শেয়ারবাজারে বিভিন্ন অনিয়মের কারনে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বে গত দেড় মাসে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ৪২ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এরমাধ্যমে বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটি বার্তা এরইমধ্যে দেওয়া হয়েছে বলে কমিশন মনে করছে। বাজারের উন্নয়নে এ ধারা আগামিতেও বজায় রাখতে হবে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এমন জরিমানার মধ্যেও গত কয়েকদিনে দূর্বল বা জাঙ্ক শেয়ারের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার দ্বিগুণ হবে, তিনগুণ হবে বলে প্রচারনা চালিয়ে বিনিয়োগকারীদেরকে অবৈধভাবে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে।
উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে জরিমানার পরিমাণ কম বলে শুরু থেকেই অভিযোগ রয়েছে। তবে শিবলী রুবাইয়াতের নতুন কমিশন সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। তার কমিশন সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উন্নত দেশগুলোর মতো শাস্তি দিতে না পারলেও অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। যা গত দেড় মাসের শাস্তির পরিমাণের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে।
কমিশনের শাস্তির পরিমাণ অনেক বাড়ানো সত্ত্বেও সেকেন্ডারি মার্কেটের কারসাজিকারদের মধ্যে এখনো সচেতনতা তৈরী হয়নি। তারা এখনো দূর্বল ও কম পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানির অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। এছাড়া বীমা খাতের কয়েকটি কোম্পানির অস্বাভাবিক দর বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে বিএসইসি কিংবা স্টক এক্সচেঞ্জের সার্ভেইল্যান্স বিভাগের কর্মতৎপরতা দেখা যায়নি। যাতে ওইসব জাঙ্ক শেয়ারে একটি পক্ষ কৃত্রিমভাবে লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্থ হবে সাধারন বিনিয়োগকারীরা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বিজনেস আওয়ারকে বলেন, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা ভর করে বসেছিল। সে জায়গা থেকে এখন বেরিয়ে এসেছে। এক্ষেত্রে নতুন কমিশনের বড় আর্থিক শাস্তি প্রদান ও কিছু কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) আবেদন বাতিল কাজ করেছে। এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। তবে এরমধ্যেও কেউ কেউ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে। যা নজড়দারিতে রাখতে হবে।
নিম্নে গত ১ মাসে অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি পাওয়া কিছু জাঙ্ক শেয়ারের তথ্য তুলে ধরা হল-
কোম্পানির নাম | ১৯ জুলাইয়ের দর (টাকা) | ১৬ আগস্টের দর (টাকা) | বৃদ্ধির হার |
ঢাকা ডাইং | ৩.৬০ | ৮ | ১২২% |
জিল বাংলা সুগার মিলস | ৫৩.৫০ | ১০৭.১০ | ১০০% |
মিথুন নিটিং | ৬.৭০ | ১২.৮০ | ৯১% |
শাইনপুকুর সিরামিকস | ৮ | ১৪.৭০ | ৮৪% |
শ্যামপুর সুগার মিলস | ২৮.৯০ | ৫১.৮০ | ৭৯% |
সাভার রিফ্র্যাক্টরিজ | ৯৯.৩০ | ১৬৮.৮০ | ৭০% |
মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজ | ৮.৮০ | ১৩.৮০ | ৫৭% |
আরামিট সিমেন্ট | ১১.৭০ | ১৮ | ৫৪% |
জিকিউ বলপেন | ৯৭ | ১৪৫.৬০ | ৫০% |
এমারেল্ড অয়েল | ৯.৫০ | ১৪.১০ | ৪৮% |
মেঘনা কনন্ডেসড মিল্ক | ১০ | ১৪.৮০ | ৪৮% |
দুলামিয়া কটন | ৪৯.৬০ | ৭২.৮০ | ৪৭% |
জুট স্পিনার্স | ৭৬.৫০ | ১০২.৮০ | ৩৪% |
গত ১৭ মে বিএসইসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন শিবলী রুবাইয়াত। এরপরে ২০ মে অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ ও অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান এবং ২ জুন আব্দুল হালিম কমিশনার হিসেবে যোগদান করেন। পূর্বের এক কমশিনারসহ এই নবনিযুক্ত পূর্ণাঙ্গ কমিশন ২৩ জুন ৭২৯তম কমিশন সভার মাধ্যমে জরিমানার শাস্তি প্রদান শুরু করেন। এমআই সিমেন্ট, ইনটেক ও আল ফারুক ব্যাগসের অনিয়মের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে সেই যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে শাস্তি কিছুটা কম দেওয়া হলেও তা ক্রমশ বাড়ছে। একইসঙ্গে বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে।
এমআই সিমেন্ট : তালিকাভুক্ত ও সাধারন বিনিয়োগকারীদের মালিকানা জড়িত এমআই সিমেন্ট থেকে শত শত কোটি কোটি টাকা পরিচালকদের নিজেদের ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানিতে বিনাসুদে প্রদান করায় কোম্পানির পর্ষদের ৫জনকে (স্বতন্ত্র ও মনোনিত ব্যতিত) ১০ লাখ টাকা করে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে কমিশন। গত ২৩ জুন কমিশনের ৭২৯তম নিয়মিত সভায় এই জরিমানা করা হয়েছে।
ইনটেক : শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন না নিয়েই বিভিন্ন খাতে ইনটেকের অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এছাড়া কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক ন্যূনতম শেয়ার ধারন করেনি। এ কারনে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের ৩জনকে (স্বতন্ত্র ও মনোনিত ব্যতিত) ২৫ লাখ টাকা করে ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে কমিশন।
আল ফারুক ব্যাগস : শেয়ারবাজারে আসার আগেই অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে এ কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। তারা একই নিরীক্ষক দিয়ে আর্থিক হিসাব নিরীক্ষা এবং করপোরেট গভর্নেন্স কোড পরিপালন সনদ প্রদান করেছে। এ কারনে কোম্পানিটিকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া কোম্পানিটির ইস্যু ম্যানেজার বিএমএসএল ইনভেস্টমেন্ট ও আইআইডিএফসি ক্যাপিটালকে ৫ লাখ করে মোট ১০ লাখ টাকা ও নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আর্টিজান চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
কাসেম ড্রাইসেল : শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানিটির শেয়ার কারসাজিতে গত ১৬ জুলাই কমিশনের ৭৩২তম সভায় ৩ প্রতিষ্ঠান ও ২ ব্যক্তিকে ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বিএসইসি। কাসেম ড্রাইসেলের শেয়ার অস্বাভাবিক লেনদেন করায় নারায়ণ চন্দ্র পাল অ্যান্ড এসোসিয়েটসকে ৩ কোটি টাকা, প্রাইম ইসলামি সিকিউরিটিজকে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, সোলায়মান রুবেল অ্যান্ড এসোসিয়েটসকে ১০ লাখ টাকা এবং মো. মাহমুদুজ্জামান ও মো. মাহিবুল ইসলামকে ৩০ লাখ টাকা জরিমানা করে।
কাট্টালি টেক্সটাইল : কোম্পানিটি শেয়ারবাজার থেকে উত্তোলিত টাকা যথাযথ ব্যবহার না করে কমিশনে মিথ্যা তথ্য প্রদান করে। এ সংক্রান্ত জাল ব্যাংক বিবরনী কমিশনে দাখিলের করায় কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ১ কোটি টাকা ও ৫ পরিচালককে (স্বতন্ত্র ও মনোনিত পরিচালক ব্যতিত) ৫০ লাখ টাকা করে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে কমিশন। গত ১৬ জুলাই ৭৩২তম নিয়মিত সভায় এই জরিমানা করা হয়েছে।
সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল : পূর্ব ঘোষণা ছাড়া শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা করায় সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিস রুখসানা মোর্শেদকে ৮ কোটি টাকা, পরিচালক শারমিন আক্তার লাভলিকে ৪ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সু ইন্ডাস্ট্রিজকে ২ কোটি টাকা জরিমানা করেছে কমিশন। গত ২৯ জুলাই বিএসইসির ৭৩৩তম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
একই কমিশন সভায়, বিধি মোতাবেক মাসিক ভিত্তিতে দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারহোল্ডিং প্রতিবেদন দাখিল না করায় সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল এবং তুং হাই নিটিং অ্যান্ড ডাইংয়ের প্রত্যেক পরিচালককে (স্বতন্ত্র পরিচালক ব্যতিত) ১ কোটি টাকা করে জরিমানার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইলের ৫ পরিচালককে ৫ কোটি টাকা ও তুং হাই নিটিং অ্যান্ড ডাইংয়ের ৬ পরিচালককে ৬ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
সালতা ক্যাপিটাল : বিনিয়োগকারীদের টাকা নিজ ব্যবহারের জন্য অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের ট্রেকহোল্ডার সালতা ক্যাপিটালকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বিএসইসি। গত ২৯ জুলাই এই জরিমানা করা হয়েছে।
বিবিএস কেবলস : গত ১৩ আগস্ট বিবিএস কেবলসের শেয়ার কারসাজিতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া যথাসময়ে পিএসই প্রকাশ না করায় বিবিএস কেবলসের প্রত্যেক পরিচালককে (স্বতন্ত্র পরিচালক ব্যতিত) ১০ লাখ টাকা করে মোট ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
এর আগে গত ২৯ জুলাই প্রসপেক্টাসে ‘রিলেটেড পার্টি ট্রান্সসেকশন’ এর তথ্য গোপন করায় বিবিএস কেবলসের প্রত্যেক পরিচালককে (স্বতন্ত্র ব্যতিত) ৫ লাখ করে মোট ৩০ লাখ টাকা, নিরীক্ষক আহমেদ জাকের অ্যান্ড কোং-কে ৫ লাখ টাকা এবং ইস্যু ম্যানেজার বানকো ফাইন্যান্স ও আইসিবি ক্যাপিটালকে ৫ লাখ করে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
বিজনেস আওয়ার/১৭ আগস্ট, ২০২০/আরএ
2 thoughts on “বিএসইসির দেড় মাসে সাড়ে ৪২ কোটি টাকা জরিমানা, থেমে নেই কারসাজি”