকালিক আড্ডা, ক্ষেত্র বিশেষে বহুদিনের পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে মিট টুগেদারে ব্যাস্ত থাকে!
এসব সৌজন্যতা বা সামাজিকতা দেখানোর ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষদের চেয়ে রাজনীতিবিদরা বেশি এগিয়ে থাকেন। কারণ, যেসব মানুষের সমর্থন, ভোট ও সহযোগিতায় তারা ‘নেতা’ হয়ে ওঠেন, তাদের প্রতি রাজনীতিকদের দায়বদ্ধতা একটু বেশিই বৈকি।
সে কারণেই, দেশের পরিস্থিতি যাই থাকুক না কেন, দলের নেতাকর্মী সমর্থক এবং নির্বাচনি এলাকার সাধারণ মানুষদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা, সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করা, পাশে দাঁড়ানো এবং খোঁজ-খবর নেওয়ার কাজটি ঈদ উপলক্ষে নেতাদের করতেই হয়। তাই শত প্রতিকুলতার মধ্যেও নেতাদের ছুটে যেতে হয় গ্রামে। তারা ছুটে যানও বটে।
কিন্তু এবার পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। মহামারি করোনাভাইরাস পুরো পৃথিবীটাকে বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে সব হিসাব-নিকাশ। প্রতিটা মানুষ— হোক সে সাধারণ, অথবা অসাধারণ, নেতা অথবা সংগঠক, বড় অথবা ছোট, মহৎ অথবা ইতর, ক্ষমতাধর অথবা ক্ষমতাহীন— সবাই এখন ঘরবন্দি। ঘরে থাকাটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ!
এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির হাইকমান্ড থেকে সব পর্যায়ের নেতাকর্মী, সমর্থকদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে, যে যেখানে আছেন, সে সেখানেই পবিত্র ইদুল ফিতর উদযাপন করবেন। সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে নিজ নিজ পরিবারের সঙ্গে ঈদের দিনটা পার করবেন। সাধ্যমতো অন্যকে সহযোগিতা করবেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে।
অর্থাৎ যারা ঢাকায় আছেন, তারা ঢাকায় ঈদ করবেন। যারা নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে আটকা পড়েছেন, তারা এলাকাতেই ঈদ পালন করবেন। খুব প্রয়োজন না হলে ঈদ উপলক্ষে ঢাকা ত্যাগ অথবা গ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা না দেওয়ার ব্যাপারে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এখন সবচেয়ে বড় কাজটা হচ্ছে আমি নিজে যেন এই করোনাভাইরাসের কেরিয়ার না হই। অর্থাৎ আমি যেন ভাইরাসটি কারও মধ্যে ছড়িয়ে না দিই। সেজন্য সবার প্রতি অনুরোধ, যে যেখানে আছেন, সেখানেই ঈদ উদযাপন করুন। সংকট কেটে গেলে, পৃথিবী শান্ত হলে আমরা আবার মিলিত হব। একসঙ্গে ঈদ করব।
টানা চার ঈদ কারাগারে কাটানোর পর এবার গুলশানের ভাড়া বাসা ‘ফিরোজা’য় ঈদ করবেন বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ঈদের দিন যথারীতি মেজ বোন সেলিমা ইসলাম, ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার, শামীম এস্কান্দারের স্ত্রী কানিজ ফাতেমার সঙ্গে দেখার হওয়ার সমূহ সম্ভবনা রয়েছে।
এদিকে করোনাভাইরাসের কারণে সাধারণ মানুষ তো বটেই দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন না খালেদা জিয়া। তবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মাধ্যমে দেশবাসীর জন্য শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, কোনো প্রোগ্রাম থাকছে না। দলের নেতাকর্মীর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন না ম্যাডাম। এখন মূলত, যার যার জায়গায় সেভ থাকাটাই বেশি জরুরি। সে কারণে ঈদ উপলক্ষে ম্যাডামের কোনো প্রোগ্রাম রাখা হয়নি। তবে দেশবাসীকে ম্যাডাম শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুলের ঈদ
টানা ১২ বছর ধরে প্রবাসে ঈদ করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এবারও তিনি প্রবাসেই ঈদ করবেন। স্ত্রী-কন্যা, প্রয়াত ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী, তাদের দুই মেয়ে, দলের নেতাকর্মী, সমর্থকদের সঙ্গে লন্ডনে ঈদ করবেন তিনি।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঈদ করবেন ঢাকার উত্তরার বাসায়। করোনা দুর্যোগ শুরুর পর থেকেই কোয়ারেনটাইনে আছেন তিনি। মাঝে মধ্যে গুলশান কার্যালয়ে ব্রিফিং করা ছাড়া বাসা থেকে বের হন না তিনি। ঈদটাও কোয়ারেনটাইনেই হবে তার।
এবারের ঈদ সম্পর্কে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জীবনে এমন ঈদ আরেকবার এসেছিল। সেটা ছিল ১৯৭১। আতঙ্ক, শঙ্কা, দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে ঈদ করেছিলাম। এবারও আতঙ্ক, শঙ্কা, দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে ঈদ করতে হচ্ছে। তবে পার্থক্য এই যে, সেবার শুধু আমরা (বাঙালি জাতি) আর এবার গোটা বিশ্ব এক ভিন্ন রকম ঈদ উদযাপন করতে যাচ্ছে।
অন্য নেতাদের ঈদ
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংসস্থার সাবেক চেয়ারম্যান ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গুলশানের নিজ বাসায় কোয়ারেনটাইনে আছেন। করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর বাসা থেকে বের হনিন তিনি। তার ঈদ এবার কোয়ারেনটাইনেই হবে।
তিনি বলেন, একশ বছর আগে পৃথিবীতে একবার ‘স্পেনিস ফ্লু মহামারি’ হয়েছিল। সেবার প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। কিন্তু এভাবে কাউকে ঘরবন্দি থাকতে হয়নি। কারণ, সেবার সংক্রমণের ধরনটা ছিল ভিন্ন। শুধু আমি কেন? একশ বছরের নিচে যাদের বয়স, তাদের কেউ এ ধরনের সংকট দেখেনি। এই সংকটের মধ্যে ঈদানন্দ, ঈদোৎসব চিন্তা করার সুযোগ নেই। এখন বেঁচে থাকাটাই বড় কথা। বেঁচে থাকলে অনেক ঈদ আসবে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরুদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, ড. মঈন খান, গয়েশ্বরচন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ঈদ করবেন ঢাকায়। তারা প্রত্যেকেই ঢাকার গুলশান-বনানীর বাসায় কোয়ারেনটাইনে আছেন।
তবে স্থীয় কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান ঈদ করবেন নিজ জেলা চট্টগ্রামে। করোনা দুর্যোগ শুরুর আগে চট্টগ্রামে গিয়ে সেখানে আটকা পড়েছেন তারা। এবারের ঈদ সেখানেই উদযাপন করবেন তারা।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বর্ষীয়ান রাজনীতিক শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ঈদ করবেন ঢাকায়। প্রবীণ এই রাজনীতিক গুলশানের নিজ বাসায় কোয়ারেনটাইনে আছেন। অন্যবার ঈদের দিন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেও এবার করছেন না।
দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঈদ করবেন রাজধানীর আদাবরের বাসায়। করোনা সংকটে সবচেয়ে সক্রিয় এ নেতার গত চার ঈদ কেটেছে নয়াপল্টন কার্যালয়ে। এবার তিনি ঈদ করবেন পরিবারের সঙ্গে।
এছাড়া বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম, ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউছুফ, মো. শাহজাহান, শামসুজ্জামান দুদু, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ঈদ করবেন ঢাকায়। এরা সবাই নিজ নিজ বাসায় কোয়ারেনটাইনে আছেন।
বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রেসউইং কর্মকর্তা শামসুদ্দিন দিদার জানিয়েছেন, ঈদের দিন সকাল ১১ টায় শেরেবাংলা নগরে প্রয়াত রাষ্টপ্রতি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করবেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। এ আয়োজন কেবল স্থাীয় কমিটির সদস্যদের জন্য। অন্যদের সেখানে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে দলের পক্ষ থেকে।
বিজনেস আওয়ার/২৪ মে, ২০২০/এ