ঢাকা , শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একজন মুমিনের জীবনে কী প্রয়োজন?

  • পোস্ট হয়েছে : ০৮:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • 145

বিজনেস আওয়ার ডেস্ক: ঈমান ও ইসলামের নিয়ামতের পর মানুষের নিকট সবচেয়ে বড় নিয়ামত জীবনের নিরাপত্তা। আর এই নিরাপত্তার গুরুত্ব ও তাত্পর্য একমাত্র ওই ব্যক্তি অনুধাবন করতে পারে, যে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। যে ব্যক্তি এমন দেশ বা অঞ্চলে বসবাস করে, যেখানে কঠিন রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ব্যাপক সামাজিক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে এবং যেখানে তুমুল যুদ্ধ চলে।

কামানের গুলির বিকট শব্দ বার বার প্রতিধ্বনিত হয়। আকাশ থেকে যুদ্ধ বিমানের মুহুর্মুহু গোলা বর্ষণ হৃদয়কে প্রকম্পিত করে।

নির্বিচারে গুলি করে মানুষকে হত্যা করা হয় আর ক্ষেত-খামার জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ সামান্য নিরাপত্তার জন্য পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে থাকে। বুকের উপর হাত রেখে মৃত্যুর প্রহর গুণতে গুণতে নির্ঘুম রাত্রি যাপন করে। এমন অবস্থায় প্রকৃত মুমিনকে সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলমের (শিরকের) সাথে মিশায়নি, তাদের জন্য রয়েছে নিরাপত্তা আর তারাই সঠিক পথপ্রাপ্ত’ (আল-আনআন-৬/৮২)।

عَنْ سَلَمَةَ بْنِ عُبَيْدِ اللهِ بْنِ مِحْصَنٍ الخَطْمِيِّ عَنْ أَبِيهِ وَكَانَتْ لَهُ صُحْبَةٌ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمْ آمِنًا فِي سِرْبِهِ مُعَافًى فِي جَسَدِهِ عِنْدَهُ قُوتُ يَوْمِهِ فَكَأَنَّمَا حِيزَتْ لَهُ الدُّنْيَا.

সালামা ইবনে উবাইদুল্লাহ ইবনে মিহছান আল-খাত্বমী হতে বর্ণিত, তিনি তার পিতা হতে বর্ণনা করেন। তার (পিতা) রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহচর্য লাভ করেছিলেন। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার বাসায় নিরাপদে দিন যাপন করে, শারীরিকভাবে সুস্থ থাকে আর একদিন অতিবাহিত করার সমপরিমাণ খাবার তার নিকটে থাকে, তার যেন সমগ্র পৃথিবী হস্তগত হয়েছে’। [সুনানে তিরমীযী, হা/২৩৪৬]

أَصْبَحَ – (সকাল করল) এই বাক্যে একথার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, একজন মুমিন কখনো ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয় না। কেননা তার সকল বিষয় আল্লাহ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। তিনি সকল বিষয় সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং সকলের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেন। তাছাড়া আল্লাহর উপর ভালো ধারণা রাখা এবং তাঁর নিকট কল্যাণের প্রত্যাশা করা প্রত্যেক মুমিনের নৈতিক কর্তব্য।

آمِنًا فِي سِرْبِهِ (পরিবার-পরিজন নিয়ে নিরাপদে থাকা) বলতে নিজ বাসায় বা চলার পথে নিরাপদে থাকার কথা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ সে এমন নিরাপত্তা অর্জন করে যে, জীবনহানির সম্ভাবনা থাকে না বা তার মাল-সম্পদ খোয়া যাওয়ার কোনরূপ আশঙ্কা থাকে না কিংবা তার সম্ভ্রম হরণের কোনো প্রকার ভয় থাকে না।

তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা, ঈমানকে একনিষ্ঠ করা এবং সৎকর্ম সম্পাদন করার শর্তে আল্লাহ তাআলা মুমিনকে নিরাপত্তা প্রদানের অঙ্গীকার করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্য হতে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদের সাথে আল্লাহ তাআলা অঙ্গীকার করেছেন যে, অবশ্যই তিনি তাদের পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমনভাবে প্রতিনিধিত্ব দান করা হয়েছিল তাদের পূর্ববর্তী জাতিকে আর অবশ্যই তিনি তাদের জীবনবিধানকে সুদৃঢ় করবেন, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে নিরাপদ থাকার ব্যবস্থা করবেন, যাতে করে তারা আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে কোনো কিছু শরীক না করে। এরপরও যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তারাই প্রকৃতপক্ষে ফাসিক্ব’ (আন-নূর, ২৪/৫৫)। আল্লাহ তাআলা অন্য জায়গায় বলেছেন, ‘তোমরা মনোযোগ দিয়ে শোনো! নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার অলীগণের কোনো ভয় নেই এবং তাদের চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণও নেই। নিশ্চয় যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য ইহকাল ও পরকালে শুভসংবাদ রয়েছে। আল্লাহ তাআলার বাণীর কখনো পরিবর্তন হয় না আর এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য’ (ইউনুস, ১০/৬২-৬৪)।

مُعَافًى فِي جَسَدِهِ (শারীরিক সুস্থতা) শারীরিকভাবে সুস্থ-সবল এবং অসুখ-বিসুখমুক্ত অবস্থায় ঘুম থেকে উঠেছে। অর্থাৎ সব ধরনের সমস্যামুক্ত হয়ে সুস্থ শরীর নিয়ে দিনটি অতিবাহিত করতে পেরেছে। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)–এর নিয়মিত রোগমুক্তি চাওয়ার কথা উল্লেখ আছে। তিনি বলতেন,

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ البَرَصِ وَالْجُنُونِ وَالْجُذَامِ وَمِنْ سَيِّئِ الْأَسْقَامِ

‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট শ্বেতরোগ, পাগলামি, কুষ্ঠরোগ ও বিভিন্ন প্রকার দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি চাই’। [মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩০০৪]

আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় আল্লাহ তাআলার নিকট ইবাদত আদায়ে একনিষ্ঠতা, পার্থিব বিষয়ের সুস্থতা, স্বাস্থ্যকর জীবন, পরিবারিক পবিত্রতা ও অর্থ-সম্পদের নিরাপত্তা কামনা করতেন। একইভাবে তিনি তাঁর ছহাবীগণের উল্লিখিত বিষয়গুলো চাওয়ার জন্য আদেশ দিতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকাল ও সন্ধ্যায় এই দুআগুলো পড়া হতে কখনোই বিরত থাকতেন না। তিনি বলতেন,

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْعَافِيَةَ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْعَفْوَ وَالْعَافِيَةَ فِي دِينِي وَدُنْيَايَ وَأَهْلِي وَمَالِي

‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকটে দুনিয়া ও পরকালীন জীবনের নিরাপত্তা চাই। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আমার দ্বীনী বিষয়, আমার দুনিয়াবী বিষয়, আমার পরিবারিক বিষয় ও অর্থ-সম্পদের সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ, ব্যবহার ও নিরাপত্তা চাই’। [সুনানে আবূ দাঊদ, হা/২৩৪৯]

মুআয ইবনু রিফাআ তার পিতা থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতে বলেন, আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) মিম্বারে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন, অতঃপর বললেন, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরতের প্রথম বর্ষে মিম্বারে দাঁড়িয়েছিলেন। অতঃপর কাঁদতে শুরু করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা আল্লাহর নিকট নিরাপত্তা এবং সুস্বাস্থ্য কামনা করো। কেননা ঈমানের পরে তোমাদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ যে জিনিসটি দেওয়া হয়েছে, তা হলো সুস্বাস্থ্য’। [সুনানে তিরমিযী, হা/২৮২১]

আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুস্বাস্থ্য ও অবসার সময়ের সৎব্যবহারের গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, ‘বেশিরভাগ মানুষই আল্লাহর এই নিয়ামতের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করে এবং প্রতারিত হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘(আল্লাহর) দুইটি নিয়ামত আছে, যার (সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব) সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষই অসচেতন থাকে। তার একটি হচ্ছে সুস্বাস্থ্য আর অপরটি হচ্ছে অবসর সময়’। [ছহীহ বুখারী, হা/৬৩১২] স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার যত্ন নেওয়া, পরিচর্যা করা প্রতেকের উচিত।

আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্য হাদীছে তাঁর উম্মতকে অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতাকে গনীমত হিসাবে গ্রহণ করার জন্য আদেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা পাঁচটি বস্তুকে অপর পাঁচটি বস্তুর আগমনের পূর্বে গনীমত হিসেবে গ্রহণ করো। তার একটি হচ্ছে অসুস্থতা আসার পূর্বে সুস্থতা’। [মুসতাদরাক হাকেম, হা/৭৯১৬] সুস্থতাকে অসুস্থতার পূর্বে গনীমত মনে করো। অর্থাৎ অসুস্থ হওয়ার পূর্বেই সুস্থতার সৎ ব্যবহার করে পরকালীন পাথেয় সংগ্রহ করে নাও। ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা যখন সকাল করবে, তখন সন্ধ্যা পর্যন্ত বেঁচে থাকার প্রত্যাশা করবে না। আর যখন সন্ধ্যা করবে, তখন সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকার প্রত্যাশা করবে না’। [ছহীহ বুখারী, হা/৬৪১৬] অর্থাৎ তোমরা সুস্থতার সময়কে ইবাদতের কাজে লাগিয়ে অসুস্থতার সময়ের জন্য কিছু পাথেয় সংগ্রহ করে নাও এবং তোমাদের জীবিত অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে পরকালীন সময়ের পাথেয় সংগ্রহ করে নাও।

বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, তারা এমন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত, যার চিকিৎসার কোনো উপায় আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের হাতে নেই। এসব রোগের লক্ষণ নির্ণয় এবং ব্যবস্থাপত্র প্রদানে সমগ্র বিশ্বের স্বনামধন্য এবং প্রথিতযশা চিকিৎসকগণ সম্পূর্ণরূপে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা নিজেদের অসহায়ত্বের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। যাতে করে স্বাস্থ্যকর জীবন লাভে ধন্য মুসলিম ভাই-বোন সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহ তাআলার এই নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন তোমরা যা চেয়েছিলে তার সবকিছুই তোমাদের প্রদান করা হয়েছিল। যদি তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত গণনা করতে চাও তবে তোমরা তা গুণে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ বড়ই অত্যাচারী ও অকৃতজ্ঞ’ (ইবরাহীম, ১৪/৩৪)।

عِنْدَهُ قُوتُ يَوْمِهِ (তার নিকট একদিনের খাবার আছে) অর্থাৎ তার নিকট এই পরিমাণ খাবার আছে, যা দিয়ে সে একদিন সকাল-সন্ধ্যা খেতে পারে। কারণ খাদ্য হচ্ছে আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে বড় নিয়ামত। এজন্য আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তারা যেন এই ঘরের প্রতিপালকের ইবাদত করে, যিনি তাদের ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাদ্য দান করেছেন এবং ভয় থেকে নিরাপত্তা দান করেছেন’ (কুরায়েশ, ১০৬/৩-৪)। মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্ষুধা থেকে মুক্তি চাইতেন। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট খাদ্যের অভাব থেকে মুক্তি চাই। কেননা অভুক্ত থাকার বেদনা কতই না যন্ত্রণাদায়ক’। [সুনানে আবূ দাঊদ, হা/১৫৪৭] আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর প্রতিপালকের নিকট এইভাবে খাদ্য সঙ্কটের প্রকোপ থেকে মুক্তি চেয়েছেন। তিনি এমন পরিমাণ আহার চেয়েছেন, যা তাঁর তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মিটানোর জন্যে যথেষ্ট হয়। তাছাড়া তিনি ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করা থেকে নিজে বিরত থেকেছেন এবং ছাহাবীদের নিরুৎসাহিত করেছেন। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরিবারের জন্য এমন পরিমাণ রিযিক্বের ব্যবস্থা করো, যা দিয়ে তাদের তাৎক্ষণিক ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা হয়’। [ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৬০]

পূর্বের আলোচিত এই তিনটি নিয়ামতের সমন্বয় যদি কোনো মুমিনের প্রাত্যহিক জীবনে হয়ে যায়, তবে তাকে মনে করতে হবে যে তার জীবনে আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। তার জীবনের সার্বিক ব্যবস্থাপনা এমন পূর্ণতায় পৌঁছে গেল যে, মনে হয় যেন পুরো পৃথিবীর মালিকানা তার হস্তগত হয়ে গেছে। বর্তমান পৃথিবীতে বসবাসরত অনেক মুসলিম রয়েছে, যাদের ভাগ্যে এরূপ শত শত নয়, হাজার হাজার নয়, লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি কোটি গুণ অর্থ-সম্পদ, বিত্ত-বৈভব, আরাম-আয়েশ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সমাবেশ ঘটেছে। ব্যাপক নিরাপত্তা, পরিপূর্ণ শারীরিক সুস্থতা এবং অঢেল সম্পদের সমাবেশ তাদের জীবনে ঘটেছে তবুও তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তারা যে অবস্থানে আছে, সেটাকে তারা নিজেদের জন্য অপমানজনক এবং লজ্জাকর মনে করে যা তাদের ক্ষুদ্র মানসিকতা ও পরকাল বিমুখতার পরিচায়ক। এই শ্রেণির মানুষের অবস্থার বিবরণ দিয়ে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা আল্লাহ তাআলার নিয়ামত সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে অবগত কিন্তু তারপরও তারা আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করে আর তাদের বেশিরভাগই হচ্ছে অকৃতজ্ঞ’ (আন-নহল, ১৬/৮৩)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘তবে তারা কি আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করে?’ (আন-নাহল, ১৬/৭১)।

আর এই সব মানসিক রোগের ক্ষতি থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রত্যেকের উচিত হবে, ওই সমস্ত মানুষের প্রতি লক্ষ্য করা। যারা এই সমস্ত নিয়ামত উপভোগ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়েছে, অথবা আংশিক কিংবা যৎকিঞ্চিত ভোগ করার সুযোগ পেয়েছে। যেমন আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা তাদের লক্ষ্য করো, যারা (দুনিয়াবী সুবিধার বিচারে) তোমাদের চেয়ে নিচে অবস্থান করে আর তাদের প্রতি লক্ষ্য করো না, যারা (এক্ষেত্রে) তোমাদের উপরে অবস্থান করে। আল্লাহ তাআলার নিয়ামতকে অস্বীকার করার অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়ার এটাই সর্বোত্তম পন্থা’। [ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৯০; ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৬৩]

এই হাদীছের ব্যাখ্যায় বর্ণিত আলোচনা যদি ভালোভাবে অনুধাবন করা হয়, তবে যার সুস্থ দেহ, নিরাপদ জীবন যাপনের ব্যবস্থা, বসবাসের জন্য একটা বাড়ি, জীবনসঙ্গী হিসেবে একজন স্ত্রী আর প্রাত্যহিক জীবনের খরচ আছে, তার জীবনে কোনো দুঃখ-কষ্ট বা অভাব-অভিযোগ থাকবে না। দুনিয়ার জীবনে আর কোনো প্রাপ্তির তাড়না তাকে আহত করবে না।

জীবন-জীবিকার জন্য প্রাপ্ত সম্পদ তাকে পরিতৃপ্ত ও তুষ্ট রাখবে। যে কোনো অভাব-অভিযোগ আর দুঃখ-বেদনা ইত্যাদি দূর হয়ে যাবে। আত্মিক প্রশান্তি এবং মানসিক স্বস্তি লাভ করবে। পারিবারিক কলহ, সামাজিক অবিচার বা অন্য যে কোনো সমস্যা হালকা মনে হবে। সুন্দর স্ত্রী, মনোরম বাড়ি, আধুনিক চাকচিক্য, দুনিয়াবী শান-শওকত ইত্যাদির প্রতি আগ্রহ কমে আসবে। দুনিয়ার জীবনে শান্তি এবং পরকালীন চির সুখের স্থান জান্নাত লাভের দুয়ার উন্মুক্ত হয়ে যাবে। আল্লাহ আমাদের এই হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার তাওফীক্ব দিন- আমীন! ছুম্মা আমিন।

বিজনেস আওয়ার/১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২/এএইচএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান:
ট্যাগ :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার মেইলে তথ্য জমা করুন

একজন মুমিনের জীবনে কী প্রয়োজন?

পোস্ট হয়েছে : ০৮:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

বিজনেস আওয়ার ডেস্ক: ঈমান ও ইসলামের নিয়ামতের পর মানুষের নিকট সবচেয়ে বড় নিয়ামত জীবনের নিরাপত্তা। আর এই নিরাপত্তার গুরুত্ব ও তাত্পর্য একমাত্র ওই ব্যক্তি অনুধাবন করতে পারে, যে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। যে ব্যক্তি এমন দেশ বা অঞ্চলে বসবাস করে, যেখানে কঠিন রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ব্যাপক সামাজিক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে এবং যেখানে তুমুল যুদ্ধ চলে।

কামানের গুলির বিকট শব্দ বার বার প্রতিধ্বনিত হয়। আকাশ থেকে যুদ্ধ বিমানের মুহুর্মুহু গোলা বর্ষণ হৃদয়কে প্রকম্পিত করে।

নির্বিচারে গুলি করে মানুষকে হত্যা করা হয় আর ক্ষেত-খামার জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ সামান্য নিরাপত্তার জন্য পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে থাকে। বুকের উপর হাত রেখে মৃত্যুর প্রহর গুণতে গুণতে নির্ঘুম রাত্রি যাপন করে। এমন অবস্থায় প্রকৃত মুমিনকে সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলমের (শিরকের) সাথে মিশায়নি, তাদের জন্য রয়েছে নিরাপত্তা আর তারাই সঠিক পথপ্রাপ্ত’ (আল-আনআন-৬/৮২)।

عَنْ سَلَمَةَ بْنِ عُبَيْدِ اللهِ بْنِ مِحْصَنٍ الخَطْمِيِّ عَنْ أَبِيهِ وَكَانَتْ لَهُ صُحْبَةٌ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمْ آمِنًا فِي سِرْبِهِ مُعَافًى فِي جَسَدِهِ عِنْدَهُ قُوتُ يَوْمِهِ فَكَأَنَّمَا حِيزَتْ لَهُ الدُّنْيَا.

সালামা ইবনে উবাইদুল্লাহ ইবনে মিহছান আল-খাত্বমী হতে বর্ণিত, তিনি তার পিতা হতে বর্ণনা করেন। তার (পিতা) রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহচর্য লাভ করেছিলেন। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার বাসায় নিরাপদে দিন যাপন করে, শারীরিকভাবে সুস্থ থাকে আর একদিন অতিবাহিত করার সমপরিমাণ খাবার তার নিকটে থাকে, তার যেন সমগ্র পৃথিবী হস্তগত হয়েছে’। [সুনানে তিরমীযী, হা/২৩৪৬]

أَصْبَحَ – (সকাল করল) এই বাক্যে একথার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, একজন মুমিন কখনো ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয় না। কেননা তার সকল বিষয় আল্লাহ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। তিনি সকল বিষয় সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং সকলের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেন। তাছাড়া আল্লাহর উপর ভালো ধারণা রাখা এবং তাঁর নিকট কল্যাণের প্রত্যাশা করা প্রত্যেক মুমিনের নৈতিক কর্তব্য।

آمِنًا فِي سِرْبِهِ (পরিবার-পরিজন নিয়ে নিরাপদে থাকা) বলতে নিজ বাসায় বা চলার পথে নিরাপদে থাকার কথা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ সে এমন নিরাপত্তা অর্জন করে যে, জীবনহানির সম্ভাবনা থাকে না বা তার মাল-সম্পদ খোয়া যাওয়ার কোনরূপ আশঙ্কা থাকে না কিংবা তার সম্ভ্রম হরণের কোনো প্রকার ভয় থাকে না।

তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা, ঈমানকে একনিষ্ঠ করা এবং সৎকর্ম সম্পাদন করার শর্তে আল্লাহ তাআলা মুমিনকে নিরাপত্তা প্রদানের অঙ্গীকার করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্য হতে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদের সাথে আল্লাহ তাআলা অঙ্গীকার করেছেন যে, অবশ্যই তিনি তাদের পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমনভাবে প্রতিনিধিত্ব দান করা হয়েছিল তাদের পূর্ববর্তী জাতিকে আর অবশ্যই তিনি তাদের জীবনবিধানকে সুদৃঢ় করবেন, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে নিরাপদ থাকার ব্যবস্থা করবেন, যাতে করে তারা আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে কোনো কিছু শরীক না করে। এরপরও যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তারাই প্রকৃতপক্ষে ফাসিক্ব’ (আন-নূর, ২৪/৫৫)। আল্লাহ তাআলা অন্য জায়গায় বলেছেন, ‘তোমরা মনোযোগ দিয়ে শোনো! নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার অলীগণের কোনো ভয় নেই এবং তাদের চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণও নেই। নিশ্চয় যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য ইহকাল ও পরকালে শুভসংবাদ রয়েছে। আল্লাহ তাআলার বাণীর কখনো পরিবর্তন হয় না আর এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য’ (ইউনুস, ১০/৬২-৬৪)।

مُعَافًى فِي جَسَدِهِ (শারীরিক সুস্থতা) শারীরিকভাবে সুস্থ-সবল এবং অসুখ-বিসুখমুক্ত অবস্থায় ঘুম থেকে উঠেছে। অর্থাৎ সব ধরনের সমস্যামুক্ত হয়ে সুস্থ শরীর নিয়ে দিনটি অতিবাহিত করতে পেরেছে। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)–এর নিয়মিত রোগমুক্তি চাওয়ার কথা উল্লেখ আছে। তিনি বলতেন,

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ البَرَصِ وَالْجُنُونِ وَالْجُذَامِ وَمِنْ سَيِّئِ الْأَسْقَامِ

‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট শ্বেতরোগ, পাগলামি, কুষ্ঠরোগ ও বিভিন্ন প্রকার দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি চাই’। [মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩০০৪]

আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় আল্লাহ তাআলার নিকট ইবাদত আদায়ে একনিষ্ঠতা, পার্থিব বিষয়ের সুস্থতা, স্বাস্থ্যকর জীবন, পরিবারিক পবিত্রতা ও অর্থ-সম্পদের নিরাপত্তা কামনা করতেন। একইভাবে তিনি তাঁর ছহাবীগণের উল্লিখিত বিষয়গুলো চাওয়ার জন্য আদেশ দিতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকাল ও সন্ধ্যায় এই দুআগুলো পড়া হতে কখনোই বিরত থাকতেন না। তিনি বলতেন,

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْعَافِيَةَ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْعَفْوَ وَالْعَافِيَةَ فِي دِينِي وَدُنْيَايَ وَأَهْلِي وَمَالِي

‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকটে দুনিয়া ও পরকালীন জীবনের নিরাপত্তা চাই। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আমার দ্বীনী বিষয়, আমার দুনিয়াবী বিষয়, আমার পরিবারিক বিষয় ও অর্থ-সম্পদের সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ, ব্যবহার ও নিরাপত্তা চাই’। [সুনানে আবূ দাঊদ, হা/২৩৪৯]

মুআয ইবনু রিফাআ তার পিতা থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতে বলেন, আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) মিম্বারে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন, অতঃপর বললেন, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরতের প্রথম বর্ষে মিম্বারে দাঁড়িয়েছিলেন। অতঃপর কাঁদতে শুরু করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা আল্লাহর নিকট নিরাপত্তা এবং সুস্বাস্থ্য কামনা করো। কেননা ঈমানের পরে তোমাদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ যে জিনিসটি দেওয়া হয়েছে, তা হলো সুস্বাস্থ্য’। [সুনানে তিরমিযী, হা/২৮২১]

আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুস্বাস্থ্য ও অবসার সময়ের সৎব্যবহারের গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, ‘বেশিরভাগ মানুষই আল্লাহর এই নিয়ামতের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করে এবং প্রতারিত হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘(আল্লাহর) দুইটি নিয়ামত আছে, যার (সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব) সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষই অসচেতন থাকে। তার একটি হচ্ছে সুস্বাস্থ্য আর অপরটি হচ্ছে অবসর সময়’। [ছহীহ বুখারী, হা/৬৩১২] স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার যত্ন নেওয়া, পরিচর্যা করা প্রতেকের উচিত।

আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্য হাদীছে তাঁর উম্মতকে অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতাকে গনীমত হিসাবে গ্রহণ করার জন্য আদেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা পাঁচটি বস্তুকে অপর পাঁচটি বস্তুর আগমনের পূর্বে গনীমত হিসেবে গ্রহণ করো। তার একটি হচ্ছে অসুস্থতা আসার পূর্বে সুস্থতা’। [মুসতাদরাক হাকেম, হা/৭৯১৬] সুস্থতাকে অসুস্থতার পূর্বে গনীমত মনে করো। অর্থাৎ অসুস্থ হওয়ার পূর্বেই সুস্থতার সৎ ব্যবহার করে পরকালীন পাথেয় সংগ্রহ করে নাও। ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা যখন সকাল করবে, তখন সন্ধ্যা পর্যন্ত বেঁচে থাকার প্রত্যাশা করবে না। আর যখন সন্ধ্যা করবে, তখন সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকার প্রত্যাশা করবে না’। [ছহীহ বুখারী, হা/৬৪১৬] অর্থাৎ তোমরা সুস্থতার সময়কে ইবাদতের কাজে লাগিয়ে অসুস্থতার সময়ের জন্য কিছু পাথেয় সংগ্রহ করে নাও এবং তোমাদের জীবিত অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে পরকালীন সময়ের পাথেয় সংগ্রহ করে নাও।

বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, তারা এমন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত, যার চিকিৎসার কোনো উপায় আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের হাতে নেই। এসব রোগের লক্ষণ নির্ণয় এবং ব্যবস্থাপত্র প্রদানে সমগ্র বিশ্বের স্বনামধন্য এবং প্রথিতযশা চিকিৎসকগণ সম্পূর্ণরূপে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা নিজেদের অসহায়ত্বের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। যাতে করে স্বাস্থ্যকর জীবন লাভে ধন্য মুসলিম ভাই-বোন সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহ তাআলার এই নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন তোমরা যা চেয়েছিলে তার সবকিছুই তোমাদের প্রদান করা হয়েছিল। যদি তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত গণনা করতে চাও তবে তোমরা তা গুণে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ বড়ই অত্যাচারী ও অকৃতজ্ঞ’ (ইবরাহীম, ১৪/৩৪)।

عِنْدَهُ قُوتُ يَوْمِهِ (তার নিকট একদিনের খাবার আছে) অর্থাৎ তার নিকট এই পরিমাণ খাবার আছে, যা দিয়ে সে একদিন সকাল-সন্ধ্যা খেতে পারে। কারণ খাদ্য হচ্ছে আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে বড় নিয়ামত। এজন্য আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তারা যেন এই ঘরের প্রতিপালকের ইবাদত করে, যিনি তাদের ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাদ্য দান করেছেন এবং ভয় থেকে নিরাপত্তা দান করেছেন’ (কুরায়েশ, ১০৬/৩-৪)। মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্ষুধা থেকে মুক্তি চাইতেন। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট খাদ্যের অভাব থেকে মুক্তি চাই। কেননা অভুক্ত থাকার বেদনা কতই না যন্ত্রণাদায়ক’। [সুনানে আবূ দাঊদ, হা/১৫৪৭] আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর প্রতিপালকের নিকট এইভাবে খাদ্য সঙ্কটের প্রকোপ থেকে মুক্তি চেয়েছেন। তিনি এমন পরিমাণ আহার চেয়েছেন, যা তাঁর তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মিটানোর জন্যে যথেষ্ট হয়। তাছাড়া তিনি ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করা থেকে নিজে বিরত থেকেছেন এবং ছাহাবীদের নিরুৎসাহিত করেছেন। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরিবারের জন্য এমন পরিমাণ রিযিক্বের ব্যবস্থা করো, যা দিয়ে তাদের তাৎক্ষণিক ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা হয়’। [ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৬০]

পূর্বের আলোচিত এই তিনটি নিয়ামতের সমন্বয় যদি কোনো মুমিনের প্রাত্যহিক জীবনে হয়ে যায়, তবে তাকে মনে করতে হবে যে তার জীবনে আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। তার জীবনের সার্বিক ব্যবস্থাপনা এমন পূর্ণতায় পৌঁছে গেল যে, মনে হয় যেন পুরো পৃথিবীর মালিকানা তার হস্তগত হয়ে গেছে। বর্তমান পৃথিবীতে বসবাসরত অনেক মুসলিম রয়েছে, যাদের ভাগ্যে এরূপ শত শত নয়, হাজার হাজার নয়, লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি কোটি গুণ অর্থ-সম্পদ, বিত্ত-বৈভব, আরাম-আয়েশ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সমাবেশ ঘটেছে। ব্যাপক নিরাপত্তা, পরিপূর্ণ শারীরিক সুস্থতা এবং অঢেল সম্পদের সমাবেশ তাদের জীবনে ঘটেছে তবুও তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তারা যে অবস্থানে আছে, সেটাকে তারা নিজেদের জন্য অপমানজনক এবং লজ্জাকর মনে করে যা তাদের ক্ষুদ্র মানসিকতা ও পরকাল বিমুখতার পরিচায়ক। এই শ্রেণির মানুষের অবস্থার বিবরণ দিয়ে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা আল্লাহ তাআলার নিয়ামত সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে অবগত কিন্তু তারপরও তারা আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করে আর তাদের বেশিরভাগই হচ্ছে অকৃতজ্ঞ’ (আন-নহল, ১৬/৮৩)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘তবে তারা কি আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করে?’ (আন-নাহল, ১৬/৭১)।

আর এই সব মানসিক রোগের ক্ষতি থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রত্যেকের উচিত হবে, ওই সমস্ত মানুষের প্রতি লক্ষ্য করা। যারা এই সমস্ত নিয়ামত উপভোগ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়েছে, অথবা আংশিক কিংবা যৎকিঞ্চিত ভোগ করার সুযোগ পেয়েছে। যেমন আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা তাদের লক্ষ্য করো, যারা (দুনিয়াবী সুবিধার বিচারে) তোমাদের চেয়ে নিচে অবস্থান করে আর তাদের প্রতি লক্ষ্য করো না, যারা (এক্ষেত্রে) তোমাদের উপরে অবস্থান করে। আল্লাহ তাআলার নিয়ামতকে অস্বীকার করার অপরাধ থেকে মুক্তি পাওয়ার এটাই সর্বোত্তম পন্থা’। [ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৯০; ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৬৩]

এই হাদীছের ব্যাখ্যায় বর্ণিত আলোচনা যদি ভালোভাবে অনুধাবন করা হয়, তবে যার সুস্থ দেহ, নিরাপদ জীবন যাপনের ব্যবস্থা, বসবাসের জন্য একটা বাড়ি, জীবনসঙ্গী হিসেবে একজন স্ত্রী আর প্রাত্যহিক জীবনের খরচ আছে, তার জীবনে কোনো দুঃখ-কষ্ট বা অভাব-অভিযোগ থাকবে না। দুনিয়ার জীবনে আর কোনো প্রাপ্তির তাড়না তাকে আহত করবে না।

জীবন-জীবিকার জন্য প্রাপ্ত সম্পদ তাকে পরিতৃপ্ত ও তুষ্ট রাখবে। যে কোনো অভাব-অভিযোগ আর দুঃখ-বেদনা ইত্যাদি দূর হয়ে যাবে। আত্মিক প্রশান্তি এবং মানসিক স্বস্তি লাভ করবে। পারিবারিক কলহ, সামাজিক অবিচার বা অন্য যে কোনো সমস্যা হালকা মনে হবে। সুন্দর স্ত্রী, মনোরম বাড়ি, আধুনিক চাকচিক্য, দুনিয়াবী শান-শওকত ইত্যাদির প্রতি আগ্রহ কমে আসবে। দুনিয়ার জীবনে শান্তি এবং পরকালীন চির সুখের স্থান জান্নাত লাভের দুয়ার উন্মুক্ত হয়ে যাবে। আল্লাহ আমাদের এই হাদীছের আলোকে জীবন গড়ার তাওফীক্ব দিন- আমীন! ছুম্মা আমিন।

বিজনেস আওয়ার/১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২/এএইচএ

ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার মতামত জানান: