শাহিন শুভ : রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে সংগৃহিত অর্থের ব্যবহারে অনিয়ম ও বিপুল পরিমাণ অর্থ নগদ লেনদেন এবং একই গ্রুপের বিভিন্ন কেম্পানির মধ্যে লেনদেনের ডকুমন্টেস দেখাতে না পারার কারনে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আর.এন স্পিনিংয়ের ৫ পরিচালককে ১ কোটি টাকা জরিমানা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
দোষী ব্যক্তিরা হলেন- আর.এন স্পিনিংয়ের চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর এ.কে.এম হাফিজ আহমেদ (অব:), পরিচালক কিম জং সুক, শিরিন ফারুক ও আল-হাজ্ব আব্দুল কাদের ফারুক। এদের মধ্যে আল-হাজ্ব আব্দুল কাদের ফারুককে ৬০ লাখ টাকা এবং বাকি ৪জনকে ১০ লাখ করে ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে।
অনিয়ম ১ : আর.এন স্পিনিং কর্তৃপক্ষ ২০১২ সালে রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে সংগৃহিত অর্থ রাইট অফার ডকুমেন্টসে (আরওডি) উল্লেখিতভাবে ব্যবহার করেনি। কিন্তু এমনটি করার আগে বিএসইসির ও সাধারন সভায় শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন লাগে। তা না করেই আর.এন স্পিনিং কর্তৃপক্ষ সিভিল ওয়ার্কের জন্য রাইট অফার ডকুমেন্টসে উল্লেখিত ১৫ কোটি টাকার পরিবর্তে ৩৩ কোটি টাকা ব্যবহার করেছে। এক্ষেত্রে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ ১৯৬৯ এর ধারা ২সিসি লঙ্ঘন করা হয়েছে।
এছাড়া ব্যাংকিং চ্যানেলের বাহিরে রাইট ইস্যুর ৫৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা নগদে ব্যবহার করেছে। অথচ ১ লাখ টাকার উপরে নগদে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই ডিমান্ড ড্রাফট/পে অর্ডার/ক্রোশড চেকের মাধ্যমে লেনদেন বাধ্যতামূলক। তা না করে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ ১৯৬৯ এর ধারা ২সিসির ১৩ নং শর্ত লঙ্ঘন করা হয়েছে।
রাইটের অপব্যবহারের শুনানিতে আর.এন স্পিনিংয়ের কোম্পানি সচিব হান্নান মোল্লা ২০১৫ সালের ২৩ মার্চ বলেন, রাইট অফার ডকুমেন্টসে সিভিল ওয়ার্কে সম্ভাব্য ১৫ কোটি টাকা ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল ২০১০ সালের শেষে। কিন্তু রাইট ইস্যুর মাধ্যমে সংগৃহিত টাকা ২০১৩ সালে ব্যবহারের অনুমতি পাওয়া যায়। এই সময়ের জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। যে কারনে বিষয়টি ২০১৩ সালের ১১ জুলাই পর্ষদ সভায় অনুমতিও নেওয়া হয়েছিল এবং ২০১২ সালের এজিএমে উত্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারনে এজিএম অনুষ্ঠিত না হওয়ায় শেয়ারহোল্ডারদের সম্মতি নেওয়া হয়নি। এছাড়া রাইটে ৫৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা নগদে ব্যবহারের যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, সেটাও ঠিক নয় বলে শুনানিতে আর.এন স্পিনিংয়ের দাবি। ওই অর্থের মধ্যে ১২ কোটি টাকা রাইটের।
কিন্তু এই ব্যাখ্যা কমিশনের কাছে বিবেচনাযোগ্য হয়নি। এই পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারের উন্নয়ন, বাজারে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা রক্ষার স্বার্থে আর.এন স্পিনিংয়ের চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর এ.কে.এম হাফিজ আহমেদ (অব:), পরিচালক কিম জং সুক, শিরিন ফারুক ও আল-হাজ্ব আব্দুল কাদের ফারুক জরিমানা করা প্রয়োজন এবং সমীচীন বলে কমিশন মনে করে। যে কারনে কমিশন আল-হাজ্ব আব্দুল কাদের ফারুককে ৩০ লাখ টাকা ও বাকি ৪ জনকে ৫ লাখ টাকা করে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। এই শাস্তির বিষয়ে সম্প্রতি চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে কমিশন।
আরও পড়ুন….
ইয়াজদানিকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা
প্রাইম ইসলামী লাইফ ও সিকিউরিটিজকে ৮ লাখ টাকা জরিমানা
ইসি সিকিউরিটিজ ও সিইও খুরশিদ আলমকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা
অনিয়ম ২ : রাইট নিয়ে ওই অনিয়মের পরেও থেমে থাকেনি আর.আন স্পিনিং কর্তৃপক্ষ। এরপরে তারা ২০১৪ সালে আবারও বড় অংকের অর্থ নগদ লেনদেন করে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যয়ের ডকুমেন্টস দেখাতে পারেনি। যে কারনে কমিশন এক্ষেত্রেও আল-হাজ্ব আব্দুল কাদের ফারুককে ৩০ লাখ টাকা ও বাকি ৪ জনকে ৫ লাখ টাকা করে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে।
আর.এন স্পিনিংয়ের ২০১৪ সালের নিরীক্ষত আর্থিক হিসাব পর্যালোচনায় কমিশনের কর্পোরেট ফিন্যান্স বিভাগ বলেছে, এ কোম্পানিটির জন্য কমিশনের অধ্যাদেশ ভঙ্গ করে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাহিরে ৪৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকার ক্যাশে স্থায়ী সম্পদ কেনা হয়েছে। এছাড়া দায়ের বিপরীতে একই গ্রুপের এম.এল ডাইংকে প্রদত্ত ৫৩ কোটি ৯ লাখ টাকার বিপরীতে কোন ডকুমেন্টস নেই। এমনকি সহযোগি কোম্পানি চং অং এআরএস সোয়েটারকে ১৭ কোটি ৩ লাখ টাকা ও টোটাল স্পিনিং মিলসকে ১০ কোটি ১ লাখ টাকা প্রদত্ত অর্থের কোন ব্যাংক স্টেটমেন্ট এবং কোম্পানি দুটির নিরীক্ষত আর্থিক হিসাব দিতে পারেনি। আর শিরিন ফারুকের থেকে নেওয়া ২০ কোটি ২৬ লাখ টাকা ও কিম জুন সুকের কাছ থেকে নেওয়া ৩৯ কোটি ৭৪ টাকার ব্যাংক স্টেটমেন্ট দিতে পারেনি।
এসব অনিয়মের শুনানিতে আর.এন স্পিনিংয়ের কোম্পানি সচিব হান্নান মোল্লা ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর বলেন, স্থায়ী সম্পদ কেনার ক্ষেত্রে সময়মতো সাপ্লায়ার বা বিক্রেতাকে পাওনা পরিশোধের জন্য ৪২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা নগদে পরিশোধ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন….
অনিশ্চয়তায় আর.এন স্পিনিয়ের ব্যবসা
আর.এন স্পিনিংয়ের নিরীক্ষককে শেয়ারবাজারে ৩ বছর নিষিদ্ধ
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ওই রাইট ইস্যুর মাধ্যমে নির্ধারিত চাঁদা প্রদানে ব্যর্থতার জন্য কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কমিশন। ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি বিএসইসির ৪৬৪তম কমিশন সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এছাড়া কোম্পানির সচিবকে অপসারণ এবং পরবর্তী ৫ বছরের জন্য শেয়ারবাজার সংক্রান্ত কোন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
একই কমিশন সভায় রাইট শেয়ার অফার সংক্রান্ত শর্তাবলী লঙ্ঘন করে স্পন্সর বা পরিচালকদের চাঁদার টাকা সময়মত জমা না দেয়ার কারণে আর.এন স্পিনিং মিলস লিমিটেডকে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯-এর সেকশন ২২ অনুযায়ী ১০ লাখ টাকা, পরিচালক শিরিন ফারুককে ২৫ লাখ টাকা এবং অন্য পরিচালকদের প্রত্যেককে ৫০ লাখ টাকা করে জরিমানার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
বিজনেস আওয়ার/২৪ জুলাই, ২০২২/আরএ